ডামি নির্বাচনে শুরু গণ-অভ্যুত্থানে বিদায় ২০২৪

0

স্টাফ রিপোর্টার, লোকসমাজ, ডিসেম্বর ৩১॥ সময়ের পরিক্রমায় আজ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দের বিদায়ের দিন। বছরটি অঘটন-ঘটনে ভাস্বর হয়ে থাকবে দেশবাসীর মননে। ডামি নিবাচন হিসেবে সমালোচিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২৪ সাল আর বিদায় নিচ্ছে গণ-অভ্যুত্থানে দেড় দশক ধরে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও পলায়নের মধ্যে দিয়ে। একই সাথে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন নামে নতুন একটি সরকার। পতিত সরকারের দলীয়করণে সীমাহীন নির্যাতনের কারণে জনরোষের মুখোমুখি হতে হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলেছে বছরজুড়েই। কখনও অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি, আবার কখনও বাজার থেকে পণ্য উধাও। এভাবেই সিন্ডিকেট করে ভোক্তাদের পকেট কেটেছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এছাড়া বছরের শেষ মুহূর্তে রাজধানীতে সুরক্ষিত সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে বাংলাদেশ এবছর।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন
বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। জুলাই মাসে কোটা ইস্যুতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন গড়ায় প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে। জোর খাটিয়েও আন্দোলন দমাতে না পেরে অবশেষে সাত মাস না যেতেই প্রধানমন্ত্রীর গদি ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনাকে। শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জুলাইয়ের শেষ দিকে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার তুমুল এ গণ আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে চলে যান। এর আগে এ আন্দোলন দমাতে গিয়ে ব্যাপক সহিংসতা ঘটনা ঘটে। এত বিপুল হতাহত হয়। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়।
অন্তর্র্বতী সরকার দায়িত্ব নিয়ে হতাহতের এ তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়। পরে জুলাই-আগস্টে নিহত এবং আহতদের তালিকা তৈরি করতে ১৫ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটি গত ২৯ সেপ্টেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ৭১৭ জনের নিহতের তালিকা প্রকাশ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম-এমআইএস। পরে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৮৫৮ জন নিহত এবং সাড়ে ১১ হাজার আহত ব্যক্তির প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা প্রকাশ করে ‘গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল’। ২১ ডিসেম্বর এ বিশেষ সেলের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব খন্দকার জহিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য তুলে ধরেন।

সংঘাত-সহিংসতায় বছর শুরু
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগের সাজানো এই নির্বাচন ঘিরেও বেশ কিছু সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ভোটকেন্দ্রিক ৩৪৫টি সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এতে নিহত হন সাতজন। আহত হন পুলিশের সদস্যসহ সাড়ে চার শতাধিক ব্যক্তি।
ওই নির্বাচনের দুই দিন আগে ৫ জানুয়ারি যশোরের বেনাপোল থেকে ঢাকায় আসা ট্রেন বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন দেওয়া হয়। এতে দুই নারী, এক শিশুসহ অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়। ওই আগুন কারা দিয়েছিল, তা এখনো শনাক্ত হয়নি।
কলকাতায় সংসদ সদস্য হত্যা
এই বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল কলকাতায় বাংলাদেশের তৎকালীন সংসদ সদস্য (ঝিনাইদহ-৪) আনোয়ারুল আজীমকে নৃশংসভাবে হত্যা। ১২ মে ভারতে গিয়ে পরদিন রাতে কলকাতার একটি বহুতল আবাসিক ভবনে তাঁকে হত্যার পর মরদেহ টুকরা টুকরা করা হয়। পরে কলকাতার দুটি স্থান থেকে কিছু হাড় ও মাংস উদ্ধার করা হয়।
