চৌগাছায় আর্সেনিমুক্ত পানির কলের অর্ধেকই নষ্ট

0

এম এ রহিম, চৌগাছা (যশোর)॥যশোরের চৌগাছায় আর্সেনিমুক্ত পানির কল অর্ধেকই নষ্ট। তাই প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে রোগীর সংখ্যা। নতুন নতুন গ্রামের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনি ধরা পড়ছে। উপজেলার মাড়–য়া গ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামে আর্সেনিকোসিস রোগে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৫০ জনের। এরমধ্যে অতি সম্প্রতি উপজেলার দক্ষিণ কয়ারপাড়া গ্রামের এ রোগে মারা গেছেন আক্কাস আলী (৫০),আশরাফ হোসেন (৫২), চম্পা বেগম (৬২) ও জবুরুন নেছা (৬০)। আর্সেনিযুক্ত পানি পান করায় এসব গ্রামের ৫৫ শতাংশ মানুষ আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত হয়েছে। আর্সেনিক প্রতিরোধে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অফিস ও জাপানের জাইকার উদ্যোগে উপজেলায় ৫৩৮টি ডাগওয়েল (পাতকুয়া), পন্ড সেন্ট ফিল্টার (পিএসএফ) ও আর্সেনিক আয়রন রিমুভাল প্লান্ট (এআরআইপি) নির্মাণ করা হয়। যার ব্যয় হয় সাত কোটি ৪০ লাখ টাকা।
যার মধ্যে রক্ষাবেক্ষণের অভাবে ২২৬টি অকেজো হয়ে গেছে। অনেকগুলোর নেই অস্তিত্ব। এগুলো নষ্ট হওয়ায় প্রায় চার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। থেমে গেছে আর্সেনিকমুক্ত পানির প্লান্টের কার্যক্রম। ১৯৮২ সালের দিকে বিষাক্ত পানির গ্রাম মাড়–য়ার মানুষ অজানা রোগে আক্রান্ত হন। ২০০১ সালে এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক মাড়–য়া গ্রামে গবেষণা শুরু করে। পদক্ষেপ নেয় আর্সেনিকমুক্ত পানির ব্যবস্থার। পরে জাপানের জাইকা ২০০৫ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ৩১টি পন্ড সেন্ট ফিল্টার (পিএসএফ) নির্মাণ করে। এতে ব্যয় হয় এক কোটি ৫৫ লাখ টাকা। একটি ফিল্টার নির্মাণে ব্যয় হয় পাঁচ লাখ টাকা। যার বেশির ভাগ দীর্ঘদিন ধরে অকেজো রয়েছে। এদিকে নতুন এলাকা আর্সেনিক চিহ্নিত হলে সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। টিউবওয়েলের পানি পরীক্ষা, মানুষকে আর্সেনিকমুক্ত পানি পানের জন্যে সচেন করা হয়।
২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস অল্প কিছু টাকা নিয়ে আর্সেনিকমুক্ত প্লান্ট নির্মাণ করে। কিন্তু কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত অধিকাংশ প্লান্ট নষ্টের ফলে মাড়–য়া গ্রামের পাশাপাশি দক্ষিণ কয়ারপাড়া, রামভদ্রপুর (কুষ্টিয়া), জগন্নাথপুর, পাশাপোল, মশিউরনগর, সিংহঝুলী, ফুলসারাসহ বিভিন্ন গ্রামের মানুষ পান করছেন আর্সেনিকযুক্ত পানি। ফলে উপজেলাব্যাপী দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে আর্সেনিক রোগীর সংখ্যা। দক্ষিণ কয়ারপাড়া গ্রামেই রয়েছে শতাধিক আর্সেনিক রোগী।