থামানো যাচ্ছে না সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নদী-খালে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের প্রবণতা

0

 

মনিরুল হায়দার ইকবাল, মোংলা (বাগেরহাট)॥ সুন্দরবনের গহীনের বিভিন্ন নদী-খালে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের প্রবণতা কিছুতেই থামছে না। মাছের প্রজনন মৌসুম শেষ হওয়া চলতি মাসের শুরুতে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে মৎস্য মাছ আহরণের অনুমতি দেওয়া হয়। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দুবৃত্তরা বনের অভ্যন্তরে অভয়ারণ্যের খাল ও জলাভূমিতে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকার লিপ্ত হচ্ছে। সংঘবদ্ধ মৎস্য দুর্বৃত্ত চক্রটি বিভিন্ন উপায়ে এভাবে মাছ শিকার করতে গিয়ে ধ্বংস করছে মাছসহ জলজ প্রাণীদেরকে। বিষাক্ত করছে নদী ও খালের পানি। ইতোমধ্যে জাল-নৌকাসহ এ চক্রের একাধিক সদস্য আটক হলেও ম্যানগ্রোভ বনের মৎস্য ভান্ডারে তাদের আগ্রাসন কিছুতেই থামছে না। বিষ প্রয়োগের কারণে এখন সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী-খালে মরা মাছ ভাসতে দেখা যাচ্ছে। বনের চাঁদপাই রেঞ্জের শুয়ারমারা ও কাটাখালী খালের পানিতে গত সপ্তাহে বিভিন্ন প্রজাতির মরা মাছ ভেসে ওঠার দৃশ্য চোখে পড়ে বনরক্ষী ও স্থানীয়দের। এ ঘটনায় তদন্তে গঠন করা হয়েছে ৩ সদস্যের কমিটি। এ অবস্থায় ম্যানগ্রোভ বনের মৎস্য সম্পদ সহ বনের প্রাণীকূল ও প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ম্যানগ্রোভ এ বনের নদী ও খাল নানা প্রজাতির মাছের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে খ্যাত। সাম্প্রতিক সময় সুন্দরবনের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশকারী দুর্বৃত্ত চক্রের অপতৎরতা বেড়েই চলছে। তারা অতিলোভের আশায় বনের মৎস্য প্রজনন ছোট-বড় খালে বিষ দিয়ে মাছ ধরছে।
দুর্বৃত্তদের দেয়া বিষে মাছ মরে ভাসছে বলে জানিয়েছে বনবিভাগ। তাদেরকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় নেওয়ার প্রচেষ্টা চলাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট বন কর্মকর্তারা। সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধারা স্টেশন কর্মকর্তা মো. শাহজাহান জানান, গত সপ্তাহে কোনো ধরনের পাস-পারমিট ছাড়া গোপনে ঢুকে বনের উলুবুনিয়া খালের নলবুনিয়া এলাকায় বিষ দেয় একদল দুর্বৃত্ত। দুর্বৃত্তদের দেওয়া বিষে খালের ওই এলাকায় মরা ট্যাংরা ও দাতিনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ভাসতে দেখা গেছে।
বন কর্মকর্তা মো. শাহজাহান বলেন, এ দুর্বৃত্ত চক্রের মূল হোতা আলমগীর ওরফে খোকনকে শনাক্ত করা হয়েছে। খোকনের বাড়ি বন সংলগ্ন হোগলাবুনিয়া গ্রামে। তাকেসহ তার অপর সহযোগীদের ধরতে বনবিভাগের তৎপরতা চলছে বলেও জানান তিনি। বনের অভ্যন্তরে মৎস্য দুবৃর্ত্ত চক্রের আনাগোনা এবং প্রবণতা বৃদ্ধিতে চরম হতাশার মধ্যে স্থানীয় সাধারণ জেলে ও পেশাজীবীরা।
বনবিভাগের তথ্য মতে, ২০২১ সালে সুন্দরবনের পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের বনরক্ষী, কোস্টগার্ড ও পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে অনুপ্রবেশকারী অপরাধী চক্রের অন্তত ১৮ থেকে ২০টি চালান জব্দ করে। এ সময় আটক হয় বন অপরাধী চক্রের সক্রিয় দু’ডজনের বেশি সদস্য। উদ্ধার হয় তাদের ব্যবহৃত নৌকা-ট্রলার, জাল, ব্যবহার নিষিদ্ধ তরল ও পাউডার বিষ, বিষ দিয়ে আহরিত মাছ, হরিণের মাংস, চামড়াসহ বিভিন্ন অঙ্গ প্রতঙ্গ।
চলতি বছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত আটক হয়েছে বিষ প্রয়োগকারী দুর্বৃত্ত চক্রের ১১ সদস্য। এ বছর জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত মৎস্য প্রজনন মৌসুমে ৩ মাস বন্ধ রাখা হয় মৎস্য আহরণসহ পর্যটন খাতও। চলতি মাসের ১ সেপ্টেম্বর সুন্দরবন উম্মুক্ত হলে শুরু হয় পর্যটন সহ মৎস্য আহরণ মৌসুম। মৌসুম শুরু হতে না হতেই গত ১৩ সেপ্টেম্বর সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া এলাকা থেকে বিষ প্রয়োগকারী চক্রের ৮ সদস্যকে আটক করে বনবিভাগ। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় ৪টি জাল, ৩টি নৌকা ব্যবহার নিষিদ্ধ ভারতীয় কীটনাশক ও বিষ প্রয়োগে আহরিত মাছ।
সুন্দরবনের নদী-খালে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের প্রবনতা প্রসঙ্গে সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, বনের জলাভূমিতে কীটনাশক(বিষ) প্রয়োগের কারণে মাছের প্রজনন সহ জলজ প্রাণী ধ্বংস হচ্ছে। আর বিষাক্ত মাছ খেয়ে পাখি ও প্রাণীসহ পানি পানে রোগাক্রান্ত হচ্ছে বনের অন্যপ্রাণীরা। এ অবস্থায় মৎস্য সম্পদ এবং বনের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি।
এ দিকে সুন্দরবনের নদী-খালে বিষ প্রয়োগ মরা মাছ ভেসে ওঠার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বাগেরহাট জেলা সমন্বয়কারী নুর আলম শেখ বলেন, এ ম্যানগ্রোভ বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ, মৎস্য ও প্রাণীকূলসহ অফুরন্ত সম্পদ সুরক্ষায় অনুপ্রবেশকারী দুবৃর্ত্ত চক্রের আগ্রাসন বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ জরুরি।
এ প্রসঙ্গে পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক শহিদুল ইসলাম হাওলাদার জানান, বন কেন্দ্রিক অপরাধী চক্রের তৎপরতা দমনে নানা কৌশলসহ কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, সুন্দরবনের শুয়ারমারা ও কাটাখালী এলাকায় খালের পানিতে মরা মাছ ভেসে ওঠার ঘটনা তদন্তে বিভাগীয় বন কর্মকর্তার নির্দেশনায় ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিতে রয়েছেন-চাঁদপাই স্টেশন কর্মকর্তা ফরেস্টার ওবায়দুর রহমান, জোংড়া টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন ও বনরক্ষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. মিজানুর রহমান। গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়নি।