শাপলা চত্বরের দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে যশোরের শহীদ হাফেজ নান্নুর পরিবার

0

তহীদ মনি ॥ ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে অনেকের সাথে শহীদ হন যশোরের খড়কি এলাকার শহীদ হাফেজ মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু। এলাকাবাসী যাকে নান্নু হুজুর হিসেবে চিনতেন। ওই বছরের ১১ মে পুলিশ পাহারায় তার লাশ যশোরের কারবালা কবরস্থানে দাফন করা হয়। সে দিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে শহীদ হাফেজ নান্নুর পরিবার। নির্মম ওই ঘটনায় অভিভাবকহীন হয়ে পড়া অসহায় পরিবারটির পাশে এসে দাঁড়ায়নি কেউ।

যশোর শহরের খড়কি কবরস্থানপাড়ার বাসিন্দা হাফেজ মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু। ৫ মে’র রাতে পুলিশ পা দিয়ে পাড়িয়ে এ হাফেজকে গুলি করে। কাকরাইল মসজিদের পাশে গুলি করার পরও চিকিৎসা করার সুযোগ দেয়নি তারা। এক পর্যায়ে মৃত ভেবে চলে যায় পুলিশ। সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় বরিশালের একজন গাড়িচালক রক্তের মধ্যে নিঃস্তেজ মানুষ পড়ে থাকতে দেখে এগিয়ে যান এবং তিনিই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। অবশ্য নান্নু হুজুরের আর জীবতভাবে ঘরে ফেরা হয়নি। তার লাশ দাফনেও পুলিশ নানাভাবে ঝামেলা করেছিল।

পেশায় দর্জি হাফেজ নান্নুর পরিবার এখন অভিভাবকহীন-অর্থহীন। মাথার উপর ঠাঁই নেই। ৫ সন্তান আর স্ত্রী বেঁেচ আছেন অসুখে, বিনা চিকিৎসায় অন্যের দয়ায়। তারা এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চান, মানুষের দয়ায় নয়-পরিবারের ভরণ পোষণের মতো কাজ চান, মারাত্মক অসুস্থ শহীদ নান্নু হুজুরের স্ত্রী ও ছোট সন্তান আবু হানজালার চিকিৎসা করাতে চান। বাড়ি বা জমি না থাকায় মাথার উপর একটু ছাউনি চায় পরিারটি।

হাফেজ মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নুর স্ত্রী-সন্তান, প্রতিবেশী ও তার বর্তমানে জীবিত একমাত্র ভাই ও মৃত বড় ভাইয়ের সন্তানের সাথে কথা বলে জানা গেছে সেদিনের অজানা অনেক ঘটনা।

২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে অন্যদের মত হাফেজ মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নুও শাপলা চত্বরে গিয়েছেলেন। বিদ্যুৎ বিছিন্ন করে মাঝরাতে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর তান্ডবের মুখে টিকতে না পেরে হাফেজ নান্নু কাকরাইল মসজিদের পাশে চলে আসেন। সেখানে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। সারা শরীরে ছাররা গুলি লাগে।

নিথরভাবে রক্তের মধ্যে পড়ে ছিলেন তিনি। ওই সময় পথচারী এক গাড়ি চালক অন্যদের সহায়তায় নান্নুকে হাসপাতালে নেয়ার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে কিছু সময়ের জন্যে জ্ঞান ফেরে নান্নুর, তিনি ওই সহায়তাকারীকে বাড়ির মোবাইল নম্বর দেন। ওই রাতেই উদ্ধারকারী বাড়িতে ফোনে জানান, ‘গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করেছেন।’ ওই উদ্ধারকারী নান্নুকে প্রথমে ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে

