খুলনায় ওজোপাডিকোর ৪ লাখ টাকার টেন্ডারে তিন লক্ষাধিক টাকা লোপাট

0

এহতেশামুল হক শাওন, খুলনা ॥ ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) ২০২০-২১ অর্থ বছরের বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশের জন্য মুদ্রণ কাজে অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নমুনা মোতাবেক বই সরবরাহের জন্য সম্প্রতি টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছিল। ১৪৫ পাতার প্রতিটি বইয়ের মূল্য ৬৬৭ টাকা ধরে ৬শ পিস বইয়ের জন্য সর্বমোট চার লাখ ২শ টাকা দর দিয়ে যে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান কাজটি পেয়েছিল সেটির কোন অস্তিত্ব খুলনায় খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সর্বশেষ ওই প্রতিষ্ঠানটির মালিক অলিয়ার রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তার কোন প্রেস ব্যবসা নেই। তিনি অন্য জায়গা থেকে বই ছাপিয়ে বার্ষিক রিপোর্টগুলো সবরবরাহ করেছেন। আবার ১৪৫ পাতার বই দেয়ার কথা থাকলেও বই হয় ১৩২ পৃষ্ঠার অর্থাৎ মাত্র ৬৬ পাতার। বাজার দর অনুযায়ী যার মূল্য দাঁড়ায় মাত্র ৮৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ ৪ লাখ ২শ টাকার কাজে তিন লাখ ১৪ হাজার ২শ টাকারই হদিস নেই। এভাবেই ওজোপাডিকোর টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতার চিত্র ফুটে উঠেছে এ কাজটি থেকে।
এদিকে, কোটেশনের জন্য যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে জাহান প্রিন্টিং প্রেসের মালিক ওই বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানিয়েছেন। পুরাতন গল্লামারী রোডের রশিদ অফসেট প্রেস নামের কোন প্রতিষ্ঠানই নেই। মধুমতি এন্টারপ্রাইজ নামেরও কোন প্রতিষ্ঠান খুলনায় নেই। যদিও মধুমতি এন্টারপ্রাইজ নামের প্রতিষ্ঠানটির যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে মধুমতি মূদ্রণালয় রয়েছে।
এছাড়া খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খালিশপুরের বঙ্গবাসী এলাকার ২১০ নম্বর রোডের এনএফ/২৫ এই ঠিকানায় যে রূপকথা স্কেস নামের প্রেসের কথা বলা হয়েছে সেটিরও ট্রেড লাইসেন্স নেই। বরং ২০২০ সালে রূপকথা স্কেস নামে কেসিসি থেকে যে ট্রেড লাইসেন্সটি নেয়া হয় তার ঠিকানা দেয়া হয় এনআই/৮১, চিত্রালী বাজার। পক্ষান্তরে মুদ্রিত বইয়ের শেষে মূদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে দৌলতপুর, খুলনা। আবার ৮১৯ নম্বর ট্রেড লাইসেন্সে চিত্রালী বাজারের যে রূপকথা স্কেসের নাম উল্লেখ করা হয় সেটিরও নবায়ন নেই। অর্থাৎ মেয়াদ উত্তীর্ণ ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে যেমন টেন্ডারে অংশ নেয়া হয়, তেমনি একই নম্বরের ট্রেড লাইসেন্স দিয়েই পুরাতন গল্লামারী রোডের রশিদ অফসেট প্রেস নামের কথিত প্রেসের নামে কাগজপত্র দাখিল হয় ওজোপাডিকোতে।
কেসিসির ট্রেড লাইসেন্স শাখা থেকে রশিদ অফসেট প্রেস নামের ওই প্রতিষ্ঠানটির ট্রেড লাইসেন্সকে ‘সঠিক নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া লাইসেন্স পরিদর্শকের স্বাক্ষরের সাথেও মিল পাওয়া যায়নি।
অপরদিকে, মূদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানটির নামে যে আয়কর সার্টিফিকেট দাখিল করা হয় সেখানে যে ডেপুটি কমিশনারের স্বাক্ষর দেখানো হয় তিনি গত বছর জানুয়ারিতেই অবসরে গেছেন। মো. হেদায়েত আলী নামের ওই কর্মকর্তা স্বাক্ষরিত আয়কর দেখানো হয় ২-২-২২ তারিখের। এমনকী ওই সার্টিফিকেট সম্পর্কে খুলনা আয়কর অফিসের সার্কেল-৩ এর একজন কর্মকর্তা জানান, সংশ্লিষ্ট আয়কর সার্টিফিকেটে আয়করদাতা ও প্রতিষ্ঠানের নাম যেভাবে লেখা হয়েছে সেভাবে কোন সার্টিফিকেট লেখা হয় না। কয়েকটি আয়কর সার্টিফিকেট দেখেও সেটি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
তবে এতোকিছুর পরও রূপকথা নামের ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক অলিয়ার রহমান দাবি করেন, তার দেয়া সব কাগজপত্রই সঠিক আছে। মূল কাগজ তার বাসায় আছে। তবে প্রেস ব্যবসা হিসেবে ২০২০ সালে ট্রেড লাইসেন্স নিলেও তিনি স্বীকার করেন তার কোন প্রেস ব্যবসা নেই। তিনি এভাবে কাজ নিয়ে অন্য জায়গা থেকে ছাপিয়ে সরবরাহ করেন। ওজোপাডিকোর কর্মকর্তারা যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই বই সরবরাহ করেছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তবে এভাবে দীর্ঘদিন ধরে করলেও কেউ কোন প্রশ্ন করেননি জানিয়ে তিনি এ প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, ‘আপনি কেন এ নিয়ে কথা বলছেন’ ?
ওজোপাডিকোর সদর দপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রুহুল আমিন বলেন, এ ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি কমিটি আছে। কমিটির সদস্যরাই এটি দেখভাল করেছেন। অবশ্য ৪শ কপি বই সরবরাহের কথা তিনি যেমন স্বীকার করেছেন, তেমনি সহকারী ব্যবস্থাপক(প্রশাসন) মোহাম্মদ আলীও একই কথা বলেন। ৬শ কপি বইয়ের টেন্ডার দিয়ে ৪শ কপি নেয়ার কারণ সম্পর্কে নির্বাহী প্রকৌশলী রুহুল আমীন বলেন, ‘এভাবেই হয়ে আসছে অনেক দিন ধরে’।
ওজোপাডিকোর বার্ষিক রিপোর্ট ছাপা সম্পর্কিত টেন্ডারে অনিয়ম প্রসঙ্গে কিছুই জানতেন না বলে জানিয়েছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আজহারুল ইসলাম। কয়েকজন সাংবাদিক এ বিষয়ে খোঁজখবর নিতে তাকে ফোন দিলে তিনি জানতে পারেন। এরপর একটি তদন্ত কমিটি করেছেন, যারা এখনও তাকে রিপোর্ট দেয়নি। তার অভিমত, রিপোর্টে অনিয়ম পাওয়া গেলে ব্যবস্থা। আর যদি কোন অনিয়ম না থাকে তাহলে তো কিছুই করার নেই।