যশোরে ৩ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে ধরা পড়ল ঢাকার শীর্ষ মাদক কারবারিরা

0

মীর মঈন হোসেন মুসা ॥ ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙে যশোর শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের একটি দোতলা বাড়িতে শুরু হয়েছিল এক নাটকীয় অভিযান। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলা ঢাকা মেট্রোপলিটন ডিবি পুলিশের এই শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে আটক হয়েছে তিন দুর্র্ধষ মাদক কারবারি, যাদের মধ্যে একজন ঢাকায় দুই পুলিশ সদস্যকে গুলি করার ঘটনায় সরাসরি জড়িত।

অভিযানকালে, ধরা পড়ার ভয়ে মাদক কারবারিরা রান্নাঘরের গ্যাস সিলিন্ডারের মুখ খুলে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো মরিয়া চেষ্টাও চালিয়েছিল, যা পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তোলে। ফায়ার সার্ভিসের সহায়তায় শেষ পর্যন্ত দুটি বিদেশি পিস্তলসহ এই সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যদের আটক করতে সক্ষম হয় পুলিশ।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে ঢাকা ও যশোরের ডিবি পুলিশ যৌথভাবে ঘোপ রোডের নজরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির দোতলা বাড়ি (ব্যবসায়ী এস.এম হুমায়ুন কবীর কবুর বাড়ির পাশে) ঘিরে রেখে অভিযান চালায়। অভিযান চলাকালে আশেপাশের বাড়ির লোকজনকে সতর্ক করে বাইরে বের হতে নিষেধ করা হয়। তবে এ সময় গুলির আওয়াজ শোনা যায়, যা এলাকাবাসীর মধ্যে তীব্র আতঙ্ক তৈরি করে। পরে জানা যায়, ওই বাড়ি থেকে নজরুল ইসলামের জামাই রিপন হোসেন ওরফে বোমা রিপন, ঢাকার বাপ্পি নামে এক সন্ত্রাসী এবং কামরুল নামে আরও একজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে আগ্নেয়াস্ত্রও উদ্ধার করা হয়।

যশোর ডিবি পুলিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি ঢাকায় মাদক কারবারিদের ধরতে গিয়ে ডিএমপি ডিবি পুলিশের দুইজন সদস্য- এ.এস.আই আতিক হাসান ও কনস্টেবল সুজন- মাদক কারবারিদের ছোঁড়া গুলিতে আহত হন। এই ঘটনার অন্যতম নায়ক বাপ্পিসহ তিন অভিযুক্ত যশোর শহরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোডের ওই বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন। এই গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ডিএমপি ডিবি পুলিশের দুইজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একজন সহকারী পুলিশ সুপারসহ একটি বিশেষ টিম যশোরে আসে। তারা যশোরের ডিবি পুলিশের সহায়তায় শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত ঘোপের ওই বাড়িতে অভিযান চালিয়ে অস্ত্রসহ তিন মাদক কারবারিকে আটক করে।

আটককৃতরা হলেন, বোমা রিপন (যশোর শহরের খড়কির রবিউল ইসলামের ছেলে), বাপ্পি (সাতক্ষীরার দেবহাটার বাসিন্দা) এবং কামরুল (পরিচয় এখনো জানা যায়নি)।

অভিযানে অংশ নেওয়া যশোর ডিবি পুলিশের এসআই মো. কামাল হোসেন জানান, শুক্রবার দিবাগত রাত ২টা থেকে শনিবার ভোর ৫টা পর্যন্ত এই শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান চলে। পুলিশ প্রথমে দোতলা বাড়িটি ঘিরে ফেলে এবং নিচের গেটের তালা খুলে দেওয়ার জন্য বারবার নির্দেশ দিতে থাকে। এ সময় তারা বাড়ির ভেতর থেকে লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পান এবং বুঝতে পারেন যে, ভেতরে থাকা মাদক কারবারিরা দোতলার রান্নাঘর থেকে গ্যাস সিলিন্ডার বের করে মুখ খুলে দিয়েছেন সম্ভবত আগুন ধরিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। পরিস্থিতি বুঝে তারা তাৎক্ষণিকভাবে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেন।

একপর্যায়ে তারা বাড়ির জানালার ধারে এক ব্যক্তির হাতে পিস্তল দেখতে পান। সাথে সাথে তারা মাদক কারবারিদের অস্ত্র নিচে ফেলে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তাদের একজন হাতে থাকা গুলিভর্তি পিস্তল নিচে ফেলে দেন, যা নিচে পড়ে বিস্ফোরিত হয়। এছাড়া, মাদক কারবারিরা আরেকটি ব্যাগ নিচে ফেলে দেয়, যার ভেতর থেকে আরও একটি পিস্তল পাওয়া যায়। ভোর ৫টার দিকে পুলিশ দোতলায় গিয়ে তিনজনকে আটক করে। পরবর্তীতে ডিএমপি ডিবি পুলিশ তাদেরকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা হয়।
বাড়ির মালিক নজরুল ইসলাম, যিনি ঠিকাদারি ব্যবসা করেন, তিনি জানান, আটককৃত রিপন তার জামাই।

রিপন পুরনো বাড়ি কিনে বিক্রি করার ব্যবসা করেন। গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাপ্পি ও কামরুল নামে দুজনকে সাথে নিয়ে তার বাড়িতে আসেন রিপন। তাদের জানানো হয়েছিল, ঢাকায় গেলে রিপনকে ওই দুই ব্যক্তি সমাদর করে থাকেন এবং রাতে থাকার পর শনিবার সকালেই তারা চলে যাবেন। কিন্তু তার জামাই ওই দুজনকে নিয়ে আসার পর রাত ২টার দিকে পুলিশ তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। নিচতলায় একজন নার্স ভাড়া থাকেন। সেই নার্স ওপর তলায় এসে বিষয়টি নজরুল ইসলামকে জানান। তখন তিনি নার্সকে গেটের তালা খুলে দিতে বলেন। কিন্তু বাপ্পি নামের একজন বারবার গেটের তালা খুলে দিতে বাধা দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে গেটের তালা খুলে দিলে পুলিশ তার জামাইসহ তিনজনকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তিনি জানতে পারেন, ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনায় তাদের আটক করা হয়েছে।

নজরুল ইসলামের পুত্রবধূ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যদি গ্যাস সিলিন্ডারের মুখ খুলে আগুন ধরিয়ে দিতো, তবে হয়তো তারা সকলেই মারা যেতেন। গ্যাস সিলিন্ডারের মুখ খুলে দেওয়ায় ভয় পেয়ে তিনি চিৎকার-চেঁচামেচি করেন, আর হয়তো তার চিৎকার শুনেই নিচে থাকা পুলিশ ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিয়েছিল।

ঢাকার বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত ১৮ জুন গভীর রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ডিবি পুলিশের লালবাগ বিভাগের একটি দল কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের বিপরীত পাশে একটি প্রাইভেটকারের গতিরোধ করার চেষ্টা করে। এ সময় ভেতর থেকে মাদক কারবারিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালালে ডিবি পুলিশের এএসআই আতিক হাসানের পেটের বাম পাশে এবং কনস্টেবল সুজনের বাম হাঁটুতে গুলি লাগে। পরে তাদেরকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেই সময় ঘটনাস্থল থেকে তিন মাদক কারবারিকে আটক এবং তাদের ব্যবহৃত প্রাইভেটকারটি জব্দ করা হয়।