ঢাকার বাতাসে বিষ

0

নূরে আলম জিকু॥ বায়ু দূষণের শীর্ষ অবস্থানে ঢাকা। প্রতিনিয়তই অপরিকল্পিতভাবে গড়ছে নগরায়ন। বাড়ছে জনসংখ্যা ও শিল্পকারখানা। নির্মাণ হচ্ছে রাস্তাঘাট ও স্থাপনা। শুষ্ক এই মৌসুমেও উন্নয়ন কাজের নামে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এতে ধুলোয় ধূসরময় রাজধানী। শিল্পায়ন, উৎপাদন, নগরায়নের ফলে বাতাসে ভাসছে বিষ। সেই বিষ ঢুকছে মানবদেহে। প্রতি শ্বাসে নগরবাসী গ্রহণ করছে বিষাক্ত পদার্থ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় বায়ু দূষণের কারণে নগরবাসীর গড় আয়ু কমেছে সাত বছর। বায়ুবাহিত রোগের কারণে প্রতি বছর দেড় লাখের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। বাড়ছে ক্যান্সার, কিডনি, হৃদরোগের মতো জটিল অসুখ। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নারী-পুরুষের প্রজনন ক্ষমতাও। বাতাসের মাধ্যমে অতি সূক্ষ্ম কণা সরাসরি মানব শরীরের ব্রেণে ঢুকে ছোট সেলগুলোকে অকেজো করে দিচ্ছে। যা অনেকটা কার্বন মনোক্সাইডের মতো নীরব ঘাতক। এতে শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকিই বাড়ছে না। ব্লাক কার্বন, সিএফসি ও ওজন স্তরকেও উত্তপ্ত করে তুলছে। বায়ু দূষণ কমাতে আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তা আমলে নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সড়কে পানি ছিটানোর কথা বললেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। এছাড়া যেসব স্থানে বায়ু দূষণ হচ্ছে, যেখানে সিটি করপোরেশনের পানিবহনকারী গাড়ি যাচ্ছে না। পরিবেশ অধিদপ্তরও অনেকটা নিশ্চুপ। ঢিলেঢালা ভাবে চলছে নির্মল বায়ু আইন-২০১৯। এ সংস্থাটির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন নগরবাসী। তারা বলছেন, দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই সরকারি। পরিবেশ অধিদপ্তর এদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিলে দূষণ কমে আসতো।
সম্প্রতি সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক দূষণ প্রযুক্তি সংস্থা আইকিউএয়ারের বার্ষিক প্রকাশিত প্রতিবেদনে ১১৭টি দেশের মধ্যে দূষণের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ নাম। তবে এবারই প্রথম নয়। এর আগেও টানা ৩ বার দূর্ষণের তালিকার শীর্ষে নাম উঠেছে। বিশ্ব বায়ুমান সমীক্ষা ২০২১ শীর্ষক প্রতিবেদনে আইকিউএয়ার দেশের পাশাপাশি বিশ্বের দূষিত রাজধানীর তালিকাও প্রকাশ করেছে। এতে বিশ্বের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত শহর হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রত্যাশিত বায়ুমানের লক্ষ্যমাত্রা একটি দেশও পূরণ করতে পারেনি। মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার বাতাসের মান বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। যা স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে রাজধানীতে খোঁড়াখুঁড়ির পরিমাণ বেড়েছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, নির্মাণাধীন স্থাপনা ও কলকারখানার বর্জ্যসহ নানা কারণে ঢাকার বাতাস দূষিত হচ্ছে। গবেষকরা বলছেন, প্রতিনিয়তই ঢাকায় বায়ু দূষণ বাড়ছে। নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ নানা ব্যাধি নিয়ে হাসপাতালে বাড়ছে রোগী। কারণ হিসেবে বলছেন, ঢাকায় প্রায় ২ থেকে আড়াই কোটি মানুষের বাস। এরপর অপরিকল্পিত শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। ফলে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন মনোক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, বেনজিন, সালফার ও ফটোকেমিক্যাল অক্সিডেন্টস বায়ুতে মিশে যাচ্ছে। এতে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে ঢাকা নগরী। বনভূমি ধ্বংস করা ও পরিবেশ দূষণের বড় কারণ বলে দাবি করছেন কেউ কেউ। এভাবে বায়ুদূষণ চলতে থাকলে জনজীবন ও প্রকৃতি বিনষ্ট হবে। যা পুরো পৃথিবীর জন্যই মারাত্মক হুমকি। কলকারখানা, মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযানের অনিয়ন্ত্রিত কালো ধোঁয়া বাতাসে সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত গ্যাসের বিস্তার ঘটায়। এসব উৎস থেকে সৃষ্ট মিথেন গ্যাস, ইথেলিন বাতাসে মিশ্রিত হয়ে প্রাণীদেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট নির্মাণ থেকে ধুলাবালি, সিগারেটের ধোঁয়া ও কীটনাশক স্প্রের কণা বাতাসকে দূষিত করে মানবদেহে ক্যান্সারসহ অ্যালার্জিজনিত নানা জটিল রোগের সংক্রমণ ঘটাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর ৪২ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। গত বছরে শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত সর্বশেষ এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সে বলা হয়েছে যে, বায়ু দূষণের কারণে সারা বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস। ঢাকায় কমেছে প্রায় সাত বছর সাত মাস। এছাড়া বায়ু দূষণের ফলে গাছের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া বা সালোক সংশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর প্রভাব পুরো প্রাণীজগতের ওপর পড়ছে। