রাগ হলেই যাকে তাকে পেটান বাহারুল

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ খুলনার কয়রার উত্তরচক আমিনীয়া বহুমুখী কামিল মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাসুদুর রহমানকে মারধরের পর নতুন করে আলোচনায় এসেছেন সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম বাহারুল ইসলাম। একে একে তার বিরুদ্ধে উঠছে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ। এলাকাবাসী বলছে, ২০১৮ সালে কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার পর থেকে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বাহরুল। ক্ষমতাসীন দলের পদ-পদবি কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছেন প্রচুর সম্পদ। তবে তার পেটোয়া বাহিনীর ভয়ে নাম প্রকাশ করে মুখ খুলতে চান না ভুক্তভোগীরা।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়রা উপজেলা ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি এস এম বাহারুল ইসলামের। তখন তিনি সরকারি ব্রজলাল (বিএল) কলেজের ছাত্র। ২০০৯ সালে বাহারুল ইসলাম কয়রা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পর উপজেলার ৬৫টি মৎস্য ঘের দখলের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সাংবাদিকদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে সশস্ত্র দলবল নিয়ে হামলা চালান কয়রা উপজেলা প্রেস ক্লাবে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের মারধর, ভোটের দিন কেন্দ্র দখল, সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ ও গুলি ছোড়াসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বাহারুলের এসব অপকর্ম নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে প্রকাশ্যে মারধরের শিকার হন।
কয়রা উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাহারুল ইসলাম মূলত বেপরোয়া হয়ে ওঠে ২০০৯ সালে কয়রা উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পর। তার সঙ্গে স্থানীয় উচ্ছৃঙ্খল ১০ থেকে ১৫ যুবক থাকে। তাদের সঙ্গে নিয়ে এসব অপকর্ম করে বেড়ান বাহারুল। ২০১৮ সালে কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন তিনি। তাতে তার ক্ষমতা আরও বেড়ে যায়। এখন কয়রার মানুষ তার কাছে জিম্মি। তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস কারও নেই।’
২০০৯ সালে কয়রা উপজেলা প্রেস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন মোস্তফা শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে বাহারুল ইসলাম ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পর ঘের দখল করেছিল। তখন সাংবাদিকরা সংবাদ প্রকাশ করায় তার নেতৃত্বে প্রেস ক্লাবে হামলা হয়েছিল। ২১ দিন ক্লাব বন্ধ রেখেছিলাম। তখন খুলনা-৬ আসনের (কয়রা-পাইকগাছা) সংসদ সদস্য সোহরাব আলী সানা। আমরা তার কাছে এই বিষয়ে জানালাম। তিনি কোনোরকম সহযোগিতা করলেন না। এমন পরিস্থিতিতে মামলা করতেও সাহস পাইনি। তখন টিকে থাকাই আমাদের দায় হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতির শিকার ছিলাম আমরা।’
২০১৩ সালে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রলীগের গুলির ঘটনা ঘটেছিল উত্তর বেদকাশি কাছারি বাড়ি ঐতিহাসিক বটতলা বৃক্ষমেলায়। ওই ঘটনায় হওয়া মামলার আসামি ছিলেন বাহারুল ইসলাম। সেই সময়ে মেলা আয়োজন কমিটির সভাপতি ছিলেন সরদার নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গুলির ঘটনায় মামলা হয়েছিল। এটা নিজেদের দলীয় বিষয় তাই আর বলতে চাচ্ছি না। আমরা মামলা তুলে নিয়েছি।’
২০১৪ সালে বাহারুল ইসলাম হামলা চালিয়েছিলেন কয়রা উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মাওলা বক্সের ওপর। তিনি বলেন, ‘তখন আমি লোকসমাজ পত্রিকায় কাজ করতাম। নিরপেক্ষ সংবাদ করায় বাহারুল আমার ওপর হামলা করেছিল। তার ভয়ে পরে মামলা করতেও সাহস পাইনি। বাহারুল ওই সময়ে প্রচ- দুর্র্ধষ ছিল। তার হাতে মার খায়নি, কয়রায় এমন সাংবাদিক খুবই কম আছে।’
২০১৬ সালে বাহারুলের হাতে হামলার শিকার হয়েছিলেন কয়রা উপজেলার আরেক সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মতিউর রহমান। ২০২০ সালে তিনি মারা গেছেন। তার ছেলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বাহারুলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী শফিকুলের পক্ষে কাজ করেন। ভোটে শফিকুলের জয় হয়। সেই রাগে বাহারুল আমার বাবাকে মারধর করেছিল।’
২০২১ সালে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে পুনরায় নৌকার মনোনয়ন পান বাহারুল ইসলাম। এ নির্বাচনে ভোটের দিনে কেন্দ্র দখলের অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সাবেক চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘ভোটের দিন ৪নং কয়রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাহারুলসহ তার ছেলেরা গিয়ে অনেককে মারধর করেছিল। তখন ওই কেন্দ্রের ফল স্থগিত করেছিল নির্বাচনী কার্যালয়। দুই মাস পরে ওই কেন্দ্রে আবারও ভোট হয়েছিল।’