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে এ উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ৩০০টি ডাগওয়েল (পাতকুয়া) নির্মাণ করা হয়। এতে ব্যয় হয় এক কোটি ৮৭ লাখ টাকা। প্রতিটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৫৫ হাজার টাকা। প্রতিটিতে সুবিধাভোগীরা জমাদান করেন তিন হাজার ৫০০ টাকা। এ অর্থবছরে চার কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০৭টি আর্সেনিক আয়রন রিমুভাল প্লান্ট (এআরআইপি) নির্মাণ করা হয়। প্রতিটি নির্মাণে ব্যয় হয় দুই লাখ টাকা। এই প্লান্ট প্রাপ্তির জন্যেও সুবিধাভোগীরা প্রতিটির ক্ষেত্রে জমা দেন তিন হাজার ৫০০ টাকা। ২০২০ সালে উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ডাগওয়েল ৩০০টি, জাপানের জাইকা পিএসএফ ৩১টি ও আর্সেনিক আয়রন রিমুভাল প্লান্ট (এআরআইপি) ২০৭টি নির্মাণ করে। যাতে ব্যয় হয় সাত কোটি ৪১ লাখ টাকা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ফুলসারা ইউনিয়নে ডাগওয়েল ১৬টির মধ্যে আটটি, পিএসএফ ১৪টি, এআরআইপি ৩৩টির মধ্যে ১৩টি নষ্ট। পাশোপোলে ডাগওয়েল ৩৯টির মধ্যে ১০টি, পিএসএফ চারটি, এআরআইপি ২৮টির মধ্যে আটটি নষ্ট। সিংহঝুলীতে ডাগওয়েল ৫৬টির মধ্যে ২০টি, পিএসএফ তিনটি, এআরআইপি ২২টির মধ্যে পাঁচটি নষ্ট। ধুলিয়ানীতে ডাগওয়েল ৩৬ টির মধ্যে ১০টি, এআরআইপি ১৩টির মধ্যে চারটি নষ্ট, চৌগাছায় ডাগওয়েল ২৫টির মধ্যে ১১টি, একটি পিএসএফ বন্ধ, এআরআইপি ১৫টির মধ্যে পাঁচটি নষ্ট, জগদীশপুরে ডাগওয়েল ১১টির মধ্যে ছয়টি, পিএসএফ দুটি নষ্ট, এআরআইপি ২২টির মধ্যে আটটি অকেজ। পাতিবিলায় ডাগওয়েল ১৬টির মধ্যে ছয়টি, পিএসএফ দুটি, এআরআইপি ১৫টির মধ্যে পাঁচটি নষ্ট। হাকিমপুর ইউনিয়নে ডাগওয়েল ১৪টির মধ্যে চারটি নষ্ট । এআরআইপি ১০টির মধ্যে পাঁচটি নষ্ট। স্বরূপদাহে ডাগওয়েল ৩১টির মধ্যে ১০টি, পিএসএফ তিনটিই নষ্ট, এআরআইপি ২১টির মধ্যে ১১টি নষ্ট, নারায়নপুরে ডাগওয়েল ২২টির মধ্যে আটটি, পিএসএফ একটি, এআরআইপি ১২টির মধ্যে ছয়টি নষ্ট । সুখপুকুরিয়ায় ডাগওয়েল ২৪টির মধ্যে ১০টি, পিএসএফ একটি, এআরআইপি ১৬টির মধ্যে ১০টি নষ্ট । এছাড়া চৌগাছা পৌরসভায় ডাগওয়েল ১০ টির মধ্যে ৪টি নষ্ট। এভাবে ২১৬টি প্লান্ট অকেজো হয়ে গেছে। মরিচা ধরে জরাজীর্ণ হয়ে গেছে প্লান্টগুলো। টিউবওয়েলে জং ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। চুরি হয়ে গেছে অনেক যন্ত্রাংশ।
সোমবার সরেজমিন দক্ষিণ কয়ারপাড়া গ্রামে গেলে চোখে পড়ে আর্সেনিক রিমুভাল প্লান্টগুলো নষ্ট রয়েছে। আর্সেনিক রোগী দক্ষিণ কয়ারপাড়ার মাস্টার ইয়াকুব আলী (৫৫), আব্দুস সামাদ (৫৪) ও আজগর আলী (৫৩) জানান, এই গ্রামে বর্তমানে প্রায় ৫৫ ভাগ মানুষ আর্সেনিকে আক্রান্ত। ২০১৩ সালে সরকার ও জাইকা আর্সেনিকমুক্ত পানির জন্যে প্লান্টগুলো তৈরি করে। বর্তমানে সবগুলো নষ্ট। গ্রামের আলেয়া বেগম (৪৫), খাইরুল ইসলাম (৫৫), উম্মে রেশমা (৪০), শাহ জামাল (৫০) ও সাথী খাতুন (৩৫) জানান, তারা ১৫-২০ বছর ধরে আর্সেনিকের রোগে আক্রান্ত। প্রচন্ড শীতেও গায়ে কাপড় রাখা যায় না।আর্সেনিকযুক্ত পানির জন্যে আমরা খুবই কষ্টে আছি। বিষ জেনেও সেই পানিই আমরা খাচ্ছি।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অফিসের সহকারী প্রকৌশলী ফেরদৌসী খাতুন বলেন, জনগণের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে সরকার ও জাইকার সহযোগিতায় গ্রামে-গ্রামে আর্সেনিকমুক্ত পানির প্লান্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এ নিরাপদ পানির উৎস এ প্লান্টগুলো রক্ষাণাবেক্ষণ করা সকলের দায়িত্ব। এগুলো বন্ধ হয়ে গেলে আসেনিকযুক্ত পানি পানে বাধ্য হবে মানুষ। জীবন বাঁচাতে আর্সেনিকমুক্ত পানির কোনো বিকল্প নেই।