নির্বাচনকে ঘিরে যশোরে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্যে

0

মাসুদ রানা বাবু ॥ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বর্তমান সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ভোট যুদ্ধে নেমেছেন কাজী পরিবারের এক সময়ের বিশ্বস্ত সিপাহশালার মোহিত কুমার নাথ। যিনি বর্তমানে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গেল ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোহিত কুমার নাথ কাজী নাবিল আহমেদের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন। তাদের সম্পর্কের চিড় ধরে ২০১৯ সালে। এরপর থেকে মোহিত কুমার নাথ চলে আসেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের পক্ষে।
সেখান থেকে মাঠের রাজনীতিতে কাজী নাবিল আহমেদ ও মোহিত কুমার নাথ একে অপরের কঠিন প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন। তারা এখন নির্বাচনের মাঠেও প্রতিপক্ষ। নির্বাচনের মাঠে তারা পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দিয়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছেন। কাজী নাবিলের সাথে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন ছাড়া দলের শীর্ষ পর্যায়ের কোনো নেতাকে নির্বাচনের মাঠে দেখা যাচ্ছে না। নেই শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক । অন্যদিকে মোহিত কুমার নাথের সাথে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহারুল ইসলামসহ দলের প্রতাপশালী নেতারা রয়েছেন।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যশোর সদর আসনের মত বাকি ৫টি আসনেও আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের লড়াই চলছে। নির্বাচনকে ঘিরে যশোরে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দীর্ঘ দিনের কোন্দল প্রকাশ্যে এসেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজ দলের কর্মী সমর্থকরা একে -অপরের সাথে সংঘর্ষ কিংবা সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছেন। একে- অপরের নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগ কিংবা কর্মী -সমর্থকদের মারধিরের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সেই সাথে নৌকা কিংবা আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও তাদের কর্মী -সমর্থকদের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য নির্বাচনের মাঠে রীতিমত তাপ উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
যশোর-১ (শার্শা) আসন থেকে বর্তমান সংসদ শেখ আফিল উদ্দিন নৌকার মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচন করছেন। তার সাথে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও বেনাপোল পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম লিটনের বিরোধী দীর্ঘদিনের। দীর্ঘদিন ধরে শার্শায় মাঠের রাজনীতিতে পরস্পর সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শনের করে আসছেন তারা। উপজেলাব্যাপী তাদের দ্বন্দ্ব সকলেরই জানা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ও তারা একে- অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী।
যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে থেকে নৌকার প্রার্থী হয়েছেন ডা. তৌহিদুজ্জামান। ঝিকরগাছা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি নতুন মুখ । তাকে ঘিরে ঝিকরগাছা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাড. মনিরুল ইসলাম মনির ও বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলামের দ্বন্দ্ব আবারও প্রকাশ্যে এসেছে। দুই মনিরুল ইসলামের দ্বন্দ্ব দীর্ঘ দিনের সেটি কারো জানার বাইরে নয়। নির্বাচনকে ঘিরে তাদের দ্বন্দ্ব আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
এই আসন থেকে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাড.মনিরুল ইসলাম মনির স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। ঝিকরগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম মুকুল, সাধারণ সম্পাদক মুছা মাহমুদসহ উপজেলার দাপটশালী নেতারা নির্বাচনে মনিরুল ইসলাম মনিরের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। আবার চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী মাসুদ চৌধুরীসহ উপজেলার একদল প্রতাপশালী নেতা মনিরের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নির্বাচনের মাঠ কাঁপাচ্ছেন।
