বিএডিসি’র মালিকানাধীন পাম্পগুলো ব্যবসায় পরিণত: বাঘারপাড়ায় বোরো আবাদে চাষিকে সেচে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ফসল উৎপাদনের প্রধান উপকরণ হচ্ছে সেচ। কৃষির সামগ্রিক উন্নয়নে সেচের কোন বিকল্প নেই। সেচের পানি সুষ্ঠু ব্যবহার করে ফসল উৎপাদনের নিবিড়তা ও ফলন বৃদ্ধির জন্য সুপরিকল্পিত সেচ ব্যবস্থাপনার ওপর সরকার বিএডিসি’র মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সেচের জন্য সুচিন্তিত, সমন্বিত ও পরিকল্পিত সেচ কার্যক্রম গ্রহণ, অপচয় রোধ, সেচ খরচ কমানোসহ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সরকার ক্ষুদ্র সেচ নীতিমালাও প্রণয়ন করেছে। এ নীতিমালায় মাঠ পর্যায়ে সেচ ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ ও সুবিধা প্রদান বিষয়ে বিষদ ও সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা নেই। উপজেলা সেচ কমিটির তেমন কোন কার্যক্রম না থাকায় প্রতিটি প্রকল্প এখন ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রুপ নিয়েছে। ফলে কৃষককে গুনতে হচ্ছে কয়েকগুন সেচচার্জ। সরকার এ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করলেও কৃষকের সেচ খরচ কমছে না।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একই মাঠে প্রতিটি সেচপাম্পের সেচ চার্জ ভিন্ন ভিন্ন। উপজেলা সদর সংলগ্ন দোহাকুলার বদ্দিডাঙ্গির মাঠে বিএডিসির স্থাপিত ডিপ টিউবওয়েলের আওতায় শুধু বোরো আবাদে প্রতি বিঘা (৫২শতক) জমির সেচ চার্জ দিতে হচ্ছে ৩ হাজার টাকা। মাত্র পাঁচশ গজ উত্তরে চেচুয়াখোলা গ্রামের ডিপ টিউবওয়েলে প্রতি বিঘা জমির সেচ চার্জ ১৬’শ টাকা। তালবাড়িয়ার ডিপ টিউবওয়েলে ২ হাজার টাকা। আবার এ মাঠেই দোহাকুলা উত্তর পাড়ার দু’টি ব্লকে সেচ চার্জ দেড় হাজার টাকা। জানা গেছে, দোহাকুলা বদ্দিডাঙ্গির ডিপ টিউবওয়েল চলে একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। দোহাকুলা গ্রামে বিএডিসির স্থাপিত অন্য একটি ডিপ টিউবওয়েল একজন জনপ্রতিনিধি তার একক নিয়ন্ত্রণে চালাচ্ছেন। এই ব্লকে বোরো আবাদ হয় এক’শ বিঘার উপরে। তিনি গত মৌসুম পর্যন্ত ডিপ টিউবওয়েলটি বছর প্রতি এক লাখ টাকায় লিজ দিতেন। অধিক আয়ের আশায় এবার নিজেই পরিচালনা করছেন। এই ডিপটিউবওয়েলে বিঘাপ্রতি সেচ চার্জ ৩ হাজার টাকা।
পাইকপাড়ার বিল জলেশ^রের খালে বিএডিসি স্থাপিত পাশাপাশি পাঁচটি সেচপাম্প (এলএলপি) রয়েছে। যার চারটি চলে কয়েজনের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। বাকি দুটি চলে ব্যক্তি মালিকানায়। প্রতিটি ব্লকেই এক থেকে দু’শ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এখানকার চাষিরা জানান, প্রতিবিঘা জমিতে সেচ খরচ হয় সাত থেকে আট’শ টাকা। আর তাদের দিতে হচ্ছে দেড় হাজার টাকা। এমন চিত্র বাঘারপাড়ার প্রতিটি মাঠেই। ব্যক্তি মালিকানাধীন স্যালো টিউবওয়েলে সেচ চার্জ আরো বেশি। ডিজেল বাদে শুধু স্যালো ইঞ্জিনের ভাড়া দিতে হয় বিঘা প্রতি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। এর এক বিঘা জমি চাষ করতে মৌসুম ভেদে ডিজেল লাগে ৫০ থেকে ৮০ লিটার। অতিরিক্ত সেচ চার্জ নেওয়ার