খুলনায় নকশা পরিবর্তন করে বীর নিবাসে আলিশান ভবন নির্মাণ

0

জামাল হোসেন,খুলনা ॥ নাহিদা আক্তার ইলা একজন গৃহবধূ। বাড়ি খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার সেনহাটি গ্রামে। বড় বোন ওয়াহিদা আক্তার শিলা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সদ্য সাবেক সচিব। কর্মরত ছিলেন পতিত স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী-২ হিসেবে। ছোট বোন লতিফা আক্তার নিলা একটি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার উপপরিচালক। এ তিন কন্যার পিতা মৃত নজীর আহম্মদ। সবাই অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক। ইলার একমাত্র ছেলে রিশাদুল ইসলাম ঠিকাদার।
অথচ পিতার সুবাদে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় রয়েছে নাহিদা আক্তার ইলার নাম। নিয়েছেন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বরাদ্দকৃত ‘বীর নিবাসে’ বাড়িও। এমনকি ঠিকাদারকে কাজ করতে না দিয়ে নকশা পরিবর্তন করে ইচ্ছামত সরকারি অর্থে নির্মাণ করছেন বহুতল বিশিষ্ট আলিশান ভবন। ‘বীর নিবাস’র সাথে ভবন ও মার্কেটও তৈরি করেছেন। যদিও ক্ষমতার পট পরিবর্তন ও ক্ষমতার উৎস্য সচিব বোনের চাকরিচ্যুতি ও আত্মগোপনের পর ‘বীর নিবাস’র নাম ফলকটি কাদামাটি দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন।
একইভাবে উপজেলার চন্দনীমহল গ্রামের গাজী আব্দুল লতিফের একমাত্র ছেলে গাজী লুৎফর রহমান। কর্মরত রয়েছেন বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন স্টার জুট মিলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে। বিশাল মার্কেট ও তিনটি বাড়িসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক তিনি। মা মর্জিনা বেগমের নামে বরাদ্দ হলেও তিনিই পিতার অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের কোটায় বরাদ্দকৃত বীর নিবাসের অধিবাসী। শিলা-নিলার ভাইয়ের বন্ধু পরিচয় দানকারী লুৎফরও ক্ষমতার দাপটে নকশা পরিবর্তন করে আলিশান বাড়ি তৈরি করতে ঠিকাদারকে বাধ্য করেছেন। ‘বীর নিবাস’র সাথে ভবন এবং মার্কেট তৈরি করে তিনিও ‘বীর নিবাস’র নাম ফলকটি পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। যা দেখে বোঝার কোন উপায় নেই যে এটা ‘বীর নিবাস’।
অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের কোটায় বরাদ্দকৃত ‘বীর নিবাস’র এমন তুঘলকি চিত্র খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার। উপজেলার মাত্র ১২জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ‘বীর নিবাস’ পেয়েছেন। এর মধ্যে ক্ষমতার দাপটে উল্লিখিত দুজন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে বরাদ্দকৃত সরকারি অর্থ এভাবে ইচ্ছামাফিক নয়-ছয় করেছেন। নিয়ম-নীতির কোন তোয়াক্কা না করে সরকারি অর্থে নির্মিত বাড়িকে ‘নিজের বাড়ি’ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। অথচ বীর নিবাসে ঠাঁই হয়নি অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলা পর্যায়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাচাই-বাছাইতে নাম বাদ পড়ে পিতা নজীর আহম্মদের। কিন্তু প্রভাবশালী দু মেয়ে ওয়াহিদা আক্তার শিলা ও লতিফা আক্তার নিলার ক্ষমতায় ঢাকার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা)’র তালিকায় ২০১০ সালে তার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় গেজেটভুক্ত হয়।
সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ, তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিবনাথ রায়ের আমল থেকে তালিকায় নাম তোলার চেষ্টা করে আসছিলেন নজির আহমেদ। কিন্তু সঠিক কাগজপত্র ও প্রমাণাদি না থাকায় উপজেলার যাচাই-বাছাইতে তার নাম বাদ পড়ে। এমনকি দু প্রভাবশালী কন্যার মামা মুন্সী মাহবুবুর রহমান (হাবিবুর রহমান)- কেও মুক্তিযোদ্ধা বানানোর পায়তারা করেন তারা। ওই সময় তার মেজ বোন ইলার ছেলে রাশেদুল একটি চিঠি দেখিয়ে এলাকায় প্রচার করেন তার নানার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আসছে। এমনকি মাহবুবুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হচ্ছেন বলে নিজেই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে গিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন।
নাহিদা আক্তার এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রথমে সরকারি নকশা অনুযায়ী ভবন করা হয়। পরে সবার সাথে কথা বলে আমার ছেলে রাশিদুল ইসলাম তা ভেঙে আবার নতুন ভবন তৈরি করেন। ঘরের অনেক কাজ এখনো বাদ আছে। ঘরে বসবাস করার মত এখনও হয়নি । সরকার থেকে যে টাকা পেয়েছি তা দিয়ে তো ওই বাড়ি তৈরি হয় না । আমি বেশিকিছু জানিনা । সব আমার ছেলে করেছে। ছেলে রাশিদুলের সাথে কথা বললে সব কিছুই জানতে পারবেন বলেও তিনি জানান।
মর্জিনা বেগমের ছেলে গাজী লুৎফারের নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে দিঘলিয়া উপজেলার ডেপুটি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আসগার আলী বলেন, উপজেলা পর্যায়ে যাচাই-বাছাইতে শিলা-নিলার পিতা নজির আহমেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম আসেনি। তার নাম জামুকার তালিকায় গেজেট হয়ে আসে। তিনি মন্তব্য করেন, নাহিদা আক্তার ও মর্জিনা বেগম মুক্তিযোদ্ধাদের বীর নিবাসে ঘর পাওয়ার যোগ্য না। তারা নকশা পরিবর্তন করেছেন। এটা ঠিক করেননি।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কামরুজ্জামান বলেন, উপজেলায় নাহিদা আক্তারের ঘরটা নকশা ছাড়া আলিশান বাড়ি করা হয়েছে। আর সামনে মার্কেট থাকার কারণে গাজী লুৎফরের মা মর্জিনা বেগমের বাড়ি দৃশ্যমান হয়নি।
দিঘলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাসুম বিল্লাহ বলেন, বীর নিবাসের জন্যে যাচাই-বাছাই তিনি আসার আগে হয়েছে। যারা নকশা পরিবর্তন করে আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন তাদের নোটিশ করা হবে ।