অন্যদিকে নৌকার প্রার্থী তৌহিদুজ্জামানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ঝিকরগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি চৌধুরী রমজান শরীফ বাদশা, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম। এ আসন থেকে চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম হাবিবুর রহমান নির্বাচন করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি নৌকার প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। তবে মাঝপথ থেকে নির্বাচনী মাঠ থেকে এস এম হাবিবুর রহমানের সরে দাঁড়ানো নিয়ে নানা গুঞ্জন রয়েছে।
যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর) আসন থেকে নৌকার প্রাথী হয়েছেন এনামুল হক বাবুল। তার বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য রনজিত কুমার রায়। তবে এনামুল হক বাবুলকে ঠেকাতে ঋণ সংক্রান্ত একটি বিষয় নিয়ে রনজিত কুমার রায়কে বেশ তৎপর হতে দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত এনামুল হক বাবুল উচ্চ আদালতের মাধ্যমে প্রার্থিতা ফিরে পান। এরপর থেকে কার্যত রনজিত কুমার রায়কে নির্বাচনের মাঠে দেখা যায়নি। তবে রনজিত কুমার রায় নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন নাকি এনামুল হক বাবুলের প্রার্থিতা বাতিলের জন্যে ঢাকায় তৎপরতা চালাচ্ছে সেই গুঞ্জন রয়ে গেছে।
যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসন থেকে নৌকার প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য। তার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে মাঠে আছেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ও জেলা কৃষকলীগের সহসভাপতি এস এম ইয়াকুব আলী। মনিরামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী মাহমুদুল হাসান নৌকার প্রার্থীর হয়ে কাজ করলেও সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন নিশ্চুপ। তিনি কোনো পক্ষে অবস্থান নেননি।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম-সম্পাদক শামসুল হক মন্টু বলেন, বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মিকাইল হোসেন, গৌর ঘোষ, বাবুল আক্তার, সাংগঠনিক সম্পাদক সন্দীপ ঘোষসহ উপজেলা বর্তমান নির্বাহী কমিটি সিংহভাগ নেতা এসএম ইয়াকুব আলীর হয়ে নির্বাচন করছেন। এই আসনে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার প্রথম দিন থেকে উত্তেজনা চলছে। নৌকা প্রতীকের অনুসারীরা নির্বাচনের প্রচারণার প্রথম দিন থেকে সর্বোচ্চ পেশীশক্তি প্রয়োগ করছেন। সাধারণ ভোটারদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখানোসহ স্বতন্ত্র প্রাথীর ঈগল প্রতীকের নির্বাচনী অফিস ভাঙচুরসহ কর্মী সমর্থকদের মারধরের অভিযোগ রয়েছে।
যশোর-৬ (কেশবপুর) আসন থেকে নির্বাচন করছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার ও তার বিপক্ষে নির্বাচন যুুদ্ধে নেমেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এইচ এম আমির হোসেন। কেশবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতাপশালী নেতারা এইচ এম আমিরের হোসেনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নির্বাচনে কাজ করছেন। সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে তার পক্ষে মাঠে নেমেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গৌতম রায়, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শাহাদৎ হোসেন, যুবলীগের আহ্বায়ক বিএম শহিদুজ্জামান শহীদ, ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক পলাশ মল্লিক ও হাবিবুর রহমান মুকুলসহ তাদের অনুসারী উপজেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী গোলাম মোস্তফা কোনো পক্ষের হয়ে মাঠে নামেননি।
আবার শাহীন চাকলারের পক্ষে স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এস এম রুহুল আমিন ছাড়া উপজেলার প্রতাপশালী কোনো নেতাকে নির্বাচনের মাঠে দেখা যাচ্ছে না। যশোর শহর ও সদর উপজেলা থেকে প্রতাপশালী নেতারা সেখানে গিয়ে শাহীন চাকলাদারের পক্ষে নির্বাচনের মাঠ কাঁপাচ্ছেন। অতি সম্প্রতি এখানে শাহীন চাকলাদারের নির্বাচনী অফিসে অগ্নিসংযোগ করার ঘটনাও ঘটেছে।
যশোরে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পেশীশক্তি প্রয়োগের ঘটনা রীতিমত জেলাজুড়ে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। সাধারণ মানুষও তাই ভীতসন্ত্রস্ত্র।
এ বিষয় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, নির্বাচন ভালো চলছে। নির্বাচন নিয়ে যা কিছু হচ্ছে এতে দলে কোনো প্রভাব পড়বে না। এখন যেটা হচ্ছে ভোটের পর সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ভাই ভাই মাঝেমধ্যে একটু মারামারি হয়। পরে সব ঠিক হয়ে যায়। বাইরে কোনো লোক এক ভাইয়ের ওপর আক্রমণ করলে আরেক ভাই বসে থাকে না।