কলারোয়ায় টিআর কাবিখা কাবিটার কোটি টাকা হরিলুুটের অভিযোগ

0

 

কলারোয়া(সাতক্ষীরা) সংবাদদাতা ॥ সাতক্ষীরার কলারোয়ায় টেস্ট রিলিফ (টিআর), কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) ও কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) প্রকল্পের কাজ কাগজে কলমে শতভাগ দেখিয়ে কোটি টাকারও বেশি হরিলুট হয়েছে বলে অভিযোগ। কোথাও ১০ শতাংশ কোথাও ২০ শতাংশ, কোথাও মোটেও কাজ না করেই বরাদ্দের টাকা আত্মসাৎ করেছেন প্রকল্পের সভাপতিসহ সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্পের কাজে তদারকির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারাও এই অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার ও গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির আওতায় কলারোয়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়নে ২৬৬টি প্রকল্পের অনুকূলে স্থানীয় এমপি কোটাসহ মোট ৩ কোটি ৬১ লাখ ২৭ হাজার ৩০ টাকার বরাদ্দ পায়। যার গত ৩০ জুন মেয়াদ শেষ হয়। এর মধ্যে উপজেলার জয়নগর, জালালাবাদ, কয়লা, কুশোডাঙ্গা, দেয়াড়া ও যুগিখালি ইউনিয়নে এমপির অনুকূলে টিআর, কাবিখা, কাবিটাসহ ১ম, ২য় ও ৩য় পর্যায়ে টিআরের ৬৭টি প্রকল্পের আওতায় ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার ৫২৪ টাকা ও কাবিটার ৪২টি প্রকল্পে ৬৫ লাখ ৯৯ হাজার ৪৪৮ টাকা এবং কাবিখার ৪টি প্রকল্পে ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ পায়। এ ছয়টি ইউনিয়নে মোট ১১৩টি প্রকল্পের অনুকূলে ১ কোটি ৩৪ লাখ ৩৩ হাজার ৯৭২ টাকা বরাদ্দ পায়। যার বেশিরভাগ প্রকল্প কাগজে-কলমে শতভাগ কাজ দেখিয়ে প্রায় কোটি টাকার গায়েব করা হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার ১নং জয়নগর ইউনিয়নের খোরদো বাটরা নগেন কবিরাজের বাড়ি হতে বিল অভিমুখে মাটি রাস্তা সংস্কারে (টিআর) ১ লাখ ২৪ হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও সিটেফোঁটা মাটিও ফেলা হয়নি রাস্তায়। জয়নগর শীতলতলা হতে কপোতাক্ষ নদী অভিমুখে রাস্তা মাটি দ্বারা সংস্কার ও ইটের সোলিংকরণে ২ লাখ টাকার কোন কাজ হয়নি। উত্তর জয়নগর দক্ষিণপাড়া মসজিদের হতে পশ্চিমে কামালের ডিপ অভিমুখে মাটির রাস্তা সংস্কারে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকারও কোন কাজ করা হয়নি বলে ওইসব এলাকার বাসিন্দা সন্তোষ গুপ্ত, ফুলকুমারী, আব্দুল মান্নান, তানজিলা ও মুকুলসহ অনেকে জানান।
প্রকল্পগুলোর সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান বিশাখা সাহা বলেন, কম বেশি কাজ করছি। সেটা লেখেন। বিগত চেয়ারম্যানরাতো কোন কাজই করেনি।
এভাবে ওই ইউনিয়নে বিভিন্ন রাস্তা ও প্রতিষ্ঠানের নামে মোট ১৮টি প্রকল্প অধিকাংশ কাজ না করে কাগজে কলমে শতভাগ কাজ দেখিয়ে দেখিয়ে সরকারের বরাদ্দকৃত টাকা হরিলুট করা হয়েছে।
২নং জালালাবাদ ইউনিয়নের আহসাননগর কাদেরের বাড়ি হতে আতিয়ারের বাড়ির অভিমুখে মাটির রাস্তা সংস্কারে (১.৩০০ মেট্রিক টন চাল) যার ১০ শতাংশ কাজ হয়েছে। ওই একই রাস্তায় ৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকার আরেকটি প্রকল্প দেখিয়ে মোটেও কাজ না করে গায়েব করা হয়েছে।