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, যে সময়ে বায়ু দূষণ বেড়ে যায়, সেই সময়ে মানুষের হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক এর ঝুঁকিও বাড়ে। এ সময়ে অনেকে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক করেন। বর্তমান সময়ে অনেক অল্প বয়সীরাও হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে হাসপাতালে আসেন। বায়ুতে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫ এর বেশি হওয়ায় স্বাসের সঙ্গে মানুষের রক্তে, ধমনিতে বিষাক্ত পদার্থ প্রবেশ করছে। যার ফলে শিশু থেকে বয়স্ক সবাই নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এসএম মোস্তফা জামান মানবজমিনকে বলেন, বায়ু দূষণ নানা রোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফুসফুসে সংক্রমণ, অ্যাজমা, ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক, কিডনিসহ নানা রোগ সৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বায়ু দূষণ জড়িত। তবে যেভাবে গবেষণা করার দরকার, সেইভাবে আমাদের দেশে গবেষণা হচ্ছে না। যা হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য।
সম্প্রতি ক্যাপসের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম বলেছেন, বায়ু দূষণের একটি অন্যতম নেতিবাচক প্রভাব হলো প্রজননে নানা বিপত্তি। মহিলা ও পুরুষ উভয়ের বন্ধ্যত্বের জন্য অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ২.৫ দায়ী। এ ছাড়া বায়ু দূষণ গর্ভপাত, জন্মগত ত্রুটি, বাচ্চার স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বাধা দেয়।
এদিকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪টি জেলারই বায়ুর মান আদর্শ মাত্রার চেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, আগে ঢাকায় বায়ু দূষণের প্রধান কারণ ছিল ইটভাটা। সম্প্রতি দেখা গেছে কনস্টাকশন সাইট থেকে বেশি দূষণ হচ্ছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের পরিবেশ আইন মানেন না। সারা বছরই রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি চলে। বাংলাদেশে নির্মল বায়ু আইন দরকার। যা বাস্তবায়ন করতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আইন আছে। দূষণ কমাতে ঢাকায় কি কি ধরনের কলকারখানা নির্মাণ করতে পারবে তার সুনির্দিষ্ট করতে হবে। ক্যাপস পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ঢাকার বায়ুতে ধুলাবালি, হেবি মেটাল ও ক্ষতিকর অনুজীব থাকে। ঢাকার বায়ু মান পরিবেশ অধিপ্তরের যে মানদণ্ড আছে তার চেয়ে ৫-৬ গুন বেশি ক্ষতিকর। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এই সময়ে ৬০ শতাংশ বায়ু দূষণ হয়ে থাকে। আমরা গবেষণা করতে গিয়ে ঢাকার ৭০টি স্থানে বায়ুর মান পরীক্ষা করেছি। সকল স্থানেই একই ধরনের বায়ু দূষণ পেয়েছি। নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম দূষিত দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মোটর গাড়ি থেকে নির্গমন এবং শিল্প নিঃসরণ এই ধরনের দূষণের প্রধান উৎস। ঢাকার মানুষের অকাল মৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ হল বায়ুদূষণ। প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলির অবহেলা, অব্যবস্থাপনা এবং সরকার বায়ুর মান নিয়ন্ত্রণকে অগ্রাধিকার দিতে ব্যর্থ হওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের এয়ার কোয়ালিটি রিসার্চ অ্যান্ড মনিটরিং সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা শহরের দূষণের ৫০% ধূলিকণা ও ধোঁয়া। অবকাঠামো ও ভবন নির্মাণ কাজে অব্যবস্থাপনা ও মেয়াদ উত্তীর্ণ পুরাতন যানবাহন থেকে নির্গমন ধুলোর ও ধোঁয়ার দুটি প্রাথমিক উৎস। খড়, কাঠ এবং তুষের মতো জৈব পদার্থের ধোঁয়া এবং সেইসাথে শুকনো কণাগুলি ৪০% দূষণের জন্য দায়ী। ঢাকায় ধোঁয়া ও ধুলাবালি থেকে বায়ুদূষণ ক্রমেই বাড়ছে। এছাড়াও সমপ্রতি একটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বাতাসের ক্ষতিকর বিষ নাইট্রোজেনের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে। মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো তাদের কাজগুলো কার্যকরভাবে পরিচালনা করলে ঢাকার দূষণ অর্ধেকেরও বেশি কমিয়ে আনা সম্ভব। আগে ঢাকা শহরের বায়ু দূষণের প্রধান উৎস ছিল ইটভাটা। ঢাকাকে ঘিরে ইট প্রস্তুতকারকদের চ্যালেঞ্জ কিছুটা সমাধান হয়েছে। বিদ্যমান একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে শহরের বিভিন্ন স্থানে বর্জ্য পোড়ানো দূষণে ভূমিকা রাখে। নির্মাণ কার্যক্রমের ধুলা এবং অটোমোবাইলের ধোঁয়া সমপ্রতি শহরের মধ্যে অন্যতম সমস্যা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। এটা স্পষ্ট যে প্রশাসন এই দূষণের উৎসগুলি পরিচালনা করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে না। বায়ু দূষণের প্রসঙ্গ উঠলে সরকারি কর্তৃপক্ষ শহরের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পকে দায়ী করে।