যবিপ্রবিতে বরখাস্ত শিক্ষককে নিয়ে তর্ক থেকে সংঘর্ষ, আহত- ৮

ক্যাম্পাসে মিছিল মিটিং গণজমায়েতের উপর নিষেধাজ্ঞা

0

যবিপ্রবি সংবাদদাতা ॥ আওয়ামীপন্থী শিক্ষক কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গালিবকে সাময়িক বরখাস্তের বিষয় নিয়ে তর্ক নিয়ে সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) ক্যাম্পাস। শুক্রবার রাতে দফায় দফায় সংঘর্ষে আটজন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। গতকাল শনিবার ক্যাম্পাস ও যশোর শহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে পৃথক কর্মসূচি পালিত হয়েছে। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্যাম্পাসে সব ধরনের মিছিল মিটিং সভা সমাবেশ গণজমায়েত না করার নির্দেশ দিয়েছে।

শুক্রবার যবিপ্রবির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসয়েন্স (এফএমবি) বিভাগের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় এফএমবি ও ইএসটি বিভাগের শিক্ষার্থীরাও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এ ঘটনায় অন্তত আটজন শিক্ষার্থী আহত হন। শিক্ষার্থীদের নিবৃত করতে গিয়ে উচ্চ রক্তচাপে অসুস্থ হয়ে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন প্রক্টর ড. মো. আমজাদ হোসেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শুক্রবার রাতেই পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। এ ঘটনায় পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মী ও সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটিকে আগামী ৭ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

শুক্রবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে একটি চায়ের দোকানে এ ঘটনার সূত্রপাত হয়। জানা যায়, সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে একটি চায়ের দোকানে লিফট দুর্নীতি ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে বরখাস্ত অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গালিবকে নিয়ে আলোচনা করছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যশোর জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক সাদেকা শাহনী উর্মি ও তার বন্ধুরা। এসময় উর্মির সাথে সিএসই বিভাগের স্বপন নামের এক শিক্ষার্থীর তর্ক হয় ও ধাক্কা লাগে। এ ঘটনায় উর্মি ও সঙ্গীরা প্রতিবাদ করলে সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে বাকবিতন্ডা হয়। পরবর্তীতে উর্মির বন্ধু ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের যুগ্ম আহ্বায়ক হাবিব আহমেদ শান সিএসই বিভাগের বরখাস্ত শিক্ষক সৈয়দ গালিবকে নিয়ে মন্তব্য করে। এসময় ওই বিভাগের শিক্ষার্থীরা শানের উপর চড়াও হন। এরপর উর্মি ও শান প্রক্টর অফিসের দিকে যান। এসময় সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের দিকে তেড়ে গেলে উর্মি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দলোনের কর্মীদের ডেকে ঘটনাস্থলে জড়ো করেন। এরপরই দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উর্মিকে ধাক্কা দেওয়ায় প্রশাসনিক ভবনের নিচে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ জানালে সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে তাদের হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের যুগ্ম সদস্য সচিব এস এম দোলেনুর করিম ও এফএমবি বিভাগের শিক্ষার্থী মাঞ্জুরুল হাসান আহত হন। পরবর্তীতে সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীরা খেলার মাঠে ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা মুন্সী মেহেরুল্লাহ হলের সম্মুখ সড়কে অবস্থান নেন। এসময় দুপক্ষের মধ্যে থেমে থেমে সংঘর্ষ ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।

\বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের যুগ্ম আহ্বায়ক সাদেকা শাহানী উর্মি বলেন, আমি ও আমার ব্যাচমেট শানসহ কয়েকজন দোকানে বসে চা খাচ্ছিলাম। তখন সিএসই বিভাগের স্বপন হাসাহাসি করতে করতে আমার গায়ের ওপর এসে পড়ে। আমি বিরক্ত হলে স্বপন ও তার এক বন্ধু স্যরি বলে। এরপর ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে সিএসইর কয়েকজন শিক্ষার্থী হাবিবকে ডাকে। এটা দেখে আমি আমার বন্ধু ও ছোট ভাইদের ডেকে জড়ো করি। এরপর সংঘর্ষ শুরু হয়।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যশোর জেলার যুগ্ম সদস্য সচিব ও এফএমবি বিভাগের শিক্ষার্থী এস এম দোলেনুর করিম বলেন, আমি উর্মির ফোন পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে দেখি আমাদের সহযোদ্ধা শানকে সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীরা ঘিরে রেখেছে। আমি বিষয়টি সমাধান করতে গেলে তারা আমার গায়ে হাত তুলে এবং আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলে তুই কথা বলার কে? এ ঘটনা আমার বিভাগের শিক্ষার্থীরা জানতে পেরে ছুটে আসে। এব আমাকে কেন মারা হয়েছে এটা তাদের কাছে জানতে চায় তখন তারা আমাদের উপর হামলা চালিয়ে আমার বন্ধু মানজুরুলকে আহত করে।

সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর বলেন, সন্ধ্যায় চায়ের দোকানে আমাদের এক ভাইয়ের হাত ভুলবশত উর্মি আপুর গায়ে লেগে যায়। তখন স্যরি বলার পরও তার বন্ধু ইএসটি বিভাগের শিক্ষার্থী শান আমাদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। এজন্য আমরা প্রক্টর স্যারের কাছে বিচারের জন্য যাচ্ছিলাম। তখন শান ও এফএমবি বিভাগের দলিনুর এসে আমাদের সাথে বিশৃঙ্খলা করে এবং লিমনকে ধাক্কা দিতে থাকে। এসময় তারা আমাদের বিভাগের তিনজন ভাইকে মেরে গুরুতরভাবে আহত করে। তারা আমাদের উপর ইট পাটকেল ছুঁড়ে মারে। আমরা তাদের উপর কোনো হাত উঠাইনি আমরা শুধু তাদের আক্রমণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছি।
যবিপ্রবি প্রক্টর ড. মো: আমজাদ হোসেন বলেন ‘রাতেই সব সহকারী প্রক্টর একসঙ্গে হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের মিছিল-মিটিং, মানববন্ধন-সমাবেশ করা যাবে না। করলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আরও বলেন, ‘আমার ধারণা, এই সংঘর্ষের নেপথ্যে গালিবের সাময়িক বরখাস্তের বিষয়টি থাকতে পারে। তা না হলে শুধু চায়ের দোকানে দুই শিক্ষার্থীর সঙ্গে তুচ্ছ কথা-কাটাকাটির ঘটনায় ক্যাম্পাসে এত বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটার কথা নয়।

এদিকে সংঘর্ষে আহত ৪ শিক্ষার্থী গুরুতর অবস্থায় যশোর ২৫০শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। হাসপাতালে ভর্তিকৃতরা হলেন-যবিপ্রবির সিএসই ২য় বর্ষের ছাত্র ফাহিম ফয়সাল (২৩)। তিনি সিরাজগঞ্জ শহর এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলামের ছেলে। একই বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র তফিকুল ইসলাম (২৪) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মনোকষা গ্রামের বদিউর ছেলে। তিনিও সিএসই-২য় বর্ষের শিক্ষার্থী। একই শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ফরিদপুরের মধুখালীর সুকুমার দাসের ছেলে ইমন দাস সৈকত ও পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার বিলবিলাস গ্রামে মনিরুল ইসলামের ছেলে রাফিন আফসার (২১)। এছাড়াও উত্তেজনায় অসুস্থ হয়ে পড়া প্রক্টর ড. মো: আমজাদ হোসেনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আব্দুল মজিদ গতকাল হাসপাতালে আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে আসেন।

এদিকে এ ঘটনার জেরে শনিবার বিকেলে প্রেসক্লাব যশোরে দু’দল শিক্ষার্থী পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন করেছে। উভয়পক্ষ তাদের নিজ নিজ অবস্থান সাংবাদিকদের অবহিত করেন। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোর জেলা কমিটির আহ্বায়ক রাশেদ খান উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে রাশেদ খান উভয়পক্ষ একসাথে বসিয়ে মিমাংসার চেষ্টা করেন। সন্ধ্যায় তিনি জানান, দুই পক্ষের মধ্যে মিমাংসা হয়ে গেছে।
এক পক্ষের সংবাদ সম্মেলনে যবিপ্রবি’র কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সাদেকা শাহানী উর্মী ও তার সহপাঠীরা উপস্থিত ছিলেন।

পরে সিএসই ডিপার্টমেন্টের জসিম উদ্দিন, রাকিব হাসান সিহাবসহ বেশ কয়েকজন পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন।

বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোরের আহ্বায়ক রাশেদ খান বলেন, যবিপ্রবির ঘটনাটি দু:খজনক। উভয়পক্ষেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন। তাদের সবাইকে নিয়ে আমরা বসেছি। উভয়পক্ষের মধ্যে মীমাংসা হয়ে গেছে।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শনিবার এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাম্পাসের মধ্যে সকল ধরণের মিছিল, মিটিং, সভা, সমাবেশ ও গণজমায়েত না করার জন্য সকলকে নির্দেশ দিয়েছে। নির্দেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে প্রক্টর আমজাদ হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী রিজেন্ট বোর্ড থেকে একটা তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি তদন্তের মাধ্যমে বের করবে কারা কারা স্বৈরাচারের দোসর বা সুবিধাভোগী। এই রিপোর্ট পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।