পহেলা বৈশাখকে সামনে রেখে ফ্যাসিস্ট সরকারের লেজুরবৃত্তি করা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রকাশ্যে

0

তহীদ মনি ॥ যশোরে পতিত স্বৈরাচারের লেজুরবৃত্তি করা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিএনপির ওপর ভর করে নতুন রূপে ফিরে আসছে। সাংস্কৃতিক চর্চা লালনের প্রাণকেন্দ্র যশোর গত ২০০৫ সাল থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত মনের পরিবর্তে দলীয় সংকীর্ণতার মধ্যে ডুবে যেতে থাকে। এ সময় সুস্পষ্ট বিভেদ তৈরি হয়। একটি পক্ষ সরাসরি বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সমস্ত কর্মকান্ডকে বৈধতা দিতে সারা বছর নানা গুণগানে ব্যস্ত থাকতো।

এমনকি বিভিন্ন পদ-পদবী দখলসহ রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা গ্রহণ কওে তারা। সে সময় আওয়ামী ঘরনার বাইরে কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ ছিল না। যশোরের প্রায় সবগুলো সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রধান কাজ ছিল আওয়ামী তোষণ। বিশেষ করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে চলতো এ কাজ। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর গত প্রায় ৯ মাস গা বাচিয়ে চলা প্রতিষ্ঠানগুলো আবার বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সরব হওয়ার চেষ্টা করছে। আওয়ামী খোলস ফেলে বিএনপি ও প্রয়াত জননেতা তরিকুল ইসলাম পরিবারের গুণকীর্তনে নেমেছে। আগ বাড়িয়ে প্রচার করছে বিএনপির সাথে তাদের আলোচনা হয়েছে। নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে ও পদ -পদবী ফিরে পেতে পহেলা বৈশখকে কাজে লাগাতে রীতিমত কোমর বেঁধে নামছে তারা।

জুলাই বিপ্লবের আগে নির্বিচারে গুলি, হত্যা, ক্রসফায়ার, একই ব্যক্তিকে দিনের পর দিন জেল জুলুম হুলিয়ার মধ্যে কাটাতে হলেও এসব অন্যায়- অপরাধের বিরুদ্ধে কোনো সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ হয়নি যশোরে। শেখ মুজিব, তার দল, তার পরিবারের সদস্যদের জন্ম- মৃত্যু দিবস পালন, ভাষণ মুখস্ত, রাসেলের জীবনী, বত্রিশের ক্রন্দন এমন অসংখ্য দিবস ও সে উপললক্ষে গান কবিতা পাঠ, নাটক প্রদর্শন, মানববন্ধন, প্রতিবাদী সমাবেশ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সংগঠনগুলো। প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থী, শিল্পী, কলাকুশলী ও নেতৃত্ব সবাই ছিল শেখ হাসিনা সরকার ও তার দোসরদের মনোরঞ্জন আর তোষামোদের ব্যস্ত। বছরের পর বছর নির্যাতিতদের পক্ষে গড়ে ওঠেনি সাংস্কৃতিক কোনো আন্দোলন। ফলে গত বছর সরকার পতনের পর এক প্রকার রুটিং কাজের বাইরে খুব একটা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ছিল না যশোরে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ছিল এক প্রকার নিষ্ক্রিয়।

সুধিজনের মতে, যশোর বা সারাদেশ যেখানের হোক না কেনো, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড এমন নির্লজ্জ ও দলীয় হতে পারে এটা তাদের কল্পনার মধ্যেও ছিল না। সব ধর্মের, সব দলের, সব বয়সের মানুষের জন্যেই মিলিত প্রাণের স্পন্দন হরেক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড। অথচ গত অন্তত ১০ বছর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ছিল জাতিকে বিভাজিত করার প্রচেষ্টা মাত্র। বাম ও আওয়ামী ধারার সংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত করেছে। নামসর্বস্ব কয়েক প্রতিষ্ঠান সাংস্কৃতিক চর্চা ছাড়াই শুধু আওয়ামী বিরোধীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে সময় কাটাতো।

