লিবিয়ায় মানবপাচার ও জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় চক্রের তিন নারীসহ আটক ৪

0

 

স্টাফ রিপোর্টার ॥ লিবিয়ায় মানবপাচার ও জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় চক্রের হোতা রকিবুল ইসলাম ফরাজীসহ ৪ জনকে গত শনিবার আটক করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) যশোরের কর্মকর্তারা। লিবিয়ায় নড়াইলের দুই যুবককে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের মামলায় তাদেরকে আটক করা হয়। এর মধ্যে আটক দুই নারীর ইসলাম ব্যাংক যশোর শাখার অ্যাকাউন্টে এক মাসে মুক্তিপণের আদায় করা ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকার সন্ধান পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থাটি।
আটকরা হলেন নড়াইলের কালিয়া উপজেলার সাতবাড়িয়া গ্রামের মৃত আব্দুল গফুর ফরাজীর ছেলে রকিবুল ইসলাম ফরাজী (৫৭), যশোরের অভয়নগর উপজেলার ধুলগ্রামের আরশাদ আলীর স্ত্রী হাফিজা বেগম (৫৫), মেয়ে শিরিনা আক্তার (৩৫) ও সুমনা আক্তার (২৯)। এর মধ্যে শিরিনা আক্তার খুলনার ফুলতলা উপজেলার বেজেরডাঙ্গায় স্বামী দেলোয়ার হোসেনের বাড়িতে বসবাস করেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই যশোরের এসআই হাবিবুর রহমান জানান, নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চন্দ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা রবিউল ইসলাম মৃধা তার ছেলে নাইম মৃধা (২৫) ও ভাগ্নে জহিরুল ইসলামকে (২৫) একই উপজেলার কদমতলা গ্রামের নুর মিয়া শেখের ছেলে রবিউল ইসলাম শেখের মাধ্যমে গত ১১ ফেব্রুয়ারি বৈধভাবে লিবিয়ায় পাঠান। সেখানে যাওয়ার পর নাইম ও জহিরুল ফোন করে রবিউল ইসলাম মৃধাকে জানান, কালিয়ার সাতবাড়িয়া গ্রামের এক ব্যক্তি তাদেরকে বেশি বেতনে লিবিয়া থেকে ইতালিতে পাঠিয়ে দিতে পারবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। ইতালিতে গেলে তাদের মাসিক বেতন হবে ১ লাখ টাকা। লিবিয়ায় অবস্থানকারী ওই ব্যক্তিও রবিউল ইসলাম মৃধাকে ফোন করে নাইম ও জহিরুলকে নিরাপদে ইতালিতে পাঠিয়ে দিতে পারবেন মর্মে আশ^স্ত করেন। অজ্ঞাত ওই ব্যক্তির পরিচয় জানতে না পারায় রবিউল ইসলাম মৃধা তার প্রস্তাবে রাজী হননি। এ ঘটনার ৫/৬ দিন পর লিবিয়া থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে রবিউল ইসলাম মৃধাকে ফোন করে জানান যে, তারা নাইম ও জহিরুলকে আটকে রেখেছেন এবং তাদের মারধর করছেন। এমনকি তারা হুমকি দিয়ে বলেন,‘আপনার ছেলে এবং ভাগ্নেকে বাচাঁতে হলে আমাদের দেওয়া বিকাশ নম্বর এবং ব্যাংকের হিসাব নাম্বারে টাকা পাঠাতে হবে। অন্যথায় তাদের খুন করে ফেলা হবে’। পরবর্তীতে রবিউল ইসলাম মৃধা ছেলে ও ভাগ্নের জীবন বাঁচাতে গত মার্চের বিভিন্ন তারিখে জিম্মিকারীদের দেয়া ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড যশোর শাখার ২টি অ্যাকাউন্টে এবং বিকাশ নম্বরে ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন। কিন্তু জিম্মিকারীরা টাকা গ্রহণের পর থেকে আটকে রাখা নাইম ও জহিরুলের কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এ ঘটনায় রবিউল ইসলাম মৃধা নড়াইলের মানবপাচার প্রতিরোধ দমন ট্রাইব্যুনালে গত ২২ মে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে একটি মামলা করেন। রবিউল ইসলাম মৃধার সন্দেহ হয় তার ছেলে ও ভাগ্নেকে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের সাথে লিবিয়ায় নিয়ে যাওয়া রবিউল ইসলাম শেখ জড়িত। এ কারণে তিনি তাকে মামলায় আসামি করেন। পরে আদালতের আদেশে পিবিআই তদন্তকালে জিম্মিকারীদের দেয়া ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর সূত্র থেকে নিশ্চিত হন যে, মামলার আসামি রবিউল ইসলাম শেখ ঘটনার সাথে জড়িত নন। তবে তদন্তে এ ঘটনার সাথে উল্লিখিত ৪ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। এর প্রেক্ষিতে রবিউল ইসলাম মৃধা উল্লিখিত ৪ জনকে আসামি করে গত ৯ ডিসেম্বর কালিয়া থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেন।
তিনি বলেন, আদালতের মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলে কৌশল অবলম্বন করে রকিবুল ইসলাম ফরাজী, হাফিজা বেগম, শিরিনা আক্তার ও সুমনা আক্তারকে গত শনিবার সকালে পিবিআই যশোর অফিসে আসতে বলা হয়। আদালতের মামলায় কোনোকিছু হবে না ভেবে তারা পিবিআই অফিসে এলে তাদেরকে কালিয়া থানায় দায়ের করা মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের মামলায় আটক করা হয়। পরে আটকদের নড়াইলে আদালতে সোপর্দ করা হলে এর মধ্যে হাফিজা বেগম, শিরিনা আক্তার ও সুমনা আক্তার ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমাতুল মোর্শেদা তাদের জবানবন্দি গ্রহণ করেন। এছাড়া অপর আটক রকিবুল ইসলাম ফরাজীর আদালতে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়েছে।
পিবিআই’র ওই কর্মকর্তা জানান, আটক রকিবুল ইসলাম ফরাজী মানবপাচার ও মুক্তিপণ আদায় চক্রের মূল হোতা। তিনি লিবিয়াতে ছিলেন। সম্প্রতি দেশে ফিরে এসেছেন।
এসআই হাবিবুর রহমান বলেন, সুমনা আক্তার বেজেরডাঙ্গায় ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এজেন্ট ব্যাংক পরিচালনাকারীর অধীনে চাকরি করেন। ওই এজেন্ট ব্যাংক পরিচালক আটক রকিবুল ইসলাম ফরাজীর পূর্ব পরিচিত। সেই সূত্রে সুমনা আক্তারের সাথে রকিবুল ইসলাম ফরাজীর পরিচয় ঘটে। সুমনা আক্তারের মা হাফিজা বেগম ও বোন শিরিনা আক্তারের ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড যশোর শাখায় পৃথক দুটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। ওই দুটি অ্যাকাউন্ট নম্বরে জিম্মিকারীদের কথা মতো টাকা দিয়েছিলেন নাইমের পিতা রবিউল ইসলাম মৃধা। পরে আটক রকিবুল ইসলাম ফরাজীর পরামর্শ অনুযায়ী সেখান থেকে টাকা উত্তোলন করে অন্য কয়েক ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেন সুমনা আক্তার। তিনি আরো বলেন, ওই দুটি অ্যাকাউন্ট নম্বরে মার্চ মাসে ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে। এই টাকা মানবপাচার ও মুক্তিপণ চক্রের বলে তারা সন্দেহ করছেন।