বিষয়ে উপজেলা সেচ কমিটির কাছে কেউ অভিযোগ করেছেন কিনা এমন প্রশ্নে কৃষকরা জানান, সেচ পাম্প যাদের নিয়ন্ত্রণে আছে তারা সকলেই ক্ষমতাশালী। ভয়ে কেউ অভিযোগ দেন না। যশোর বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে, বাঘারপাড়ায় বিএডিসি নিয়ন্ত্রিত সেচপাম্প রয়েছে ৫৮টি। এর মধ্যে ডিপ টিউবওয়েল ২৪টি ও এলএলপি (নদী ও খালে স্থাপিত) রয়েছে ৩৬টি। এর প্রতিটি প্রকল্প অনুমোদনের প্রধান শর্ত ছিলো সমবায়ের ভিত্তিতে সেচ কাজ পরিচালিত হতে হবে। প্রতিটি প্রকল্পেই খাতা কলমে সাত থেকে ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটিও রয়েছে। যে কমিটি ও জমির মালিক মিলে সেচ চার্জ নির্ধারণসহ যাবতীয় কার্য সম্পাদনের শর্ত রয়েছে। অথচ মাঠ পর্যায়ে এর কোন বাস্তবতা নেই।
বিএডিসি যশোর জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী জামাল ফারুক জানান, একটি দুই কিউসেকের ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করতে সরকারের ব্যয় হয় ১৮ থেকে ২৪ লাখ টাকা। আর এক কিউসেকের একটি এলএলপি স্থাপন করতে ব্যয় হয় ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা। একটি প্রকল্পে কৃষকের সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ থাকে ২০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। ব্যয়বহুল এই প্রকল্প স্থাপনে সরকারের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষক যেন কম সেচ চার্জে চাষাবাদ করতে পারে। বিএডিসির জনবল এতই কম যে, সেচ চার্জের বিষয়ে তদারকি করার কোন সুযোগ নেই। তবে সেচ চার্জের বিষয়ে উপজেলা সেচ কমিটির কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তেমন অভিযোগ থাকলে অবশ্যই সেচ কমিটি তার সমাধান করবে। দোহাকুলা গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, সরকারের উচিত প্রতিটি সেচ পাম্পে সেচ চার্জ নির্ধারণ করে দেওয়া। বিশেষ করে বিএডিসির স্থাপিত সেচ পাম্পে কৃষি অফিস, সমবায় অফিস, বিএডিসি ও নির্বাহী অফিসারের প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি কমিটি যদি সেচ চার্জ নির্ধারণ করে তাহলে কৃষক উপকৃত হবে। বিএডিসির ক্ষুদ্র সেচ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী ধীরেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথ জানিয়েছেন, উপজেলা সেচ কমিটিই সেচ চার্জ নির্ধারণ করবে। সেচপাম্প বা মাঠ ভেদে সেচ চার্জের পার্থক্য হতে পারে। ব্যক্তি মালিকানাধীন সেচপাম্পে মালিকের লাভের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। আর বিএডিসি স্থাপিত সেচপাম্পে লভ্যাংশের কোন প্রশ্নই ওঠে না। বিদ্যুৎ বিল, সেচ কাজে নিয়োজিত কর্মী, সেচনালার রক্ষণাবেক্ষণসহ মোট যে টাকা ব্যয় হবে তা জমির অংশ হিসেবে কৃষকের কাছ থেকে নিতে হবে। এর থেকে বেশি নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। কোথাও এর ব্যতিক্রম ঘটলে উপজেলা সেচ কমিটির কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা সেচ কমিটির সভাপতি আ.ন.ম. আবুজর গিফারী বলেন, অতিরিক্ত সেচ চার্জ নিয়ে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।