এ সো হে বৈশাখ স্নিগ্ধ অভিষেকে

0

মহিউদ্দীন মোহাম্মদ ।। গতকাল বৃহস্পতিবার পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্তমিত হওয়ার মধ্যদিয়ে মহাকালের গহ্বরে আরো একটি বছর হারিয়ে গেছে। আজ শুক্রবার নতুন ভোরের সাথে এসেছে নতুন বছর। স্বাগত ১৪৩০ বঙ্গাব্দ। সকলের প্রত্যাশা কবি হাসান হাফিজুর রহমানের মত- ‘এ সো হে বৈশাখ আবেগ স্নিগ্ধ অভিষেকে,/ নিজকে তুমি স্থাপন করো/ভালোবাসায় আপ্লুত হও আরো।’ শুভ নববর্ষ।
প্রলয়োল্লাস কবিতায় বৈশাখ কীভাবে আমাদের নতুন বছরের সীমানায় এসে হাজির হয় সে সম্পর্কে কবি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আসছে এবার অনাগত প্রলয়-নেশার নৃত্য পাগল,/সিন্ধু পারের সিংহ-দ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল!’ আর এ বৈশাখের চেহারাটা কেমন সে সম্পর্কে বলছেন ‘মহাকালের চণ্ড রুপে -/ বজ্র-শিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ঙ্কর!’ হ্যা, সেই বৈশাখ প্রতিবছর আসে আমাদের সন্নিকটে। আসে নূতনের কেতন উড়িয়ে।
বৈশাখের সাথে বাংলার কৃষকের সম্পর্ক সুনিবিড়। বৈশাখ হলো বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। এই দিনটি সর্বজনীন উৎসবের। বৈশাখ শ্রেণি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে আসে উল্লাসের বার্তা নিয়ে। বঙ্গসনের যে আবির্ভাব তার গোড়াতে কৃষকশ্রেণি।
একদা নতুনবছর শুরুর দিনটি পালিত হতো ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে। ১৫৮৪ সালে দিল্লির সম্রাট জালালউদ্দীন মুহাম্মাদ আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। বাংলা বর্ষপঞ্জিটি প্রথমে তারিখে এলাহী বা ফসলি সন নামে পরিচিত ছিল। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ অথবা ১১ মার্চ এটি বঙ্গাব্দ নামে রূপান্তরিত হয়। তবে তার ব্যবহার শুরু হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ নভেম্বর থেকে। কারণ এদিন আকবর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করে সিংহাসনে আরোহন করেন।
ওই দিন থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হলেও কৃষিকাজের সুবিধার্থে ও কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে পদ্ধতিগত উপায়ে, অধিকতর সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যেই মূলত সম্রাট আকবর এ সনের প্রবর্তন করেন। হিজরি চান্দ্রসন ও বাংলা সৌরসনকে ভিত্তি করে এটার সূচনা।
আগে মুগল সম্রাটরা রাজস্ব আদায়ের জন্য হিজরি বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করতেন। কৃষকদের জন্যে হিজরি বর্ষপঞ্জির ব্যবহার ছিল ত্রুটিপূর্ণ। চান্দ্র ও সৌরবর্ষের মধ্যে ১১/১২ দিনের ব্যবধান থাকায় ৩০ সৌরবর্ষে হতো ৩১ চান্দ্র বর্ষ। সেসময় রাজস্ব আদায় হতো চান্দ্র বর্ষ অনুযায়ী, কিন্তু ফসল সংগ্রহ হতো সৌর বর্ষ অনুযায়ী। তাই মোগল সম্রাট জালালুদ্দীন মুহাম্মদ আকবর তার রাজত্বের শুরু থেকেই দিন-তারিখ গণনার একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, কর্মোপযোগী ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি চালুর জন্যে বর্ষপঞ্জি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
