চলে গেলেন যশোর বিএনপির ত্যাগী পরীক্ষিত নেতা নূর-উন-নবী, জানাজায় মানুষের ঢল

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যশোর কোতয়ালী থানা বিএনপির সভাপতি সাবেক পৌর কমিশনার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ নূর-উন-নবী ইন্তিকাল করেছেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। গত ১৪ জুলাই দিবাগত রাত ২টা ২০ মিনিটে তার জীবনাবসান ঘটে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৬৫ বছর। জীবনের অন্তিম মুহূর্তগুলোতে তিনি রাজধানীর নিউরোসাইন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর আগে গত ৪ জুলাই তাঁর ব্রেন স্ট্রোক করলে তিনি যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন পর্যায় চলে গেলে চিকিৎসকদদের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে রাজধানীর ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে, ভাই, বোন, নাতি-নাতনীসহ আত্মীয়স্বজন যেমন রেখে গেছেন, ঠিক তেমনি রেখে গেছেন অসংখ্য দলীয় নেতাকর্মী ও সুহৃদ। গতকাল শুক্রবার বাদজুমা যশোর শহরের শংকরপুর গোলাম হোসেন প্যাটেল স্কুল মাঠে নামাজে জানাজা শেষে তাঁকে কারবালা কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।


যশোর বিএনপির রাজনীতিতে এক সূপরিচিত নাম নূর-উন-নবী। তার রাজনৈতিক জীবন ছিলো বর্ণাঢ্য। দলের প্রতি বিশাল আনুগত্য, কমিটমেন্ট ও আত্মত্যাগের কারণে নেতাকর্মীদের মাঝে তাঁর অসম্ভব জনপ্রিয়তা ছিলো। ৯০ দশকের প্রথম দিকে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য বর্ষীয়াণ রাজনীতিবিদ সাবেক মন্ত্রী মরহুম তরিকুল ইসলামের হাত ধরেই জাতীয়তাবাদী দলে অভিষেক হন নূর-উন-নবী। এর আগে তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। জাসদ ছেড়ে জননেতা তরিকুল ইসলামের আহ্বানে বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলের মধ্যে তিনি অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। সামাজিকভাবেও বেশ জনপ্রিয় ছিলেন নূর-উন-নবী। তিনি যশোর পৌরসভার দুই মেয়াদে কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে যশোর জেলা বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট যশোর সদর উপজেলা অর্থ্যাৎ কোতয়ালী থানা বিএনপির আওতাধীন ১৫টি ইউনিয়নের তৃণমূল পর্যায়ের বিএনপির নেতাকর্মীদের আস্থা-ভালোবাসার মূল জায়গায় স্থান করে নেন তিনি। এ কারণে কোতয়ালী থানা বিএনপির পরপর দুই বারের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পরবর্তী সময়ে প্রায় এক যুগ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সর্বশেষ গত ৭ জুন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তৃণমূল নেতাকর্মীদের গোপন ভোটের মাধ্যমে দ্বিতীয় দফা কোতয়ালী থানার সভাপতি পদে পুনঃনির্বাচিত হন বর্ষীয়াণ এ রাজনীতিক। দ্বিতীয় দফা সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর মাত্র এক মাস সাত দিনের ব্যবধানেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।
বাংলাদেশে জাতীয়বাদী দর্শনে বিশ্বাসী বিএনপি নেতা নূর-উন-নবীর এই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একদিকে যেমন সফলতা রয়েছে তেমনি অনেক বেদনাদায়ক স্মৃতিও রয়েছে। রাজনীতির এই দীর্ঘ পথে তাকে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের শিকার হতে হয়েছে। বিএনপিতে যোগদানের পর থেকেই ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিহিংসার শিকার হন তিনি। সরকারের একের পর এক দমন-নিপীড়নের নিষ্পেষিত হন এই জনপ্রিয় নেতা। যশোরের কলঙ্কিত উদীচী হত্যাকান্ডসহ একাধিক স্পর্শকাতর মামলায় ষড়যন্ত্র করে জড়িয়ে মাসের পর মাস রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয় এই বিএনপি নেতাকে। এতোসবের পরও তিনি দলের কর্মকান্ড থেকে বিন্দুমাত্র সরে দাঁড়াননি। তরিকুল ইসলাম পরিবারের অত্যন্ত আস্থাভাজন এ নেতা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন।


বুধবার দিবাগত রাত ২টা ২০ মিনিটের সময় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর আগারগাঁওয়ের নিউরোসাইন্স হাসপাতালে বিএনপি নেতা নূর-উন-নবীর মৃত্যু হয়। এখবর যশোরে পৌঁছানোর পর সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। মৃত্যুর খবর শুনে লাশ পৌঁছানোর আগেই গতকাল সকালে শহরের শংকরপুরে মরহুমের বাসভবনে যান বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, যশোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক নার্গিস বেগমসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এর কিছুক্ষণ পরে সকাল ৯ টার কিছু আগে ঢাকা থেকে রওনা হওয়া লাশবাহী ফ্রিজার অ্যাম্বুলেন্সটি বাসভবনে পৌঁছালে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মীদের কান্নায় পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। বিএনপি নেতা অনিন্দ্য ইসলাম অমিত ও অধ্যাপক নার্গিস বেগম এসময় স্বজনদের সান্ত¡না দিতে থাকেন।

বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে মরদেহ শহরের লালদীঘিপাড়স্থ বিএনপির কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। এসময় দলীয় নেতারা প্রিয় নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রথমে লাশের কফিনে বিএনপির দলীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত। এরপর তিনি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানান।
দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো শেষে যশোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক নার্গিস বেগমের নেতৃত্বে যশোর জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এসময় সেখানে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকন, আহ্বায়ক কমিটির সদস্য গোলাম রেজা দুলু, আব্দুস সালাম আজাদ, অ্যাডভোকেট মোহাম্মাদ ইসহক, আলহাজ মিজানুর রহমান খান,একে শরফুদ্দৌলা ছটলু, হাজী আনিছুর রহমান মুকুল, নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি মারুফুল ইসলাম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুনীর আহমেদ সিদ্দিকী বাচ্চুসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
জেলা বিএনপির শ্রদ্ধা নিবেদনের পর যশোর নগর বিএনপির সভাপতি রফিকুল ইসলাম মুল্লুক চাঁদ ও সাধারণ সম্পাদক এহসানুল সেতুর নেতৃত্বে নেতৃবৃন্দ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান যশোর কোতয়ালী থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনজুরুল হক খোকন, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ও আশরাফুজ্জামান মিঠুসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। এরপর শার্শা থানা ও পৌর বিএনপি, ঝিকরগাছা থানা ও পৌর বিএনপি, মণিরামপুর থানা ও পৌর বিএনপি, বাঘারপাড়া থানা ও পৌর বিএনপি, কেশবপুর থানা ও পৌর বিএনপির নেতৃবৃন্দ, যশোর সদর উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ, জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম, যশোর জেলা যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দল, জাতীয়তাবাদী মহিলা দল, জেলা ছাত্রদল, নগর ছাত্রদল, মৎস্যজীবী দল, ঘোপ ওয়ার্ড বিএনপি, যশোর নির্বাচিত চেয়ারম্যান ফোরামসহ বিএনপি ও তার অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের পক্ষ থেকে নেতৃবৃন্দ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
দলীয় কার্যালয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মরদেহ নিয়ে যাওয়া শংকরপুর গোলাম হোসেন প্যাটেল স্কুল মাঠে। সেখানে জুমা নামাজ শেষে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন। বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতির কারণে স্কুল মাঠে জায়গা না থাকায় মুসল্লিরা ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে জানাজায় অংশ নেন।


জানাজাপূর্ব মরহুমের মরহুমের বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য রাখেন বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, জাসদের কেন্দ্রীয় কার্যকরী সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট রবিউল আলম, যশোর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, মরহুমের ছোটভাই আলহাজ রুহুল আমীন, বড় ছেলে খুরশিদ আলম বাবু, মরহুমের মামা ড. মোস্তাফিজুর রহমান ও মাস্টার হাফিজুর রহমান।
এসময় উপরে উল্লিখিত নেতৃবৃন্দ ছাড়াও জানাজায় অন্যান্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে অংশ নেন, যশোর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকন, আহবায়ক কমিটির সদস্য গোলাম রেজা দুলু, আব্দুস সালাম আজাদ, অ্যাডভোকেট মোহাম্মাদ ইসহক, আলহাজ মিজানুর রহমান খান, হাজী একে শরফুদ্দৌলা ছটলু, নড়াইল জেলা বিএনপির সহসভাপতি সুজা উদ্দীন সুজা, জামায়াত নেতা মাস্টার নুরুন্নবী, অধ্যক্ষ সুলতান আহমেদ, দৈনিক লোকসমাজের প্রকাশক শান্তুনু ইসলাম সুমিত, নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি মারুফুল ইসলাম, হাজী আনিছুর রহমান মুকুল, মুনীর আহম্মেদ সিদ্দিকী বাচ্চু, যশোর নগর বিএনপির সভাপতি রফিকুল ইসলাম মুল্লুক চাঁদ, সাধারণ সম্পাদক এহসানুল হক সেতু, কোতয়ালী থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনজুরুল হক খোকন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী আজম জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আনছারুল হক রানা, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি রবিউল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা আমীর ফয়সাল, ছাত্রদলের সভাপতি রাজিদুর রহমান সাগর, সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান বাপ্পীসহ যশোরের আটটি উপজেলার বিএনপির ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
জানাজার নামাজে ইমামতি করেন মাওলানা মো. দেলোয়ার হোসেন। পরে শহরের কারবালা কবরস্থানে নূর-উন-নবীর দাফন সম্পন্ন হয়।