ভোটকেন্দ্রে ভোটারের চেয়ে ‘সাংবাদিক বেশি’

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ঢাকা-১৭ আসনের উপ-নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি যে কম হবে, তা অনুমিতই ছিল। ভোটের সকালে কয়েকটি কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেল, ভোটারের তুলনায় সাংবাদিকের সংখ্যা বেশি।
ক্যান্টনমেন্ট, বনানী, গুলশান এলাকা নিয়ে গঠিত রাজধানীর এই আসনে ভোটার আছেন সোয়া তিন লাখ।
সোমবার (১৭ জুলাই) সকাল ৮টা থেকে ১২৪টি কেন্দ্রে ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণ শুরু হয়, যা বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে।
গুলশান-২ এর গুলশান মডেল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোটার আছেন ৩১২৯ জন। সকাল ১০টা ২০ পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন মাত্র ৯ জন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ভোটার উপস্থিতি একজন দুজন করে বাড়তে দেখা গেল।
বনানী বিদ্যানিকেতন ভোটকেন্দ্রে দেখা গেল অলস সময় কাটাচ্ছেন পোলিং অফিসার এবং এজেন্টরা।
সকাল ১০টায় এই কেন্দ্রে সস্ত্রীক ভোট দিতে আসেন স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সামাদ। তিনি বলেন, “আমরা স্বঃপ্রণোদিত হয়েই ভোট দিতে এসেছি। কারণ এটা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু এসে তো দেখলাম ভোটারের চেয়ে আপনারা (সাংবাদিক) বেশি।”
আরেক ভোটার রতন কুমার দত্ত বললেন, “আমি শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিয়েছি। যাকে দিতে চাইছি, তাকেই দিতে পারছি।”
উপস্থিতি নিয়ে আরেকরকম ব্যাখ্যা দিলেন আরেক ভোটার। বললেন, “ভোটার অনুপস্থিতি কম তো লাগবেই। মানুষ ভোট দিতে চায় না কারণ সবাই জানে যে কে হবে। সেজন্য মানুষের মাঝে অনীহা কাজ করে।” তবে নিজের নাম প্রকাশ করতে চাইলেন না এই ভোটার।
এই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মো. লতিফ সরকার বললেন, “আমার জানামতে ২-৩টা ভোট পড়ছে এখন পর্যন্ত। ১২টার পর হয়ত বাড়বে। ঢাকার মানুষজন তো সকাল ১০টার আগে ঘুম থেকেই ওঠে না। সেজন্যই হয়ত কম।”
ভোটার তেমন না থাকলেও উৎসুক জনতার ভিড় দেখা গেল বনানী মডেল স্কুল কেন্দ্রে। স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম সকাল ১০ টার দিকে ওই কেন্দ্র পরিদর্শনে যান।
এসময় নারী ও পুরষ কেন্দ্রে ভোটারদের লাইন চোখে না পড়লেও স্কুল মাঠে জনাবিশের লোকের উপস্থিতি দেখা যায়। আর গণমাধ্যমকর্মী ছিলেন অন্তত ৪০ জন।
ঢাকা-১৭ আসনের ভোটার না হওয়ায় শুধু প্রার্থী হিসেবে কেন্দ্র পরিদর্শনে বের হন হিরো আলম, যিনি বগুড়ার ভোটার।
প্রায় আধ ঘণ্টা কেন্দ্র পরিদর্শন শেষে কেন্দ্রের গেইটে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন হিরো আলম। পুরো সময় ভোটার সামলানোর কোনো ঝক্কি না থাকলেও উৎসুক জনতা আর গণমাধ্যমকর্মীদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় দায়িত্বরত পুলিশকে।
এক পর্যায়ে লোকজন সরাতে হুইসেল বাজিয়ে কেন্দ্রের সামনে গেট ফাঁকা করতে হয়।
ক্যান্টনমেন্টের আরেক কেন্দ্র ব্লু বার্ড হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজেরও একই চিত্র। বাজার এলাকা হওয়ায় এখানে ভোটারের চেয়ে বহিরাগত মানুষ এবং সাংবাদিকের উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি।
বনানীর টি অ্যান্ড টি মহিলা কলেজ কেন্দ্রে নৌকার ব্যাজ পরা নারীদের ভিড় দেখা গেল, সাংবাদিক দেখে তারা দাঁড়িয়ে গেলেন সারি বেঁধে।
বনানীর টি অ্যান্ড টি মহিলা কলেজ কেন্দ্রের বারান্দায় অলস সময় কাটাতে দেখা গেল পুলিশ সদস্যদের।
