খুলনা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট পরিচালনার অভিযোগ ঠিকাদারদের

0

মো. জামাল হোসেন,খুলনা॥ খুলনায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডিতে অনিয়ম, ঘুষ, কমিশন বাণিজ্য ও দুর্নীতির সিন্ডিকেট বিভিন্নভাবে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের তহবিলের ও ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে এলজিইডির তালিকাভুক্ত ঠিকাদারদের কাছ থেকে নানান খাত ও অজুহাত দেখিয়ে অবৈধভাবে ৩শতাংশ থেকে ১০শতাংশ কমিশন নেওয়া, ঠিকাদারদের নাম ব্যবহার করে অফিসের মেরামতসহ বিভিন্ন কাজ অফিসের কর্মচারীদের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যেনতেনভাবে করিয়ে অর্থ আত্মসাত ও বিল দিতে কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রতিকার ও বিচার দাবি করে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)সহ বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক ঠিকাদার লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।
এলজিইডি অফিসের এই ঘুষ, কমিশন বাণিজ্য ও দুর্নীতির সিন্ডিকেটে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে হিসাব সহকারী মো. আমিরুল ইসলাম, মাস্টাররোল কর্মচারী কার্য-সহকারী নাসির উদ্দিন, ম্যাকানিক্যাল ফোরম্যান নরেশ চন্দ্রসহ ৬/৭জন আস্থাভাজন সরাসরি জড়িত রয়েছেন। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে গাড়ি, বাড়িসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন জড়িতরা।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের অক্টোবরে খুলনা এলজিইডিতে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে মো. কামরুজ্জামান যোগদান করেন। এর পর থেকে তিনি অফিসের অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আস্থায় নিয়ে চরম অনিয়ম-দুর্নীতি শুরু করেন। ইতিমধ্যেই নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান খুলনা এলজিইডির সবগুলো প্রকল্প থেকে গত প্রায় দুই বছরে কমিশন ও ঘুষ নিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। কিনেছেন দামি গাড়ি, করেছেন বাড়িসহ অঢেল সম্পদ। তিনি তার দপ্তরের প্রতিটি কাজ থেকে ৩শতাংশ থেকে ১০শতাংশ কমিশন নিয়ে থাকেন। বিশেষ করে গত এক বছরে(২০২১-২২অর্থ বছর) কেবিএস-আরআইডিপি, কেডিআরআইডিপি, টিইউএলও বা থানা ইউনিয়ন ল্যান্ড অফিস নির্মাণ প্রকল্প, এফডিআরআইডিপি বা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, পিইডিপি-৪ বা প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প-৪, এনবিডিআইএনএনজিপিএস বা নতুন জাতীয়করণকৃত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উ্ন্নয়ন প্রকল্প, এনবিআইডিজিপিএস বা জাতীয়করণকৃত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প, সিআরএমআইডিপি বা বাজার উ্ন্নয়ন প্রকল্প (পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটাসহ ৪টি উপজেলা), ভিআরআরপি, আইআরআইডিপি-৩, ইউটিএমআইডিপি বা ননমিউনিসিপ্যাল অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, ইউএমসি বা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্প ও সিএএফডিআরআইআরপি বা ঘুর্ণিঝড় আম্ফান ক্ষতিগ্রস্থ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পসহ ১৩টি প্রকল্প থেকে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। এ সকল প্রকল্পে গত অর্থবছরে প্রায় এক হাজার ৯শ’ কোটি টাকার বরাদ্দ এসেছে বলে জানা গেছে।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে মোবাইল মেইন্টেনেন্স, আবাসিক ও অনাবাসিক ভবন মেরামত কাজ ঠিকাদারদের নাম দিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান নিজে যতসামান্য কাজ করে প্রায় ৫কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। এছাড়া মেকানিক্যাল ফোরম্যান নরেশ চন্দ্র সাহা জ্বালানি ও মোটরযান মেরামতের ভূয়া বিল করে আরো দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এমনকি সরকারি প্রতিটি রোলার বরাদ্দ নিলে ফোরম্যান নরেশ সাহাকে ঘুষ দিতে হয় ১০হাজার টাকা। আর রোলার চললে নরেশ সাহাকে প্রতিদিনের জন্য ৫’হাজার টাকা করে ঘুষ দিতে হয়। এভাবে গত ৪/৫বছর ধরে নরেশ চন্দ্র সাহা প্রায় ৫/৬কোটি টাকা ঘুষ হাতিয়ে নিয়েছেন। এরফলে সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। এছাড়া নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান দপ্তরের মাস্টাররোল কর্মচারী কার্যসহকারী নাসির উদ্দিন ও মাস্টাররোল কর্মচারী লিপিকা সাহাকে দিয়ে অফিসের আর্থিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করাচ্ছেন। একই