আওয়ামী আমলের সুবিধাভোগীদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে যশোর কৃষি বিভাগ

0

তহীদ মনি ॥ যশোরের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগসহ পুরো কৃষি খাত বর্তমানে একটি বিশেষ সুবিধাভোগী চক্রের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই চক্রের প্রধান হিসেবে অন্তত ৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তারা বছরের পর বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছেন, এমনকি কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিকও হয়েছেন। তাদের আয়ের সাথে সঙ্গতিবিহীন এসব সম্পত্তির পাশাপাশি গত সরকারের আমল থেকে একই স্থানে থাকা এবং প্রমোশন পাওয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, এদের মধ্যে কয়েকজন বিগত সরকারের মন্ত্রী, এমপি বা আওয়ামী লীগ নেতার নিকটাত্মীয় অথবা দলীয় ঘনিষ্ঠতার কারণে সুবিধা পেয়েছেন।

এই কর্মকর্তাদের সুরক্ষায় যশোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক আলমগীর হোসেন বিশ্বাস সহায়তা করছেন বলে জানা গেছে। তাকে সহযোগিতা করছেন বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা কৃষিবিদ পরিষদের সাবেক সভাপতি এবং বর্তমান ডিপ্লোমা কৃষিবিদ পরিষদের যশোর জেলা সভাপতি তরিকুল ইসলাম।

বিভিন্ন অভিযোগপত্র এবং সাবেক কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, অতিরিক্ত পরিচালক আলমগীর হোসেন বিশ্বাস এর বিরুদ্ধে বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। বিগত সরকারবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় তিনি শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে শান্তি সমাবেশে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যার ছবি দৈনিক লোকসমাজের হাতে এসেছে। চলতি বছরের ৩ মে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দায়ের করা একটি মামলায় (৬৩৬ সিআর মামলা) তাকে ৪০ নম্বর আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই মামলায় তাকে যুবলীগ নেতা ও অর্থ যোগানদাতা হিসেবেও দেখানো হয়েছে, এবং তার ঠিকানা হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ খামারবাড়ির প্রশিক্ষণ উইং ব্যবহার করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যে, গত সরকারের আমলে খুলনা-বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের জন্য কৃষি বিভাগের দুটি প্রকল্পের (দুই দফায় ১০ বছরে প্রায় দেড় শ কোটি টাকা) প্রকল্প পরিচালক ছিলেন আলমগীর বিশ্বাস, এবং সেই সময় বিপুল পরিমাণ অর্থ তিনি নিজে ও তার বলয়ের লোকদের মাঝে সরিয়ে নিতে সক্ষম হন। একাধিক অবসরপ্রাপ্ত ও বর্তমান কর্মকর্তা এই অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন, তবে চাকরির ভয়ে তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তারা আরও জানান, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আলমগীর বিশ্বাস ছাত্রলীগ করতেন।

আরও জানা গেছে, পুরো কৃষি বিভাগ এখনও এই চক্রের নিয়ন্ত্রণে। ওই মামলায় ২২ থেকে ৪৯ নম্বর ক্রমিকের অভিযুক্ত আসামিরা সবাই কৃষি বিভাগের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী পালনের যে কমিটি হয়েছিল, তার সদস্য সচিব ড. এমদাদুল হক বর্তমানে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, যা আলমগীর বিশ্বাসদের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করছে। তাকে সহায়তা করছেন মাগুরার বাসিন্দা অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ) জাকির হোসেন বলেও সূত্রগুলো দাবি করছে।

সূত্রগুলোর তথ্যমতে, আলমগীর হোসেন বিশ্বাস যাদের রক্ষা করার জন্য কাজ করছেন, তাদের একজন দীপাঙ্কর দাস। যশোরের হর্টিকালচারে উপপরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। ১৫ বছর ধরে যশোরে আছেন এবং প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, প্রশিক্ষণ প্রকল্প নয়-ছয়, চারা ও প্রদর্শনীর বরাদ্দ ভাগাভাগিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। শহরে ৫ কাঠা জমি কিনে ৫ তলা বাড়ি করেছেন বলে জানা গেছে।

আর একজন প্রতাপ মণ্ডল। শার্শার উদ্ভিদ সংরক্ষণে অতিরিক্ত উপপরিচালক পদে কর্মরত আছেন। প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠলেও সাবেক মন্ত্রী ও এমপি বীরেন শিকদারের হস্তক্ষেপে প্রমোশন নিয়ে ডিডি অফিসে ঠাঁই হয়। যশোর নিউ মার্কেট হাউজিংয়ে ১০ তলা আবাসিকে ১৪০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট কিনেছেন বলেও সহকর্মীরা জানিয়েছেন।