সকাল ৯টায় বনানীর টি অ্যান্ড টি মহিলা কলেজে গিয়ে কেন্দ্রের চৌহদ্দির মধ্যে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ পরা নারী-পুরুষদের উপস্থিত দেখা যায়। সাংবাদিকের উপস্থিতি দেখে সারিবদ্ধ হয়ে যান তারা, সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন পুরুষও। অথচ এই কেন্দ্রে শুধু নারী ভোটারদের দুটি ভোটকেন্দ্র রয়েছে।
বাইরে এমন জটলা থাকলেও ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, ভোটারদের অপেক্ষায় আছেন পোলিং অফিসার ও নির্বাচনী এজেন্টরা; অলস বসে আছেন পুলিশ ও আনসার সদস্যরাও।
বাইরে লাইনে দাঁড়ানো নারীদের কাছে জানতে চাইলে তারা দাবি করেন, তারা সবাই ভোটার। ১০ জন করে ভেতরে ঢোকানো হচ্ছে, এ কারণে তারা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন।
এ বিষয়ে পাশে থাকা আনসার সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বললেন, কেউ ভোট দিতে চাইলে ভেতরে যেতে পারেন।
ওই সারির সামনে থাকা দুই নারী ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ঢোকেন এবং তাদের একজন ভোটকক্ষে না গিয়ে চলে যান টয়লেটে। টয়লেট থেকে বের হয়ে তিনি জানান, আগেই তিনি ভোট দিয়েছেন।
কিন্তু ভোট দিয়ে আবার লাইনে দাঁড়ানোর কারণ জানাতে পারেননি তিনি। অপর নারীও বলেন, ভোট আগে দিলেও লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।
নারীদের ওই জটলার মধ্যে ছিলেন ২০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক তাহমিনা আফরিন খাদিজা। ভোট দিয়ে ‘অন্যদের ভোটে সহযোগিতা করতে’ সেখানে অবস্থান করার কথা বললেন তিনি।
ভেতরে কেন্দ্র ফাঁকা থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখনও কেউ রান্না করতেছে, নাস্তা করতেছে, পরে আসবে।”
টি অ্যান্ড টি মহিলা কলেজের একটি কেন্দ্রের প্রিজাডিং অফিসার ওবায়দুল হক ভূঁইয়া জানালেন, তার কেন্দ্রে ৩ হাজার ১৪টি ভোট রয়েছে। প্রথম দেড় ঘণ্টায় ভোট পড়েছে ৩৩টি।
বাইরে লম্বা লাইন, কিন্তু ভোটকেন্দ্র ফাঁকা থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে আছি, ভোটাররা ভেতরে এলেই ভোট দিতে পারছেন। বাইরে লাইনে থাকলেও ভেতরে আসছে না কেন, আমি জানি না। আরও সময় গেলে হয়ত আসবে।”
এ আসনের উপ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি প্রার্থী দিলেও বিএনপিসহ অধিকাংশ দলই নেই। ফলে সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে এই ভোট নিয়ে ভোটারদের মধ্যে তেমন সাড়াও চোখে পড়েনি।
ফলে সাম্প্রতিক বিভিন্ন নির্বাচন থেকে এই উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হতে পারে বলে আগে থেকেই ধারণা করছিলেন সংশ্লিষ্টরা।
গুলশান মডেল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দেওয়ার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহম্মদ আলী আরাফাত।
ভোটার উপস্থিতির এমন চিত্র নিয়ে কথা বলেছেন প্রার্থীরাও। আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহম্মদ আলী আরাফাত গুলশান মডেল হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে নিজের ভোট দিয়ে বলেন,আমাদের একটা চ্যালেঞ্জ ছিল, মানুষকে ভোট দিতে আনা। কারণ, মাত্র ৫-৬ মাসের নির্বাচন। একটা অনীহা থাকে।
“আরেকটা অনীহা হল, নৌকার এত ভোট, যে সবাই ব্যক্তিজীবনে ভাবে যে আমি ভোট না দিলে কি আর হবে, কেউ না কেউ তো দেবেই। নৌকা জিতে যাবে। এটা একটা ভয়ঙ্কর চিন্তা। তবে এটা আমাদের জন্য খুব ভালো যে সমাজে নৌকার এত জনপ্রিয়তা। কিন্তু এই চিন্তাটা ভোটের ব্যালটে আনতে গেলে অনেকসময় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।”