প্রকল্পের সভাপতি সাবেক ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম বলেন, ওই কাজটি স্থানীয় চৌকিদার ও ইউপি মেম্বার দিয়ে করা হয়েছিলো।
একই ইউনিয়নের ফয়জুল্লাপুর শামসুর শেখের বাড়ি হতে কর্মকারপাড়া পর্যন্ত রাস্তার মাটি ভরাট ও ইটের সোলিংয়ে ২ লাখ টাকারও কোন কাজ করা হয়নি। এ প্রকল্পের সভাপতি আজিবর রহমান বলেন, কমবেশি কাজ করা হয়েছে। তবে মাটির অভাবে পরিপূর্ণ কাজ করতে পারিনি।
এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ সংস্কার ও আসবাবপত্র ক্রয়ে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকার কোন কাজ করেনি। এ বিষয়ে প্রকল্পের সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান নিশান বলেন, কমবেশি আসবাবপত্র ক্রয় করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে সেগুলো রংও করা হয়ে গেছে।
এভাবে এ ইউনিয়নেও ১৮টি প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ না করে টাকাগুলো নয়ছয় করে আত্মসাৎ করা হয়েছে।
প্রকল্প এলাকার বাসিন্দা, রিজিয়া খাতুন, আকরাম হোসেন, নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক এক ইউপি সদস্যসহ অনেকে বলেন, এসব প্রকল্পে এ বছর কোন কাজ হয়নি বা পরিষদে কোন আসবাবপত্র ক্রয় করা হয়নি।
৩নং কয়লা ইউনিয়নে বিভিন্ন রাস্তা ও প্রতিষ্ঠানের নামে ২২টি প্রকল্প দেখিয়ে কমবেশি কাজ দেখিয়ে অধিকাংশ টাকা হরিলুট করা হয়েছে। বিশেষ করে ওই ইউনিয়নের কুমারনল আনারুলের বাড়ি হতে আয়ুব সরদারের বাড়ি অভিমুখে এজিংয়ের দুই পাশে মাটি ভরাটে ৪.০৩৬৭ মেট্রিক টন (চাল), কুমারনল ইব্রাহিম পাড়ের বাড়ি হতে নুরইসামের বাড়ি অভিমুখে মাটির রাস্তা সংস্কারে ২ লাখ ৪৩ হাজার ১০৮ টাকা, কুমারনল সবুজের মিল হতে সোহবান দফাদারের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মাটি দিয়ে ভরাট ও ইটের সোলিং করণে ২ লাখ টাকা, কুমারনল আজিবর মেম্বারের ডিপোর মোড় হতে মতিয়ার সরদারের বাড়ি অভিমুখে মাটি রাস্তা সংস্কারে ১৬.৫৫৫৪ মেট্রিক টনের (গম) কাজ মোটেও না করে সম্পূর্ণ টাকা বেমালুম হজম করে ফেলেছে।
কুমারনল গ্রামের রাজ্জাক সরদার, আক্তারুল ইসলাম ও হায়দার,ছাত্র আশিক, আব্দুল মাজেদসহ এলাকার অনেকে বলেন, প্রকল্পগুলোতে এ বছর কোন কাজ করা হয়নি।
এসব প্রকল্পের সভাপতি মুনছুর আলী বলেন, কাজ করা হয়নি। তবে কাজ করা হবে।
১০নং কুশোডাঙ্গা ইউনিয়নের শিবানন্দকাটি অরুপ ঠাকুরের বাড়ি হতে শ্মশান ঘাট রাস্তা সংস্কারে ২ লাখ ৬০ হাজার ৯০০ টাকা, শিবানন্দকাটি রফিকুলের বাড়ি থেকে মোবারকের বাড়ি অভিমুখে মাটির রাস্তা সংস্কারে ১ লাখ ৪৯ হাজার ২০০ টাকার কোন কাজ হয়নি বলে এলাকাবাসি অনিল, পরিতোষসহ অনেকেই জানান।
প্রকল্প দুটির সভাপতি লক্ষণ দে ও হাসিনা বলেন, যথারীতি কাজ করা হয়েছে।
এভাবে কুশোডাঙ্গা ইউনিয়নে ১৭টি প্রকল্পের অধিকাংশ অর্ধেক, সিকি ও সিটেফোঁটা কাজ করে টাকাগুলো হরিলুট করা হয়েছে।
১১ নং দেয়াড়া ইউনিয়নে ১৬টি প্রকল্পের মধ্যে পশ্চিম খোরদো বীর মুক্তিযোদ্ধা জাকির হোসেনের বাড়ি হতে ইদগাহ অভিমুখে মাটির রাস্তার সংস্কারে ২ লাখ ৯১ হাজার ৭০০ টাকা, দেয়াড়া ইউনিয়ন পরিষদে প্রবেশ দ্বারে সম্মুখে গেট হতে কার্পেটিং পর্যন্ত রাস্তা এইচবিবি করণে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৮০০ টাকা, কাশিয়াডাঙ্গা খোদাবক্সের জমির পাশে ইটের সোলিংয়ের মুখ হতে বদরউদ্দীন মাস্টারের বাড়ি অভিমুখে রাস্তা সংস্কারে ৬.২০০ মেট্রিক টন (গম)।