ঘটনার সাত মাস পর ২০ ডিসেম্বর কলকাতার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আনোয়ারুলের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌসের (ডরিন) ডিএনএ নমুনার সঙ্গে উদ্ধার হওয়া ওই দেহাবশেষের ডিএনএর মিল পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছিল, দেশে খুনের পরিকল্পনা করে সেটা বাস্তবায়ন করা হয় কলকাতায়। এই ঘটনায় কলকাতায় এবং সেখান থেকে দেশে ফিরে আসা কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এমনকি ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককেও গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এই ঘটনায় ঢাকায় ও কলকাতার আদালতে একাধিক আসামি জবানবন্দি দিলেও তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
বেইলি রোডে আগুনে ৪৬ মৃত্যু
২০২৪ সালে বড় ধরনের ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্যে ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি ভবনে (সাততলা) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড অন্যতম। এতে নারী, শিশুসহ ৪৬ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ওই ভবন দীর্ঘদিন ধরেই অগ্নিঝুঁকিতে ছিল। এটাকে নেহাত দুর্ঘটনা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার নির্মম উদাহরণ হিসেবে দেখছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। যদিও ইমারত বিধিমালা ও অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত নির্দেশনা না মানার জন্য তদারক সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
চট্টগ্রামে আইনজীবী খুন
চট্টগ্রামে আইনজীবী ও সহকারী সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম (৩৫) হত্যার ঘটনা ছিল বছরের আরেক আলোচিত ঘটনা। ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের সঙ্গে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারীদের সংঘর্ষের সময় সাইফুলকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সংঘর্ষে পুলিশের ১০ সদস্যসহ আহত হন অন্তত ৩৭ জন। এ ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন মহল থেকে ইসকনকে উগ্রবাদী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে নিষিদ্ধের দাবি ওঠে।
বছরের শেষে সাত খুন, সচিবালয়ে আগুন
বছরের শেষে এসে ২৩ ডিসেম্বর চাঁদপুরের হাইমচরে সারবাহী জাহাজে সাত খুনের ঘটনা ঘটে। জাহাজের কর্মীদের ঘুমানোর কক্ষে কক্ষে পড়ে ছিল দেহগুলো। পরে জাহাজের কর্মী আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফানকে (২৬) গ্রেফতার করা হয়। এরপর র‌্যাব জানায়, নিয়মিত বেতন-ভাতা ও ছুটি না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে আকাশ মণ্ডল এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন।
সর্বশেষ ২৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও আসবাব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এটা দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, সে প্রশ্ন সামনে এলেও তদন্ত শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত সেটা স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
শুরুতে দমন-পীড়ন, শেষে ভঙ্গুর অবস্থা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর
স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের সময় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে খেয়ালখুশিমতো ব্যবহার করা হয়েছে। যার ভয়ংকর রূপ দেখা গেছে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পুলিশ না থাকায় তিন দিন (৬-৮ আগস্ট) দেশের থানাগুলোর কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ৯ আগস্ট থেকে সশস্ত্র বাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সহায়তায় পর্যায়ক্রমে থানাগুলো চালু হতে থাকে। পুলিশি কার্যক্রম স্বাভাবিক ধারায় ফিরতে লেগে যায় কয়েক মাস। এ সময়ে আলোচিত সন্ত্রাসীরা জামিনে বেরিয়ে আসেন। দেশে তৎপরতা শুরু করেন তালিকাভুক্ত আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। সক্রিয় হতে থাকে আরও অনেক পেশাদার অপরাধী। এসব কারণে ৫ আগস্টের পর ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা বাড়তে থাকে। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যৌথ বাহিনীর তৎপরতা থাকলেও বছরের শেষে এসেও তা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেনি।
নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি
কাঁচা মরিচ, চিনি, আলু, চাল, গরু ও মুরগির মাংস, তেল, ডিম, ফল থেকে শুরু করে হালের পেঁয়াজ; বছরজুড়ে এসব পণ্য ছিল ব্যাপক আলোচনায়। এসব পণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার শুল্ক হ্রাস করে বিদেশ থেকে আমদানির পথেও হেঁটেছে। অক্টোবর মাসে প্রায় সব সবজির দাম উঠে যায় ১০০ টাকার ওপরে। নভেম্বরের শুরুতে সেটি কিছুটা কমে আসলেও শেষদিকে ফের বাড়ছে দাম। শীতের সবজিতেও নাগালে আসছে না বাজার। নানা অজুহাতে বাড়ানো হচ্ছে দাম।
চলতি বছরের শুরু থেকে লাগামহীন আলু বাজার। বছরের মাঝামাঝি দাম কিছুটা কমলেও অক্টোবরের শেষ দিকে এসে ফের ঊর্ধ্বমুখী আলুর বাজার।
পুরো বছর জুড়েই ওঠানামার মধ্যে ছিল পেঁয়াজের বাজার। মূলত ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করায় দামে প্রভাব পড়ে। তবে গত ৪ মে পেঁয়াজ রফতানির নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় দেশটি। এতে দাম কিছুটা কমে আসে। জুন-জুলাইতে এসে ফের অস্থির হতে থাকে বাজার। বছরের শুরুতে সেভাবে না বাড়লেও অস্থির ছিল দেশের ভোজ্যতেলের বাজার। রোজায় আরও বাড়ে সে অস্থিরতা। এরপর তেলের বাজারে দেখা যায় কিছুটা স্থিতিশীলতা। নভেম্বরের শুরুতে এসে ফের অস্থিরতা শুরু হয় তেলের বাজারে। বোতলজাত তেলের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা যায় খোলা ভোজ্যতেল। বাজারে সবচেয়ে বেশ উত্তাপ ছড়িয়েছে কাঁচা মরিচ। কোরবানির ঈদের ঠিক আগমুহূর্তে দেশের বাজারে হঠাৎ করেই বেড়ে যায় মরিচের দাম। দেশের কোথাও কোথাও প্রতি কেজি মরিচ বিক্রি হতে দেখা যায় ৪০০-৫০০ টাকা পর্যন্ত। এরপর নভেম্বর পর্যন্ত দফায় দফায় ওঠানামা করে দাম। সারাবছর তেমন একটা না বাড়লেও কোরবানির ঈদে মাত্রাতিরিক্ত বাড়ে মসলার দাম। সে সময় প্রতি কেজি এলাচের দাম ছাড়িয়ে যায় ৪ হাজার টাকা। এছাড়া অন্যান্য মসলার দামও ছিল বেশ চড়া। ব্যবসায়ীরা সে সময় জানান, ডলার সংকট ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় মসলার বাজার অস্থির হয়ে উঠেছিল।
বছরজুড়েই অস্থির ছিল দেশের চিনির বাজার। চিনি নিয়ে ভোক্তাদের সঙ্গে এক প্রকার ছিনিমিনিই খেলেছেন মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা। এতে চিনির দাম চলে গেছে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নাগালের বাইরে।
মাংস বিক্রেতা খলিল কাণ্ডে বছরের শুরু থেকে আলোচনা ছিল গরুর মাংস। খলিলের উদ্যোগে মাংসের দাম নেমে এসেছিল ৬০০-৬৫০ টাকায়। তবে শবে বরাতের আগে হঠাৎই বাজারে বেড়ে যায় গরর মাংসের দাম। সে সময় প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হয় ৭৫০ টাকায়। আর হাড়-চর্বি ছাড়া মাংস বিক্রি হয় ৮০০ হাজার টাকায়। বর্তমানে মুরগির বাজার নিুমুখী থাকলেও বছরজুড়ে এ বাজার ছিল চরম অস্থিতিশীল। মুরগির সঙ্গে চলতি বছর অস্থির হয়ে ওঠে মুরগির ডিমের বাজার। প্রতি ডজন লাল ডিমের ১৮০-১৯০ টাকা ও প্রতি ডজন সাদা ডিমের দাম উঠে যায় ১৭৫ টাকা পর্যন্ত। আগস্টে বন্যায় খামার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ডিমের দাম বাড়তে শুরু করে। বছরের শুরুতেই হঠাৎ নির্বাচনের অজুহাতে চালের দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। ফেব্রুয়ারি-মার্চে দাম বাড়ে আরেক দফা। তবে অন্যান্য বছর রোজায় চালের দাম না বাড়লেও এবছর সরবরাহ সংকটের দোহাই দিয়ে দাম বাড়িয়ে দেন মিল-মালিকরা। যার প্রভাব পড়ে খুচরা বাজারেও।