পরিবারের পক্ষে ঢাকায় থাকা কয়েকজন হাসপাতালে পৌঁছে আল মানার ও পরে মিলিনিয়াম হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসা নিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধার মুুখে পড়তে হয়। ইতোমধ্যে ৬ মে সন্ধ্যায় মেজো মেয়ে ও নান্নুর স্ত্রী সেখানে পৌঁছান। পুলিশের বাঁধার মুখে চিকিৎসা ছাড়াই ১০ মে বিকেলে তাকে নিয়ে ঢাকা থেকে যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় পরিবার। তাদের বহনকারী গাড়িটি পাটুরিয়া ফেরিঘাটে পৌছানোর পর তার মৃত্যু হয়। শেষ পর্যন্ত লাশ পৌঁছে বাড়িতে।

এ সময় যশোর পুলিশের পক্ষ থেকে বাড়ির কয়েকজনের উপস্থিতিতে গোসল না করিয়েই দাফনের জন্যে চাপ দেয়া হয়। তবে এলাকাবাসীর তোপের মুখে পরদিন সীমিত আকারে জানাজা নামাজের অনুমতি দেয় কোতোয়ালি পুলিশ।

পরের দিন ১১ মে সরকারি এম এম কলেজ মাঠে সকাল ৯টায় জানাজা সম্পন্ন হয় এবং ১০টার মধ্যে দাফন শেষ করতে হয়। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে জানাজায় বিপুল সংখ্যক মানুষ উপস্থিত হয়। শেষ হয় নান্নু হুজুরের ইতিহাস। কিন্তু মাথার উপর থেকে অভিভাবক ও একমাত্র উপার্জনের ব্যক্তিটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে পরিবার। শুরু হয় তাদের দুঃসহ যন্ত্রণার অধ্যায়।

শহীদ হাফেজ নান্নুর ছোট ছেলে আবু হানজালা জানায়, মাত্র ৫ বছর বয়সে সে তার পিতাকে হারিয়েছে। তার বয়সী বন্ধুরা যখন পিতার হাত ধরে চলাচল করতো তখন তার খুব কষ্ট হতো যে, তার হাত ধরার মতো পিতা নেই। সে এই হত্যার বিচার চায়। শুধু তার পিতা নয়, তার পিতার মতো আরো যাদেরকে এভাবে চলে যেতে হয়েছে সব হত্যা ও নির্যাতনের বিচার চান তিনি।

নান্নুর ছোট মেয়ে উম্মে সাদিয়া জানান, এই দিনগুলো কখনোই ভোলা যাবে না। তার পিতা শহীদ হওয়ার পর কয়েকবার ঈদ ও অন্য সময়ে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে কিছু নগদ টাকা, খাদ্য ও পোশাক তারা পেয়েছেন। তাদের চাচা ও অন্যরাও কিছু সহায়তা করেছেন। একটা সময় সবই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এত বড় সংসার, আয়ের জন্যে কেউ নেই। বড় ভাই আবু হুজাইফাকে পড়াশুনা ছেড়ে ঢাকায় একটা কাপড়ের দোকানে কাজ করতে হয়। এখনো বাড়িতে তেমন কিছু দিতে পারেন না। নিজের খরচটা কোনোমতে চলে। তিনি নিজে ফাজেল পরীক্ষার্থী ছিলেন, কিন্তু পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। তারা ৩ বোনই বিবাহিতা। বড় বোন ২ সন্তাসনহ তালাকপ্রাপ্ত। এখন তিনি অসুস্থ। মেজো বোন স্বামীসহ ২ সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকেন। সরকারি এম.এম কলেজে মেজো বোন উম্মে সুমাইয়া পড়তো অনার্স তৃতীয় বর্ষে, পিতা না থাকায় বিয়ে করতে হয়। তার স্বামীর আয়ে কোনোমতে তাদের সংসার চলে। পিতার মৃত্যুর মাসখানেকের মধ্যে ছোটভাই আবু হানজালা ব্রেন স্ট্রোক করে। সেই থেকে তাকে চিকিৎসা দিতে হয়। এখন একটা মাদ্রাসায় পড়ছে।

