চাই আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু

0

অধ্যাপক ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম
আমাদের সবারই প্রত্যাশা দীর্ঘায়ু; আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ুর। প্রয়োজন নির্মল বায়ু আর স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও নির্ভেজাল পুষ্টিসম্পন্ন খাবারের। একদিন এটা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক; কিন্তু এখন এটা একটা দুঃস্বপ্ন। পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত পরিবেশের দূষিত বায়ুর মধ্যে আমাদের বসবাস। নেই কোনো নিরাপদ খাবারের নিশ্চয়তা। নিরাপদ খাবার খুঁজে পেতে আমাদের হয়রান হতে হয়। জলবায়ু নিয়ে কথা উঠলেই কাবর্ন নিঃসরণের বিষয়টি সামনে আসে। এটি এখন আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। শুধু কার্বন নিঃসরণ নয়, বর্জ্য অব্যস্থাপনার কারণে বৈশ্বিক পরিবেশ আজ বিপন্ন। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। বৈশ্বিক পরিববেশ দূষণের প্রক্রিয়ায় গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ, পানিদূষণ, পরিবেশে এসিড-ক্ষরণ, নির্বিকার বন উজাড়করণ, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা স্বাভাবিক জীবনের প্রত্যাশাকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছে। এর ওপর যোগ হয়েছে শক্তিমত্তার যুদ্ধের ডামাডোল। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, উপসাগরীয় যুদ্ধ, আফগান যুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক ইউক্রেন যুদ্ধ পরিবেশ, জলবায়ু, ভূমি এবং কৃষি ও শিল্পপণ্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এক প্রতিবেদন বলেছে, সহিংসতা, নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বে কোটির উপরে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, যার সংখ্যা প্রায় আট কোটি ৪০ লাখ ছাড়িয়েছে। এসবই জলবায়ুর ওপর প্রভাব ফেলেছে। বৈশ্বিক তাপমাত্র বৃদ্ধির ফলে হিমবাহ গলনের পরিমাণ বাড়ছে। সৃষ্টি করেছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ানোর ভয়াবহ সম্ভাবনা। জলবায়ুর এই পরিবর্তনের জন্য মানুষের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দায়ী। আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রায় ২৫ শতাংশ বনভূমির প্রয়োজন। অথচ বাংলাদেশে এর পরিমাণ মাত্র ১৭.৪ ভাগ। বনভূমিকে পৃথিবীর ফুসফুসও বলা হয়। অথচ নির্বিচারে বন উজাড় করা হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ভাষ্যমতে, বিশ্বব্যাপী ২০০০-২০১৫ সময়কালে প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বন উজাড় করা হয়েছে। বাংলাদেশে তা ২ দশমিক ৬ শতাংশ। এভাবে বন উজাড় অব্যাহত থাকলে অদূরভবিষ্যতে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়বে। নির্বিচারে বনাঞ্চল ধ্বংস করা গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ বাড়ানো, নিয়ন্ত্রণহীন কার্বন নিঃসরণ, অপরিমিত মাত্রায় কৃষি এবং অন্যান্য কাজে রাসায়নিকের ব্যবহার, প্রাকৃতিক জলাধারগুলোর ক্ষতিসাধন – সবকিছুই আমাদের নিঃশ্বাসের বায়ুকে দূষিত করছে। আমাদের জীবনাচার বদলে যাওয়ার সাথে পৃথিবীতে রেডিয়েশন-জনিত বর্জ্যরে পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলছে। এর সাথে যোগ হয়েছে শব্দদূষণের মাত্রা। বেড়েছে অসংক্রমণজনিত রোগের পরিমাণ। বেড়েছে হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চর্মরোগ ও কিডনি রোগীর সংখ্যা। বাড়ছে মরণবিধি ক্যান্সারের পরিমাণ। অতিমারী করোনা রোগের মতো রোগগুলো বারবার ফিরে আসছে। বাড়ছে প্রজনন স্বাস্থ্যের বিভিন্ন অসুখ ও গর্ভপাতের সংখ্যা। একই সাথে বাড়ছে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম। শিশুদের মানসিক বুদ্ধিবৃত্তিক পূর্ণতার বিকাশ হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। ক্ষুধামন্দা, খিটখিটে মেজাজ, নিদ্রাহীনতা আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত দিন যাচ্ছে মানব প্রজন্ম ততই ওষুধনির্ভর হয়ে পড়ছে। বিরূপ পরিস্থিতি ও পরিবেশের মধ্যেই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। সুস্থ থাকতে হবে। জীবনের লড়াই তো আর থেমে থাকবে না। এ জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয় ও বৈশ্বিক নীতিমালা। অপরিকল্পিত নগরায়ন বন্ধ করার পাশাপাশি দরকার কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা। এ ক্ষেত্রে যানজট কমানোর কোনো বিকল্প নেই। পুরনো লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা গাড়িগুলোকে পথে চলতে না দেয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। রাস্তার ধারণক্ষমতার সীমার মধ্যে যানবাহন চলাচল করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। প্রয়োজন ইটভাটার নিয়ন্ত্রণ। এক দিকে যেমন দরকার নির্বিচারে গাছ কাটা বন্ধ তেমনি দরকার বৃক্ষরোপণ বেগবান করা। খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিকের ব্যবহার কমানো অত্যন্ত জরুরি। যত্রতত্র প্লাস্টিকের ব্যবহার কঠোর হস্তে বন্ধ করা প্রয়োজন। প্রয়োজন ইলেকট্রনিক বর্জ্যসহ সবধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এসব সরকারি নীতিমালা ও আইনের সাথে সাথে এর সুষ্ঠু প্রয়োগ এবং কঠোর বাস্তবায়ন করা দরকার। প্রয়োজন জীবনবাস্তব নীতিমালা ও প্রযুক্তির। নইলে একদিন গোটা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি অসুস্থ জাতিতে পরিণত হবে।
লেখক : অধ্যাপক ও চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