আরও আছেন শ্যামল কুমার নাথ। বেনাপোল বন্দরে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উপসহকারী। ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁসের স্থান’ হিসেবে পরিচিত এই পদে বহু বছর ধরে আছেন। তার বিরুদ্ধে নারীঘটিত অভিযোগ রয়েছে এবং তার ছবিও এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে। তিনি বঙ্গবন্ধু কৃষি ডিপ্লোমা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এবং বর্তমান ডিপ্লোমা কৃষিবিদ পরিষদেরও সাধারণ সম্পাদক।

আছেন ফরহাদ হোসেন। শার্শার উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা। মণিরামপুরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলুর শ্যালক হিসেবে পরিচিত। নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।

সদর উপজেলার সাবেক কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কৃষকরা কোর্ট ফি যুক্ত করে জেলা প্রশাসকের কাছে তার বিরুদ্ধে লিখিত ৪টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। অভিযোগে কৃষকদের ঠকিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের কথা বলা হয়েছিল।

অতিরিক্ত পরিচালক (শস্য) সমরেন বিশ্বাস আওয়ামী আমলের মন্ত্রী মাগুরার বীরেন শিকদারের লোক হিসেবে পরিচিত এবং চৌগাছা সার কেলেঙ্কারির কারণে শাস্তি হিসেবে চট্টগ্রাম রেঞ্জে বদলি করা হলেও বীরেন শিকদারের প্রভাবে প্রমোশন নিয়ে যশোরের এডিডি হয়ে আসেন। শহরের কাজী পাড়ায় ৫ কাঠা জমি কিনে ৫ তলা বাড়ির মালিক হয়েছেন বলেও সহকর্মীরা জানিয়েছেন।

মাগুরার শালিখায় কর্মরত উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষক সঞ্জয় হালদার। তার বিরুদ্ধে কৃষক ঠকানো, মাঠে কাজ না করা, কৃষি যন্ত্রপাতির ভর্তুকি থেকে আত্মসাৎ এবং কীটনাশকের দোকান থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াসহ নারীঘটিত অভিযোগ করেছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। নারীঘটিত ছবিও এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে। এই চক্রের আরও কয়েকজন সদস্য হলেন চৌগাছা উপজেলার উপসহকারী পবিত্র দেবনাথ এবং ঝিকরগাছা উপজেলার নয়ানান্দ পাল, যারা মাঠে না গিয়ে অফিসে বসেই দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্প্রতি খুলনার ফুলতলা থেকে অতিরিক্ত পরিচালক আলমগীর হোসেন সদরের কৃষি অফিসার হিসেবে মোসাম্মাৎ রাজিয়া সুলতানাকে বদলি করে এনেছেন। তিনি সাবেক মন্ত্রী কুষ্টিয়ার মাহাবুবুল আলম হানিফের নিকটাত্মীয় বলে কৃষি বিভাগে প্রচারণা রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা কৃষিবিদ পরিষদের উপজেলা সভাপতি বর্তমানে সদরের নওয়াপাড়া ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা। সরকার পতনের পর তিনি বঙ্গবন্ধুকে ছেটে ফেলেন। এখন তিনি যে সংগঠনের সভাপতি সেই সংগঠনের নাম ‘ডিপ্লোমা কৃষিবিদ পরিষদ’। রাতারাতি ভোল পাল্টানো এ ডিপ্লোমা কৃষিবিদ এক সময় কৃষক দল করতেন বলে দাবি করেছেন। তার দাবি অনুযায়ী তিনি বিএসপির ছত্রছায়ায় আছেন। তরিকুল ইসলাম স্বীকার করেছেন, গত সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন ও হাজী সুমনের ছত্রছায়ায় ছিলেন। তার দাবি, ‘যশোর বিএনপির ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বকে জানিয়ে তিনি বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা কৃষিবিদ পরিষদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

তরিকুল ইসলাম বর্তমান এডি আলমগীর বিশ্বাস ও কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্যামল কুমার নাথের প্রশংসা করে তাদেরকে ভালো মানুষ দাবি করেন এবং তার কাছে উলি¬খিত কর্মকর্তাদের ব্যাপারে কোনো অভিযোগ নেই বলেও জানান।

সার্বিক বিষয়ে অতিরিক্ত পরিচালক আলমগীর হোসেন বিশ্বাস জানান, তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সব মিথ্যা। মামলার বিষয়ে তিনি সম্প্রতি শুনেছেন। অন্যদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তিনি সম্প্রতি এখানে এসেছেন এবং সবাইকে ভালোভাবে চেনেন না। তবে তিনি খোঁজ নেবেন বলে জানান, বদলি বা পদায়নে তার হয়তো সুপারিশ থাকে, তবে মূল কাজটি খামারবাড়ি থেকে হয়।