পাকুড়িয়া শামসুদ্দীন মেম্বরের বাড়ি হতে বাওড় অভিমুখে রাস্তা মাটি দ্বারা সংস্কার ও ইটের সোলিংয়ে ৮ মেট্রিক টন (চাল), পাকুড়িয়া কালি মন্দির হতে সামাদের বাড়ি অভিমুখে মাটি দিয়ে সংস্কার ও ইটের সোলিংকরণে ২ লাখ টাকার কোন কাজ হয়নি।
তবে প্রকল্পগুলো কাগজে-কলমে শতভাগ কাজ দেখিয়ে সমুদয় টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে ওইসব এলাকার বাসিন্দা আমিরুল, আশরাফ, ছহিলুদ্দীন ও বদরউদ্দীন জানান।
প্রকল্পগুলোর সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান মফে ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান জানান, অন্য ইউনিয়নের তুলনায় তারা ভাল কাজ করেছেন।
এভাবে অবশিষ্ট ১০টি প্রকল্পের কাজ দায়সারা মতো করে কাগজে কলমে শতভাগ দেখিয়ে সমুদয় টাকাগুলো উঠিয়ে খেয়ে ফেলেছে।
এদিকে উপজেলা ১২ নং যুগিখালী ইউনিয়নে ২২টি প্রকল্পের মধ্যে ২/১টি বাদে অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ মোটামুটি করা হয়েছে বলে দেখা যায়।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি প্রকল্প এলাকার শুরুতে ও শেষে প্রকল্পের বিবরণ ও কমিটির তথ্য সম্বলিত সাইনবোর্ড থাকার কথা থাকলেও কোথাও কোনো সাইনবোর্ড লাগানো হয়নি। ফলে কোন রাস্তায় বা কোন প্রতিষ্ঠানে কত টাকার প্রকল্প বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবং কারা ওই প্রকল্পের সভাপতির দায়িত্ব কারা পালন করছেন তা এলাকার মানুষ জানেন না। এভাবেই কাগজে-কলমে প্রতিটি প্রকল্পে শতভাগ কাজ দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে সমুদয় টাকা হরিলুট করেছে বলে এরাকাবাসীর অভিযোগ।
তারা আরো বলেন, একই রাস্তায় দুই প্রকল্পও দেখানো হয়েছে এবং সেটা প্রতিবেদকের চোখেও পড়েছে।
সদ্য বদলী হওয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) বর্তমানে ঝিনাইদহ কালিগঞ্জে কর্মরত সুলতানা জাহান বলেন, কোনো প্রকল্পে কোনো অভিযোগ নেই, সঠিকভাবে কাজ করানো হয়েছে। যে প্রকল্প চলে গেছে তা নিয়ে আবার ঘাটাঘাটি করে কোনো লাভ আছে ?
বর্তমানে দায়িত্বপ্রাপ্ত পিআইও ওবাইদুল হক বলেন, এখানে আমি নতুন এসেছি। আমি কিছু বলতে পারবো না। আমার সময়ে যেসব প্রকল্পের বিল ছাড়া হয়েছে সেগুলো দেখেশুনে বিল ছাড়া হয়েছে।
সদ্য বদলী হওয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বর্তমানে নড়াইলের এডিসি জুবায়ের হোসেন চৌধুরী বলেন, আমার সময়ে প্রকল্পের বিল ছাড়া হয়েছে মোটামুটি কাজ দেখে। আমি চলে আসার পরের প্রকল্প সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পারবো না।
বর্তমান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুলি বিশ্বাস বলেন, যেসব প্রকল্প আপনাদের চোখে সমস্যা ধরা পড়েছে। সেগুলো উল্লেখ করে আমার কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। তারপর ওগুলো দেখে এসে আমি বক্তব্য দেব। এর আগে নয়।
এ বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, আমি শুনেছি টিআর-কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মও দুর্নীতি হয়েছে। এগুলো দেখার দায়িত্ব পিআইও ও ইউএনও সাহেবের। তবে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।