ট্রাম্প জয়ী হলে কি বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব পাল্টাবে

0
নির্বাচনী প্রচারণায় ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফলাফল কি কোনো প্রভাব ফেলবে বাংলাদেশের ওপরে? প্রশ্নটা উঠছে, কারণ বাংলাদেশে এখন বিশেষ একধরনের সরকারব্যবস্থা চলছে। অভ্যুত্থান–পরবর্তী দ্রুততম সময়ে বিশেষ এ সরকারের প্রয়োজন ছিল পশ্চিমা সমর্থন। সেটি শুধু পাওয়া নয়, বেশ ভালোভাবেই অর্জন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পর সেটিতে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, তা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে বহুমাত্রায়।

সবশেষ সে আলোচনায় জ্বালানি সরবরাহ করেছে হঠাৎ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি এক্স বার্তা। যেখানে তিনি দাবি করেছেন, বাংলাদেশে এখন অরাজকতা চলছে। যে দাবিটি কয়েক মাস করে আসছে আওয়ামী লীগ। ট্রাম্প আরও দাবি করেছেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন চলছে। যেটি মূলত বাংলাদেশের এ সরকারকে মনেপ্রাণে অপছন্দ করা ভারতের দাবি। ভারত এবং দেশটির মিডিয়া বেশ চড়া সুরে দাবিটি করলেও সেটি শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি। কিন্তু ট্রাম্পের মন্তব্যের পর নতুন করে আলোচনা শুরুর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

ট্রাম্প তাঁর এক্স বার্তায় ভারতকেও টেনে এনেছেন। বলেছেন, ভারত ও দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর ভালো বন্ধু। এটাও বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যৎ বড় ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট।

এর আগে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ফোনালাপে মোদি বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি জানিয়েছিলেন। মোদি নিজের এক্স বার্তায় সেটি প্রকাশও করেছেন। তবে এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইতিবাচক কোনো উত্তর পাননি মোদি। যা কার্যত তাঁকে বেশ হতাশ করেছে। কিন্তু সেখানে ট্রাম্প নিজে থেকেই মোদির কথাকে সত্যায়িত করছেন। এটা বাংলাদেশ ইস্যুতে ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের সম্পর্কে নতুন কোনো রাজনৈতিক মেরুকরণ কি না, সেটা নিয়েও কথা উঠছে।

এটা ঠিক যে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ঠিক ছয় দিন আগে যে কথাগুলো বলেছেন, সেটা দেশটির হিন্দু ভোটারদের আকৃষ্ট করতেই বলা। স্পষ্টত জরিপগুলো বলছে, এ নির্বাচন হবে হাড্ডাহাড্ডি। মেক্সিকানদের পরেই যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় অভিবাসী ভোটার ব্লক মনে করা হয় হিন্দু ভোটারদের। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ৫২ লাখ হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভোটার প্রায় ২৬ লাখ। সাধারণত তারা ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিলেও এবারের জরিপ বলছে, নিজে প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলেও হিন্দু ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়তা কমছে কমলা হ্যারিসের। কার্নেগি এনডোম্যান্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন পরিচালিত জরিপ বলছে, ২০২০ সালের নির্বাচনে বাইডেন যখন ৬১ শতভাগ হিন্দু ভোট পেয়েছেন, এবার কমলা তার ৪ শতভাগ কম ভোট পাবেন।

ট্রাম্প তাই নির্বাচনের আগে আগে হিন্দু ভোটারদের টানতে একটি কূটচাল দিয়েছেন বলা যায়। নির্বাচনের পর তিনি এ অবস্থানে না–ও থাকতে পারেন। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগটি সরকার পতনের ঠিক পরপর উঠেছে। এর প্রায় ৩ মাস পর ট্রাম্প এ বিষয়ে কথা বলা নিয়ে তাই বেশ রহস্য রয়েছে। সংশ্লিষ্ট অনেকে বলছেন, ট্রাম্পের এ বক্তব্যটি ইউএসএ হিন্দু ফেডারেশনের খসড়া করা। তারাই এ বিষয়ে ট্রাম্পকে দিয়ে বলিয়েছে। আগামী নির্বাচনে তাঁকে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে।

তবে মনে রাখতে হবে, ট্রাম্পের নির্বাচনী ট্রান্সজিশন টিমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাতিজা রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র ও ডোমোক্র্যাট দল পাল্টে এবার ট্রাম্পকে সমর্থন জানানো সাবেক কংগ্রেসওম্যান তুলসি গ্যাবার্ড, যিনি ডানপন্থী কট্টর হিন্দুবাদী হিসেবে পরিচিত।

এর আগে ২০১৬ সালে হাওয়াইয়ের এ কংগ্রেসওম্যান হাউস রেজল্যুশন থ্রি নাইনটি সিক্স এবং ২০১৮ সালে ইন্ডিয়ানার রিপাবলিকান হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভ জিম ব্যাংকস হাউস রেজল্যুশন ওয়ান সিক্সটি কংগ্রেসে উত্থাপন করেছিলেন। দুটি রেজল্যুশনে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিষয়ে অভিযোগ এনেছিলেন। রেজল্যুশন দুটি এতটাই দুর্বল ছিল যে সেটি কমিটি পর্যায়ে বাতিল হয়ে যায়।