এ উদ্দেশ্যে তিনি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে প্রচলিত বর্ষপঞ্জিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের দায়িত্ব দেন। তার প্রচেষ্টায় ৯৬৩ হিজরীর মহররম মাসের শুরু থেকে বাংলা বর্ষের ৯৬৩ অব্দের সূত্রপাত হয়। যেহেতু ৯৬৩ হিজরীর মহররম মাস বাংলা বৈশাখ মাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, সেহেতু চৈত্র মাসের পরিবর্তে বৈশাখ মাসকেই বাংলা বর্ষের প্রথম মাস করা হয়। চৈত্র ছিল বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস, যা সেসময় ব্যবহৃত হতো।
বাংলা সনের জন্মলগ্ন থেকে নববর্ষের উৎসব বাংলার গ্রামীণ জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে গ্রামের সাধারণ মানুষ ও কৃষকদের কাছে দিনটি তাৎপর্যপূর্ণ। জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ায় খাজনার দায় পরিশোধের বিষয়টি না থাকলেও সামর্থ্য মতো সারা বছরের ধার-দেনা পরিশোধ করে নতুন বছরে নতুন জীবন শুরু করার অভিপ্রায় সব কৃষকের মনেই জাগরুক থাকে।
অনেক আগে কৃষিজীবী মানুষ নতুন ফসল ঘরে উঠানোর সময় নবান্ন উৎসব করতো। যৌথতা ও সামষ্টিক বোধের কারণে এ উৎসবে অংশ নিত কৃষক-কামার-কুমার-তাঁতি-জেলে-ধোপা-নাপিতসহ সব শ্রেণি পেশার মানুষ।
বাংলাদেশে প্রকৃতপক্ষে নববর্ষ উৎসব ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করে বাংলার নব্য অভিজাত, উচ্চবিত্ত জমিদার ও মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীদের পুণ্যাহ, হালখাতা প্রভৃতি উৎসবকে কেন্দ্র করে। মূলত এ উৎসবের অগ্রযাত্রা শুরু হয় বাংলার কৃষকের রক্ত শোষণের মধ্য দিয়ে। পুণ্যাহ উৎসবে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে অনেক কৃষককে সর্বস্বান্ত হয়ে জমিদারের সারা বছরের খাজনা আদায় করতে হতো। কিন্তু এতে জমিদারের উৎসবে কোনো ভাটা পড়েনি। জমিদারের বাগান বাড়িতে হালখাতার উৎসবে, পায়রা উড়ানো, ঘুড়ি উড়ানো, ঘোড়দৌড়, ষাড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই -এর মতো নানা উৎসবে অপব্যয়ের বন্যা বয়ে যেত। জমিদার ব্যবসায়ীদের এসব উৎসবের পাশাপাশি আঙিনা সংলগ্ন স্থানে জনগণের চিত্ত বিনোদনের উদ্দেশ্যে যাত্রা, খেউর, টপ্পা, বাউল, কীর্তন, মারফতি, মুর্শিদি প্রভৃতি গানের আসর বসিয়ে দিত তারাই। এ সময় আসর চলত একদিন, দুইদিন, সাত দিন যাবত। এমনিভাবে এসব উৎসবকে ঘিরে গড়ে উঠত গ্রামীণ মেলা।
কৃষকরা নববর্ষে বাড়িঘর পরিষ্কার রাখে, কৃষি ও ব্যবহার্য সামগ্রী ধোয়ামোছা করা, গবাদি পশুর জন্য প্রচুর পরিমাণ খাওয়া রেডি রাখা। সেদিন মাঠে পারতপক্ষে কাজ না করা এবং সকালে গোসল সেরে পুত পবিত্র হয়ে সেজে গুজে দিন অতিবাহিত করা। এদিনটিতে বিশেষ ভালো খাওয়া, ভালো থাকা, ভালো জামা কাপড় পরতে পারা এবং প্রতিবেশীদের সাথে পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় রাখতে পারাকে তারা ভবিষ্যতের জন্যে মঙ্গলজনক মনে করে।