যশোর বিবর্তনের সভাপতি নওরোজ আলম খান চপল এ প্রসঙ্গে জানান, অতীতে যশোরে রাজনীতির সাথে সংস্কৃতির মেলবন্ধন ছিল। সাবেক মন্ত্রী ও রাজনীতিক খালেদুর রহমান টিটো, রাজনৈতিক নেতা চৌধুরী শহিদুল ইসলাম নয়ন, বিমল রায় চৌধুরী, অ্যাড. জাফর সাদিক, আব্দুল হাসিব(চারুপীঠ প্রতিষ্ঠাতা), আলী আকবরসহ অনেক নেতা ও সুধীজন সাংস্কৃতিক অঙ্গন পেরিয়ে রাজনীতিতে জীবন গড়েছেন। কেউ কেউ রাজনৈতিক জীবনকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে নিয়ে গেছেন। তাদের দলীয় পরিচয় ও মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু যশোরে সাংস্কৃতিক অঙ্গণে তার নষ্ট প্রভাব ছিল না। বর্তমান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক নার্গিস বেগম ৪০ বছর ধরে সাংস্কৃতিক সংগঠন চালাচ্ছেন। সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তরিকুল ইসলাম সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে রাজনৈতিক জীবন সর্বত্রই ভিন্ন চেতনা ও উদারতার পরিচয় দিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, একবার বিএনপি আমলে যশোরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সরকার বিরোধী কিছু কর্মকাণ্ড হলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাপাচাপি ছিল। এ সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেতা তরিকুল ইসলামের কাছে এটি বন্ধ করার প্রস্তাবনা নিয়ে গেলে তিনি সরাসরি জানান, সাংস্কৃতিক প্রবাহকে নিজস্ব গতিতে চলতে দাও, ওখানে হাত দেওয়ার দরকার নেই।

চপল আরও জানান, গত কয়েক বছর যশোরের রাজনৈতিক -সাংস্কৃতিক পরিবেশ তার চরিত্র হারিয়েছে। ৫ আগস্টের পর অস্থিরতা, নিরাপত্তা, সামাজিক কারণ, রাজনৈতিক কারণে সাংস্কৃতিক চর্চায় বেশ কিছুটা ভাটা পড়ে। ইতোমধ্যে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, জেলা বিএনপি সভাপতি অ্যাড. সাবেরুল হক সাবু ও সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খোকনসহ নেতৃবৃন্দের সাথে যশোরের সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দের সভা হয়েছে। তারা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি ও নিজস্ব গতিতে চালু রাখার পরামর্শ দিয়েছেন, সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন।

উদীচীর যশোর জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান খান জানান, তাদের সংগঠন গত ৬ মাসে রুটিং কর্মকাণ্ড করছে। বাংলা নববর্ষ সম্মিলিতভাবে পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যেভাবে অন্য বছর পালিত হয় এবারও সে রকম পালনের আশা আছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, যশোরে যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ছিল তার কিছুটা হলেও ব্যত্যয় ঘটেছে। সংস্কৃতির প্রকৃত ধারা বাদ দিয়ে দীর্ঘ সময় চলেছে আওয়ামী বন্দনা।

যশোর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও তির্যক যশোরের সভাপতি দীপঙ্কর দাস রতন জানান, এটা অস্বীকার করা যাবে না গত সময়ে সবই সঠিক ছিল। কেউ কেউ ফরমায়েসী কর্মকান্ড পালন করেননি বা চাপ ছিল না এটাও বলা যাবে না। এজন্যে ৫ আগস্টের পর যশোরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কিছুটা স্তিমিত ছিল।
তবে তিনি বড় একটি সুখবর দিলেন। তার ভাষায়, যশোরে অতীতে এমন কোনো সভা হয়নি। সম্প্রতি একটি বড় দলের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক হয়েছে।

এর আগে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক নার্গিস বেগমের কাছে আমরা গিয়েছিলাম। পরে তার নির্দেশে বিএনপির নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসেন। খুবই ফলপ্রসু ঘটনা। যশোরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন করে উজ্জীবিত হওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়েছে।