মোবাইল ফোনের সূত্র ধরেই নিখোঁজ কলেজ ছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পিবিআই

0

 

মীর মঈন হোসেন মুসা ॥ কলেজছাত্র একরামুল হোসেন ওয়াজ মাহফিল শোনার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন। কিন্তু এরপর আর বাড়ি ফিরে না আসায় দ্ইুদিন পর থানায় জিডি করেন তার মা রেশমা বেগম। তিনি যশোরের মণিরামপুর উপজেলার ভরতপুর গ্রামের মফিজুর মোল্লার স্ত্রী। এই জিডি তদন্ত করতে গিয়ে একটি মোবাইল ফোনসেটের সন্ধান পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মোবাইল ফোনসেটটি নিখোঁজ কলেজছাত্রের না হলেও এর ভেতর তারই ব্যবহৃত সিমকার্ড ঢোকানোর অস্তিত্ব পায় তদন্ত সংস্থা। ওই মোবাইল ফোনসেটের সূত্র ধরে ব্যবহারীকে আটক এবং তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে নিখোঁজ কলেজছাত্রের মাটিচাপা দেয়া লাশ উদ্ধার করে তারা। প্রবাসীর স্ত্রীর সাথে পরকীয়া সম্পর্কের কারণে তাকে হত্যা করা হয় বলে পরে জানতে পারে পিবিআই। কীভাবে সেই মোবাইল ফোনসেটের ভেতর সিমকার্ডের অস্তিত্ব পাওয়া যায় এবং নিখোঁজ কলেজছাত্র ইকরামুলের লাশ উদ্ধারের সেই কাহিনী সম্পর্কে পিবিআই’র এসআই সৈয়দ রবিউল ইসলাম পলাশ জানান, একরামুলের পিতা মফিজুর মোল্লাও প্রবাসী। চলতি বছরের ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় ভরতপুর দক্ষিণপাড়ায় ওয়াজ মাহফিল শোনার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন একরামুল। কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরে না আসায় এবং অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোনো সন্ধান না পেয়ে ৩০ মার্চ তার মা রেশমা বেগম থানায় জিডি করেন। জিডি তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই। তদন্তকালে তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে জানা যায়, ২৮ আগস্ট রাত ৮টার পর থেকে একরামুলের মেবাইল ফোন নম্বরটি বন্ধ ছিলো। কিন্তু পরদিন ২৯ মার্চ দুপুরে অপর একটি মোবাইল ফোনসেটে তার নম্বরটি ঢোকানোর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। তাও আবার কিছু সময়ের জন্য। ট্র্র্যাকিং করে বেনাপোলে লোকেশন পাওয়া যায়। পরে একই সেটে আরও ২টি নম্বর ব্যবহারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পরবর্তীতে কললিস্ট তুলে দেখা যায়, মোবাইল ফোনসেট এবং ব্যবহারকারী সিমকার্ড দুটির মালিক আমিনুর নামে এক ব্যক্তি। তিনি মণিরামপুর উপজেলার ভরতপুর গ্রামের হোসেন আলী মোড়লের ছেলে। ৩১ মার্চ সকালে তার বাড়িতে হাজির হয়ে নিখোঁজ একরামুল সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু কিছুই জানেন না বলে জানালে আমিনুরের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনসেটের আইএমইআই নম্বর এবং নিখোঁজ একরামুলের সিমকার্ড ঢোকানো ফোনসেটের আইএমইআই নম্বর একই বলে তাকে জানানো হয়। সেই সাথে আমিনুরের কাছ থেকে তার মোবাইল ফোনসেটটি নেয়া হয়। ফলে ধরা পড়ে গেছে বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসাবাদে আমিনুর স্বীকার করেন যে, তারা একরামুলকে হত্যা করেছেন। কেন কী জন্যে হত্যা করা হলো সেই সম্পর্কে আমিনুরের ভাষ্য, তার ভাই কামরুল কুয়েতে চাকরি করেন। হত্যাকাণ্ডের ৫ মাস আগে কামরুল দেশে ফিরে আসেন। তার স্ত্রী হীরা খাতুনের সাথে পরকীয়া সম্পর্ক ছিলো একরামুলের। পরিবারের মানসম্মান রক্ষার্থে গোপনে একরামুলের সাথে দেখা করে এপথ থেকে সরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন আমিনুর। কিন্তু একরামুল উল্টো আমিনুরকে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, তাদের সম্পর্কের ধারণকৃত ভিডিও তার মোবাইল ফোনে আছে। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য আমিনুরকে নিষেধ করেন একরামুল। ফলে কোনো উপায় না পেয়ে একরামুলের কাছ থেকে মোবাইল ফোন সেট নিয়ে ওই আপত্তিকর ভিডিও ডিলিট করে দেয়ার পরিকল্পনা করেন আমিনুর। ঘটনার দিন অর্থাৎ ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় আমিনুর তার ভাইপো মেহেদীর কাছ থেকে জানতে পারেন, একরামুল নোয়ালী গ্রামের কাড়াখালী ব্রিজের ওপর অবস্থান করছেন। এ খবর পেয়ে আমিনুর বৈদুতিক তার নিয়ে গোপনে সেখানে যান। এরপর কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে গলায় বৈদ্যুতিক তার পেঁচিয়ে একরামুলকে তার কাছে থাকা মোবাইল ফোনসেটটি দিতে বলেন আমিনুর। কিন্তু এরই মধ্যে বৈদ্যুতিক তার গলায় পেঁচিয়ে ধরার কারণে শ্বাসরোধে মারা যান একরামুল। পরে লাশটি ব্রিজের পাশে রেখে বাড়িতে চলে আসেন তিনি এবং সকল ঘটনা ভাই কামরুলকে জানান। এ কথা শুনে কামরুল ভয় পেয়ে তাকে প্রচণ্ড বকাঝকা করেন। পরে দুই সহোদর ঘটনাস্থলে যান এবং লাশ বস্তাবন্দি করে মোটরসাইকেলে উঠিয়ে বাড়ি থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে মদনপুর গ্রামের জনৈক লিয়াকত আলীর পুকুর পাড়ে মাটিতে পুঁতে রাখেন। নিহত একরামুলের মোবাইল ফোনসেট লক থাকায় ওপেন করতে পারেননি আমিনুর। এ কারণে সিমকার্ড বের করে নেন এবং মোবাইল ফোনসেটটি ফেলে দেন। পরদিন দুপুরে বেনাপোলে যান আমিনুর। সেখানে যাওয়ার পর নিজের ফোনসেটের ভেতর নিহত একরামুলের সিমকার্ড কিছু সময়ের জন্য ঢোকান। তার উদ্দেশ্য ছিলো, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিখোঁজ একরামুলের সন্ধানে হয়ত তার ফোন নম্বর ট্র্যাকিং করবে। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বুঝে নেবে, একরামুল বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে গেছে। কিন্তু নিজের ফোনসেটে একরামুলের সিমকার্ড ঢোকানোর কারণে শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান আমিনুর। পরে তারই স্বীকারোক্তিতে নিখোঁজ একরামুলের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে জীবিত নয়, পাওয়া যায় তার লাশটি।