অল্প দিনে প্রচুর সম্পদ: অনুসন্ধানে ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৯ সালে সরকারি ব্রজলাল কলেজে পড়ার সময় ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন বাহারুল। তখন তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। টিনের একটি ঘর ছিল। বাবা আমিন হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন জায়গার বৈধ-অবৈধ জমির খবর রাখতেন। ক্ষমতাসীন দলকে ব্যবহার করে অবৈধভাবে জমি দখলসহ নানাভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। প্রতিবন্ধী স্কুলে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ৪০ জনের কাছ থেকে জনপ্রতি তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা নেন। কয়রা সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ভিপি তালিকাভুক্ত (অধিকাংশ হিন্দুদের) ৪০ বিঘা জমি তার বাবার নামে ডিসিআর কাটেন। ওই জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে অসহায়-গরিবদের কাছে ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা করে প্লট আকারে বিক্রি করেন। কয়রা সদরে হিন্দুদের জমি দখল করে ১৭টি দোকান করে ভাড়া দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বাহারুলের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া লবণ পানির ঘের বন্ধের কথা বলে সাধারণ মানুষের পাইপ ভেঙে আবার তাদের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়ে তাদের ঘের করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। স্বাস্থ্যসেবার নামে দুটি অবৈধ (লাইসেন্সবিহীন) হাসপাতাল পরিচালনা করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া ক্ষুদ্র ঋণের নামে কোটি কোটি টাকার সুদের কারবারের জড়িত থাকারও অভিযোগ রয়েছে এই আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। সুন্দরবন থেকে চিংড়ি মাছ সংগ্রহ করার সিন্ডিকেট পরিচালনার মাধ্যমে খুলনা শহরে কয়েক খণ্ড জমি কিনেছেন। প্রতিবন্ধী স্কুলের নামে কয়রা থানার সামনে তিন একর জায়গা নিয়েছেন। কপোতাক্ষ কলেজের সামনে ১৬ শতক জমির ওপর ৫ তলা ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে। ২৫ লাখ টাকা দামের গাড়ি রয়েছে তার।
সর্বশেষ নির্বাচনে বিজয়ের পরে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বাহারুল ইসলাম। শুরু করেন সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ। এ প্রসঙ্গে মহারাজপুরের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ-আল মাহমুদ বলেন, ‘কিছুদিন আগে আমার ইউনিয়নের এলাকা থেকে কয়েকজনকে সুন্দরবন থেকে বিষ দিয়ে শিকার করা মাছসহ আটক করেছিল স্থানীয়রা। পরে তাদের মহারাজপুর ইউনিয়নের আনা হলে তারা জানায় এই মাছ বাহারুলের। তখন তাদের পুলিশে দিয়ে দিয়েছিলাম। ওই দিন কয়রা সদরে গেলে বাহারুল দলবল নিয়ে আমার ওপর চড়াও হয়। পরে থানার ওসি (কয়রা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মিটমাট করে দেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাহারুল কেন্দ্র দখল করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচিত হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে অন্তত ৫ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। বর্তমানে কয়রার কপোতাক্ষ কলেজের পাশে একটি জায়গা দখল করে চার তলা ভবন তৈরি করছেন।’
সর্বশেষ খুলনার কয়রায় মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে পিটিয়ে জখমের অভিযোগে চেয়ারম্যান এস এম বাহারুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যারে কাছে। খুলনা শহরের ভাড়া বাসা থেকে ২১ জুলাই গভীর রাতে বাহারুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে আদালতে তোলা হলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
অধ্যক্ষ বলেন, ‘এরপর থেকেই সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাহারুল আমাকে নানা প্রকার হুমকি দিয়ে আসছেন। কয়েক দিন আগে আমার কাছ থেকে এক লাখ টাকা চাঁদা নিয়েছেন। সভাপতি হতে পারিনি, তখন আমার কিছু টাকা খরচ হয়েছিল। সেই জন্য এক লাখ টাকা দিতে হবে। প্রাণের ভয়ে টাকা দিয়েছি। তারপরও সে আমাকে তুলে নিয়ে মারধর করেছে। বলেছে, অধ্যক্ষের দায়িত্ব ছেড়ে দিতে। না হলে এলাকায় ফিরতে পারব না। থানায় জানালেও মামলা না নিয়ে, প্রথমে বিষয়টি মিটমাট করতে বলা হচ্ছিল, পরে পত্রপত্রিকায় লেখা হলে থানায় মামলা নিয়েছে।’
গ্রেফতার হওয়ার আগে ২১ জুলাই সন্ধ্যায় এসএম বাহারুল ইসলাম বলেন, ‘ওই মাদ্রাসায় আমাকে সভাপতি করার কথা ছিল। কিন্তু সেখানে পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে সভাপতি করা হয়। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। মূলত মাদ্রাসার এক স্টাফকে অধ্যক্ষের লোকজন মারপিট করে। এ নিয়ে ঝামেলা চলছিল। পরে মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাসুদুর রহমানকে নিয়ে কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদে আসে। আমি বিষয়টি মীমাংসা করে তার স্ত্রীর কাছে দিয়ে দিই এবং বলি আপনারা থানায় যাবেন নাকি বাড়িতে। তারা বলল বাড়িতে যাবে। সেইভাবে তাদের যেতে দেওয়া হয়। এখানে পূর্বের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আমাকে মারপিটের সঙ্গে জড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’
দলীয় পদকে ব্যবহার করে নানাবিধ অপকর্ম করায় এস এম বাহারুল ইসলামকে নিয়ে বিব্রত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। তবে কেউ অভিযোগ দিতে সাহস না পাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী সুজিত অধিকারী বলেন, ‘বাহারুলের অনেক কর্মকা- ইতিমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সর্বশেষ শুনেছি অধ্যক্ষকে মারধর করার জন্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাকে দল থেকে সমর্থন করব না। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আমরা খুব তাড়াতাড়ি বাহারুলের বিষয়ে আলোচনায় বসব।’
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বি. এম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘বাহারুলের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’