একে অপরের সাথে নববর্ষের বিশুদ্ধ শুভেচ্ছা বিনিময় চলে। এছাড়া নববর্ষকে আরও উৎসবমুখী করে তোলে বৈশাখী মেলা। সর্বজনীন লোকজ এ মেলা অত্যন্ত আনন্দ ও উৎসবমুখর আমেজে উদযাপিত হয় দেশের বিভিন্ন গ্রাম-পল্লীতে বটতলায়, নদীর ঘাটে, হাটে, গঞ্জে। অবশ্য শহরাঞ্চলে এমেলা বসে নগর সংস্কৃতির আদলে, ভিন্ন আমেজে, ভিন্ন আঙিকে। কৃষকদের নববর্ষ পালন একটু ভিন্ন আমেজ আর শুভ সুন্দরের বারতা নিয়ে হাজির হয় প্রতি বছর বৈশাখের প্রথম লগনে।
দেশের ৩ পার্বত্য জেলা-রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে নববর্ষ উদযাপিত হয় ভিন্ন আঙ্গিকে। বাংলা বছরের শেষ দুদিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন-এ তিনদিন মিলেই বর্ষবরণ উৎসব পালিত হয় ওই তিন জেলায়। উপজাতীয়দের কাছে ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে এটি সবচেয়ে বড় উৎসব। প্রতিবছর আনন্দমুখর পরিবেশে পালিত এ উৎসবকে ত্রিপুরারা বৈসুক, মারমারা সাংগ্রাই এবং চাকমারা বিজু নামে আখ্যা দিলেও ঐতিহ্যবাহী এ উৎসব পুরো পার্বত্য এলাকায় ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িরা বৈসাবি উৎসবকে ৩ ভাগে পালন করেন। প্রথম দিনটির নাম ‘ফুলবিজু’। এ দিন শিশু কিশোররা ফুল তুলে ঘর সাজায়। দ্বিতীয় দিনটি হচ্ছে ‘মূলবিজু’। এ দিনে হয় মূলঅনুষ্ঠান। এদিন নানারকম সবজির সমন্বয়ে একধরনের নিরামিষ রান্না করা হয়, যার নাম পাঁজন। এটি বৈসাবির অন্যতম একটি আকর্ষণীয় খাবার। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠা ও মিষ্টান্নও তৈরি করা হয়। অতিথিদের জন্য এদিন সবার ঘরের দরজা খোলা থাকে জাতি-ধম-বর্ণ নির্বিশেষে। নতুন বছরের প্রথম দিনকে বলা হয় ‘গজ্যা পজ্যা’।
গত দুদিনের আনন্দময় ক্লান্তি নিয়ে এদিনটি সবাই কাটায় অনাবিল আয়েশে। এ তিনদিন জুমিয়া কৃষকরা বৈষয়িক ও চাষাবাদের কাজ থেকে নিজেদেরকেমুক্ত রাখে। নতুন বছরে সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি ও ভালো ফসল কামনায় নিকটবর্তী বৌদ্ধ মন্দিরে প্রার্থনালয়ে প্রার্থনা সভায় মিলিত হয়। শোনেন বৌদ্ধের অমেয় শ্লোক বাণী।
একটি বছর শেষ হলেই যথানিয়মে আসে নতুন বছর। সময়ের ধারাবাহিকতায় পুরাতন বছরের ভুল-ত্রুটি, ব্যর্থতা ও গ্লানি ভুলে সবাই নতুন বছরকে বরণ করে নেয় ভবিষ্যত সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায়। সকল পেশাজীবী জনগোষ্ঠির মধ্যে আমাদের কৃষকরাও বাংলা নববর্ষে নতুন উদ্দীপনা নিয়ে এগিয়ে যায় পেশাগত সাফল্যের দিকে।
বাংলা নতুন বছরে নতুন অঙ্গীকারে আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি অনুসরণ ও নতুন নতুন প্রযুক্তি ও কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে নতুনভাবে আত্মনিয়োগ করে অধিক ফসল উৎপাদনে। বাংলা নববর্ষে সবার মতো কৃষকরাও আশা করে- প্রতিটি নতুন বছর উপহার দেবে অনাবিল প্রশান্তি, উজ্জ্বল ভবিষ্যত এবং সাফল্যময় ঝামেলাহীন সুন্দর জীবন।
লেখক: কবি ও গবেষক