দীর্ঘদিন তার মা শাহনাজ বেগম কিডনি, লিভার, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে শয্যাশায়ী। এক পর্যায়ে তাদের খড়কির পৈত্রিক বাড়ির অংশটুকু বড় চাচার কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। সে সময় ৩ লাখ টাকার দেনা শোধ করে অবশিষ্ট টাকায় আরবপুর এলাকায় কয়েক শতক জমি কিনলেও তার নাম পত্তন ও দখল কোনোটাই হয়নি। বিভিন্নভাবে প্রাপ্ত কিছু সহযোগিতা চিকিৎসা খরচ ও পরিবারের ভরণ পোষণে চলে গেছে। বাড়িটি বিক্রি হলেও এখনো সেখানেই থাকেন তারা। এখন বড় চাচার ছেলে ওই বাড়িতে থাকতে দিতে চায় না। ইতোমধ্যে প্রস্তাব দিয়েছেন, ঘর ছেড়ে আপাতত কোথাও ভাড়ায় উঠলে কিছুদিন তাদের ঘরভাড়া বহন করবেন সেই চাচাতো ভাই পুলিশ লাইন টালিখোলা মাদ্রাসা শিক্ষক মারুফ সিদ্দীকি। কিন্তু অসুস্থ মা-ভাইকে নিয়ে অন্য কোথাও যেতেও সাহস পাচ্ছে না তারা।

মেজো বোন উম্মে সুমাইয়া জানান, সম্প্রতি জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলামের কাছে তার গিয়েছিলেন। জেলা পরিষদের সিইও মো. আসাদুজ্জামান তাদেরকে নগদ ৫ হাজার টাকা, কিছু কাপড় ও একটি সেলাই মেশিন সহায়তা দিয়েছেন। তবে তাদের দরকার একটি কাজের বন্দোবস্ত এবং মাথার উপর একটু ছাউনি।

তাদের মায়ের শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ জানিয়ে তিনি আরও বলেন, নিয়মিত চিকিৎসার জন্যে বড় অংকের টাকার দরকার অথচ তাদের সংসারে এক প্রকার কোনো আয়ই নেই।

তাদের প্রতিবেশী মেহেদী হাসান মিন্টু শহীদ হাফেজ নান্নুকে খুবই ভালো ও নিরীহ মানুষ উল্লেখ করে বলেন, আত্মীয় ও প্রতিবেশীকে না জানিয়ে দুই তিন ঘণ্টার মধ্যে কবর দেয়ার পুলিশি কড়াকড়ি থাকলেও পরদিন কীভাবে এম এম কলেজ মাঠে জানাজা শেষে সকাল ১০টার মধ্যে কবর দিয়ে ছিলেন সে সব স্মৃতি ও পরিবারটির বর্তমান দুরাস্থার চিত্র তুলে ধরেন।

পার্র্শ্ববর্তী জামিয়া নূরিয়া মাদ্রার শিক্ষক হাফেজ মো. আয়াতুল্লাহও তার দেখা ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন কথা বলেন। তিনি দাবি করেন, হাফেজ নান্নুর মতো পরিশ্রমী, ভদ্র ধার্মিক লোক কমই দেখেছেন। তিনি ও মিন্টু সবাই এই নারকীয় হত্যার বিচার চান, ইন্ধনদাতার শাস্তি চান।

শিক্ষক মারুফ সিদ্দীকি তার চাচা নান্নুর পরিবারের দুর্দশার কথা স্বীকার করে জানান, তারাও খুব বেশি স্বচ্ছল নন। তার ভাই বোন ও চাচি ভালো থাকুক এ জন্যে বাড়ি কেনার পরও বছরখানেক থাকতে দিয়েছেন, প্রয়োজনে আরো কয়েক মাসের ভাড়া বহন করতে চান কিন্তু তার পরিবারকেও তো চলতে হবে।

উম্মে সাদী, সুমাইয়াদের একমাত্র জীবিত চাচা হাশিমপুরের হাফিজুর রহমান তার ভাইয়ের স্ত্রী-পরিবারের দুঃসহ দিনগুলোর কথা উল্লেখ করে বলেন, তাদের যতটুকু সামর্থ্য ছিল তা তারা করেছেন, ওই সময় হেফাজতে ইসলামসহ আরো কয়েকটি সংগঠন কিছু সহায়তা করেছে।