এবার চীনে চামড়ার বাজার হারাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ ইউরোপ, আমেরিকার পর এবার চীনে চামড়ার বাজার হারাতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। । বর্জ্য পরিশোধনে ব্যর্থতার কারণে ইউরোপ, আমেরিকার বাজার হারিয়ে শুধুমাত্র চীনে রপ্তানিকে কেন্দ্র করে টিকে আছে দেশের এই শিল্পটি । এখন গুণগত মানের কারণে চীনেও রপ্তানির বাজার হারাতে বসেছে বাংলাদেশ। গত কয়েক বছর ধরেই দেশটিতে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকার রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমছে। চার বছরের মধ্যে চীনে এসব পণ্যের রপ্তানি কমেছে ২৩ থেকে ৯৮ শতাংশ। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
ইপিবির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চীনে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকার রপ্তানিতে সবচেয়ে বিপর্য— অবস্থায় রয়েছে চামড়াজাত পণ্য। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চীনে এ পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশের আয় হয়েছিল ১৪৪ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে মাত্র ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এক্ষেত্রে রপ্তানি কমেছে ৯৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। একই সময়ে চীনে চামড়া পণ্যে রপ্তানি আয় কমেছে ২৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর পাদুকা পণ্যে রপ্তানি আয় কমেছে ২৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। মূলত চীনের স্থানীয় উৎপাদনকারীরা অপেক্ষাকৃত কম দামে নিখুঁত পণ্য সরবরাহ করতে পারায় বাংলাদেশ থেকে একই দামে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা আমদানিতে আগ্রহ হারাচ্ছেন চীনারা।
চীনের সম্ভাবনাময় বিশাল বাজারে রপ্তানি বাড়াতে চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকার মানোন্নয়নের পাশাপাশি বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের চীনাদের সঙ্গে যৌথভাবে শোরুম স্থাপন, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ভিসা প্রদানের সাময়িক স্থগিত আদেশ প্রত্যাহার এবং চীনের আমদানি-রপ্তানি এক্সপো গুয়াংজুর ক্যান্টন ফেয়ারে অংশ নেওয়ার ওপর জোর দিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস।
কর্মকর্তারা বলছেন, চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকার রপ্তানি বাড়াতে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য অপার সম্ভাবনা রয়েছে। এখন প্রয়োজনীয় সহায়তার মাধ্যমে কীভাবে চীনে রপ্তানি বাড়ানো যায় সেই উপায় খুঁজছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি পেইচিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে পরামর্শ চেয়েছিল কীভাবে ১৪০ কোটি মানুষের দেশ চীনে এসব পণ্যের রপ্তানি বাড়ানো যায়।
পেইচিং দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর মোহাম্মদ মনসুর উদ্দিন এ বিষয়ে বিস্তরিত তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, গত দশ বছরে বাংলাদেশ প্রতি বছর গড়ে ৫০ মিলিয়ন ডলারের চামড়া ও ১৬ দশমিক ৭০ মিলিয়ন ডলারের পাদুকা রপ্তানি হয়েছে।

চীনে করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর বছর ২০২০ সালকে বাদ দিলে চামড়া পণ্যের সর্বোচ্চ রপ্তানি হয়েছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭৬ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ডলার। সর্বনি¤œ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩০ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত চীনে চামড়া রপ্তানি হয়েছে ৫৩ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন ডলার, যা গড় রপ্তানির চেয়ে বেশি। বিগত ১০ বছরে চীনে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি হয়েছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৪৪ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে চীনে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমতে থাকে এবং সর্বনিম্ন রপ্তানি হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ দশমিক ২৪ মিলিয়ন ডলার। চীনে পাদুকার সর্বোচ্চ রপ্তানি হয়েছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৩ দশমিক ৫০ মিলিয়ন ডলার এবং সর্বনিম্ন ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২ দশমিক ৫১ মিলিয়ন ডলার। গত ১০ বছরে চীনে পাদুকা পণ্যের গড় রপ্তানির পরিমাণ ১৬ দশমিক ৭০ মিলিয়ন ডলার। ২০২১ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত রপ্তানির পরিমাণ ১৩ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার।

চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড ও কোরিয়া থেকে চামড়া আমদানি করে থাকে চীন। বাংলাদেশের চামড়ার আকার অন্য দেশগুলোর তুলনায় ছোট। উল্লেখিত দেশগুলোর চামড়ার আকার বড় এবং মেশিনের মাধ্যমে পশুর শরীর থেকে আলাদা করা হয় বলে চীনা ক্রেতারা লাভজনক মনে করেন। চীনের ক্রেতারা প্রতিযোগিতামূলক দামে গুণগত এবং মানসম্পন্ন বেশি দামের চামড়া যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড ও কোরিয়া থেকে কিনতে আগ্রহী।

মোহাম্মদ মনসুর বলেছেন, চীনসহ বিশ^বাজারে বাংলাদেশি চামড়ার রপ্তানি বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের শহর এবং গ্রামে মেশিন ব্যবহার করে পশু জবাই এবং চামড়া আলাদা করতে হবে। চীনের স্থানীয় উৎপাদনকারীরা অপেক্ষাকৃত কম দামে নিখুঁত পণ্য সরবরাহ করতে পারায় বাংলাদেশ থেকে একই দামে চামড়াজাত পণ্য ও ফুটওয়্যার আমদানিতে আগ্রহী নয়। অপরদিকে চীনা ক্রেতারা প্রস্তাবিত দামের চেয়ে গুণগত মান ও শর্ত বেশি দেওয়ায় বাংলাদেশি কিছু রপ্তানিকারক চীনে রপ্তানীতে আগ্রহী নয়।

দিন দিন চীনে বিশ্বমানের পণ্যের চাহিদা বাড়লেও দেশটিতে বাংলাদেশি ব্র্যান্ডগুলোর কোনো বিক্রয় কেন্দ্র না থাকাও রপ্তানি কমে যাওয়ার একটি কারণ বলে মনে করে চীনে বাংলাদেশি দূতাবাস। বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের বিক্রয় কেন্দ্র স্থাপন, চামড়াজাত পণ্য ও ফুটওয়্যার রপ্তানি বাড়াতে বিপণন, প্রচার ও বিজ্ঞাপনের জন্য দেশটিতে প্রতিনিধি নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন পেইচিংয়ের কমার্শিয়াল কাউন্সিল মোহাম্মদ মনসুর উদ্দিন।

তিনি মনে করেন, রপ্তানি বাড়ানোর জন্য সরাসরি চীনে গিয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। মহামারী করোনার কারণে ২০২০ সাল থেকে দেশটিতে বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদান বন্ধ রয়েছে, যা রপ্তানিতে মারাত্মক ভাবে প্রভাব ফেলছে। অবিলম্বে ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছে দূতাবাস।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, চীনে রপ্তানি বাড়াতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের স্বেচ্ছায় আগ্রহ দেখানো উচিত। কারণ, দেশটিতে আমাদের শুল্কমুক্ত সুবিধা রয়েছে। চীনে রপ্তানি বাড়ানোর জন্য সরকার নীতি সহায়তা বাড়ানোর কাজ করছে। (সূত্র দেশ রুপান্তর)