সাথে টেন্ডার, চুক্তিপত্র, লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নকরণ, ইত্যাদি বিষয়ও তাদেরকে দিয়ে করাচ্ছেন নির্বাহী প্রকৌশলী। এ বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে বদলি করাচ্ছেন তিনি। ইতিমধ্যেই তার রোষানলে পড়ে কয়েকজনকে খুলনা সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন স্থানে বদলি হতে হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া গত ২০২০-২১ অর্থবছরের মেরামত কাজের ৩০লাখ টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরের আরও ৩০লাখ টাকার কাজ কোনো ঠিকাদারকে দিয়ে করেননি। নাম সর্বস্ব কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্যাড ব্যবহার করে নিজে ও তার সিন্ডিকেটের লোকজনকে দিয়ে নামমাত্র কাজ করে অধিকাংশ টাকা আত্মসাত করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান ২০২১ সালের ১৮মার্চ নির্বাহী প্রকৌশলীর অফিস ভবন মেরামত ও সংস্কার কাজের জন্য ১৫লাখ ৫০হাজার টাকার কাজ দেন ফাতেমা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ৭লাখ ৫০হাজার টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। যে টাকা তিনি এলজিইডির সরকারি ব্যাংক হিসাব (সোনালী ব্যাংক, সাউথ সেন্ট্রাল রোড শাখা,-চলতি হিসাব নং-৩৩০০১৪৯৬, নির্বাহী প্রকৌশলী, এলজিইডি, খুলনা) নম্বারে ২০২১ সালের ১০এপ্রিল জমা করেন। পরে তিনি ওই টাকা তুলে অন্য কাজ দেখিয়ে আত্মসাত করেন। এছাড়া মোবাইল মেইনন্টেনেন্স ও আবাসিক ও অনাবাসিক ভবন মেরামতের .জন্যে বরাদ্দকৃত টাকা মেসার্স সুন্দরবন এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স সাথী এন্ড ব্রাদার্স ও মেসার্স নূরজাহান এন্টারপ্রাইজ নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানের নামে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা নামমাত্র কাজ করে দুই অর্থবছরের বাকী টাকা আত্মসাত করেছেন।
এ কাজের বিষয়ে মেসার্স নূরজাহান এন্টারপ্রাইজের মালিক জাফর ইসলাম শান্ত জানান, তিনি কোনো মেরামত ও সংস্কার কাজ করেননি। তার নাম ব্যবহার করে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামানের আস্থাভজান মো. নাসির উদ্দিন করেছেন।
এছাড়া মেসার্স সুন্দরবন এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. মনজুর হোসেন লাবলু জানান, তিনিও গত ২০২০-২১ বা ২০২১-২২ অর্থবছরে কোনো মেরামত ও সংস্কার কাজ করেননি। তার লাইসেন্স ও প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান ও তার সিন্ডিকেটের সদস্য হিসাব সহকারী আমিরুল ইসলাম করেছেন। এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলেও জানান।
অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘ ২১বছরের মাস্টারোল কর্মচারী কার্যসহকারী মো. নাসির উদ্দিন সংবাদপত্রে এলজিইডির যেসব বিজ্ঞাপন থাকে তার বেশিরভাগ টাকার বিনিময়ে অখ্যাত সব পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এছাড়া বিজ্ঞাপন বিল দেয়ার সময়ও আবারও কমিশন নেন। নাসির উদ্দিনকে তার চাহিদামত টাকা না দিলে কোনো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় না। বিজ্ঞাপনের বিলের চেক দেওয়ার সময়ও নাসির উদ্দিন নির্দিষ্টহারে কমিশন নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
খুলনার স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকার একাধিক প্রতিনিধি অভিযোগ করেন,, এলজিইডিতে বিজ্ঞাপন প্রদানের ক্ষেত্রে নাসির উদ্দিনকে টাকা দিতেই হবে। যা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামানও অবগত। এছাড়া বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী মাস্টারোল কর্মচারী নাসির উদ্দিনকে দিয়েই ঠিকাদারদের পাসবই, চুক্তিপত্র ইত্যাদির কাজ করিয়ে থাকেন। এ কারণে ঠিকাদাররা নাসিরকে কমিশন দিতে বাধ্য হন। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নাসির উদ্দিনও কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেনবলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
অনিয়ম, ঘুষ, কমিশন বাণিজ্য ও দুর্নীতির বিষয়ে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মাস্টারোল কর্মচারী নাসির উদ্দিন। তবে তিনি তার বিষয়ে আরও খোঁজ খবর নেয়ার অনুরোধ করেন। হিসাব সহকারী মো: আমিরুল ইসলামের সাথে কথা বলতে তার মোবাইলে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুজ্জামান অনিয়ম, ঘুষ, কমিশন বাণিজ্য ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কোন কথা বলেননি। তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে এ বিষয়ে কথা বলতে তার অফিসে দেখা করার জন্যে অনুরোধ জানান।