তবে আশঙ্কার কথা, ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হলে তুলসি গ্যাবার্ডকে সেক্রেটারি অব স্টেট (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। সেটি বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রণয়নে বড় ধরনের ধাক্কা হতে পারে।

অনেকের হয়তো মনে আছে, হোয়াইট হাউসে ২০১৯ সালের ১৯ জুলাই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে এক সাক্ষাতে যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানের ‘নিখোঁজ’ হওয়ার তথ্য দিয়ে আলোচনায় আসেন প্রিয়া সাহা নামের এক নারী। ট্রাম্প এ বিষয়ে শুনেছেন ঠিকই, তবে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি তাঁর প্রশাসনকে।

বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের মাথাব্যথা নিয়ে যাঁরা উদ্বিগ্ন, অনেকেই মনে করেন সেখানে বড় ভূমিকা রাখে দেশটির অন্যতম মিত্র ভারত। ভারতকে চটিয়ে বাংলাদেশে অনেক কিছু করতে চাইলেও করতে পারে না যুক্তরাষ্ট্র। তবে বিশ্বস্ত বন্ধু শেখ হাসিনাকে হারিয়ে এবার ভারত বাংলাদেশের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিতে চাইলেও সেটা আটকে আছে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের কারণে। সেখানে পরিবর্তন আসতে পারে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় নির্বাচিত হয়ে এলে।

এর মধ্যে আলোচনায় আসতে পারে সম্প্রতি সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজের একটি খবর। যেখানে দাবি করা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানকে ট্রাম্পের সঙ্গে সখ্য বাড়াতে লবিস্ট ফার্ম হিসেবে নিয়োগ করেছেন। নেত্র নিউজের এ খবরটা বলছে, আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির জন্য দুই লাখ ডলারের (প্রায় আড়াই কোটি টাকা) বিনিময়ে একটি লবিং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াজেদ কনসালটিং ইনকরপোরেশন’।

যে দুই ব্যক্তি লবিস্ট প্রতিষ্ঠানটি চালান, তাঁরা ২০১৬ সালে ট্রাম্পের নির্বাচনী টিমে অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্মকর্তা ট্রাম্পের আগের প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাদের মাধ্যমে ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে চায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এর পর থেকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অনেকে ট্রাম্পকে নিজেদের জন্য আশীর্বাদ ভাবতে শুরু করেছেন।

এটা কিছুটা বিভক্ত করতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশিদের। ভোটের হিসাবে বাংলাদেশিরা ডেমোক্র্যাটকে বড় মিত্র ভাবলেও অনেকে হয়তো এবার রিপাবলিকানদের ভোট দেওয়ার কথা ভাবছেন।

এ ছাড়া বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশি আওয়ামী সমর্থকদের অনেকে মনে করেন, শেখ হাসিনা সরকার পতনের জন্য বড় ভূমিকা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। বিশেষ করে বাইডেনের বর্তমান সরকারের ওপর তাদের ক্ষোভ বেশি। ট্রাম্পের বিভিন্ন সমাবেশে গুটিকয়েক যে বাংলাদেশিরা যোগ দেন, তাঁদের অনেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিশ্বাসী।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এ সরকারের সঙ্গে ডেমোক্রেটিক নেতাদের সখ্য বহু পুরোনো। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, তাঁর স্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে রয়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর ডেমোক্রেটিক যে তিনজন শীর্ষ নেতার সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে, তাঁরা হলেন, ক্লিনটন, হিলারি ও বারাক ওবামা। তাই ড. ইউনূস প্রশাসনের সব ধরনের সহায়তা নিশ্চিত করতে ক্লিনটন ও হিলারি ভূমিকা রাখবেন, এটাই স্বাভাবিক।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরোধী যাঁরা, তাঁরা অনেকে ভেবেছিলেন, এ সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা গোপনে করবে। কিন্তু তাঁদের হতাশ করেছে সবশেষ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ড. ইউনূসের বৈঠক। সব ধরনের রেকর্ড ভেঙে বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বৈঠক এবং সেখানে দুই নেতার শারীরিক ভাষা বিরোধী শিবিরকে হতাশ করেছে। মনে মনে অনেকে ডেমোক্র্যাটদের ওপরে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।
একটু মনে করিয়ে দিই, বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নীতি। ভারতের কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতা ঐতিহাসিক। কংগ্রেস বিদায় নিয়ে মোদি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিবিদদের মধ্যে উল্লাস দেখা গিয়েছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন শেখ হাসিনার সঙ্গে মৌলবাদী মোদির বোধ হয় খুব একটা জমবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি একচুলও নড়েনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কংগ্রেসের চেয়ে মোদির বিজেপি শেখ হাসিনার জন্য আরও বেশি ভূমিকা রেখেছেন এবং রাজনীতিতে ঐকমত্যের ভিত্তিতেই ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে।
তবে ব্যক্তিগত ভূমিকা যে একেবারে কাজ করে না, তা নয়। সে ক্ষেত্রে আনপ্রেডিক্টেবল ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের জন্য কী অপেক্ষা করছে, তা হয়তো ভবিষ্যৎই বলে দেবে।