‘একুশ’ কি বাঙালি সংস্কৃতি?

0

তৈমূর আলম খন্দকার
‘বাংলা’ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য আন্দোলন শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ থেকে। এ আন্দোলনের পেছনের থিংকট্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করেছে তমদ্দুন মজলিস যারা ইতিহাসের পাতায় এখন অবহেলিত। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ও তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের সাথে ১৯৪৮ সালে চুক্তি সম্পাদিত হয়। পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ১৯৫২ সালের ২৪ জানুয়ারি পল্টনে এক সমাবেশে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে ১৯৪৮ সালে সম্পাদিত চুক্তি লঙ্ঘন করে। ফলে বাঙালির মন-মগজে ও চেতনায় পাকিস্তান ভাঙনের বীজ রোপিত হয়েছিল। জিন্নাহ সাহেবের ভয় ছিল যে, ভৌগোলিক আধিপত্যের কারণে যেকোনো সময় পূর্ব পাকিস্তানকে ভারত দখল করে নিতে পারে। এ জন্য বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার সাহিত্য ও সম্মিলিত বাঙালির চেতনা যাতে সমৃদ্ধ হতে না পারে সে জন্য পাকিস্তানি শাসকদের একটা চেষ্টা ছিল। জিন্নাহ অবশ্য তার জীবনসায়াহ্নে মৃত্যুকালে অনুতপ্ত হয়ে স্বীকার করেছেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ পল্টন ময়দানে এ ঘোষণা দেয়া ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের চরম ভুল। ভাষা নিয়ে কোনো জাতিই আপস করেনি, যেমন- আসাম তাদের মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন শুরু হওয়ার আগেই অনুরূপ আন্দোলন করেছিল। ১০ অক্টোবর ১৯৬০ সালে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়কে (আসামের আদিবাসীদের ভাষা) সরকারি ভাষা করার জন্য প্রস্তাব দেয়ার প্রতিবাদে শিলচর রেল স্টেশনে সত্যাগ্রহীদের ওপর আসামের প্যারামিলিটারি বাহিনী সাত মিনিট ১৭ রাউন্ড গুলি ছুড়ে, তাতে ১১ জনের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য নামে দশম শ্রেণীর এক ছাত্রী ছিল। তারফলে বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে সহযোগী সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। গুলিবর্ষণের এলাকাভুক্ত রেল স্টেশনকে জনগণ ‘ভাষাসৈনিক শিলচর রেল স্টেশন’ নামকরণ করেছে। বাংলাদেশেও অনেক নৃগোষ্ঠী আছে, যাদের নিজস্ব ভাষা ও কৃষ্টি রয়েছে। সে নৃগোষ্ঠীদের মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ বা প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় না। বাংলাদেশে ৪১টি নৃগোষ্ঠী ভাষা রয়েছে, তন্মধ্যে ২০১৪-১৫ সালের সরকারি জরিপ অনুযায়ী ১৪টি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরাকান থেকে আসা রেংমিটচ্য ভাষার মাত্র ছয়জন নারী-পুরুষ এখন জীবিত আছে। এদের মৃত্যুর সাথে সাথে ওই ভাষার মৃত্যু ঘটবে।
১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কারণে পাকিস্তানের অনুগত বাঙালি পুলিশ বাহিনীর গুলিতে ছালাম, বরকত, জব্বার, রফিকদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। বাঙালি জাতি তাদের আজো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। ওই রক্তদানের ঘটনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাজধানীতে নির্মিত হয়েছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং এর অনুসরণে দেশব্যাপী প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্মিত হয়েছে শহীদ মিনার। প্রতিবারই একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র, জনতা, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শ্রমজীবীসহ আপামর জনগণ শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে আত্মোৎসর্গকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। তাদের বসতভিটায় স্থাপিত হয়েছে পাঠাগার ও স্মৃতিরক্ষার স্মারক। বাঙালি জাতি তাদের ভোলেনি, কিন্তু বাংলা কি ব্যবহারিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষায় পরিণত হয়েছে? মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা কি এক বিষয়? এখানে তারতম্যটা কোথায়? ব্রিটিশ বংশোদ্ভত এক বাঙালি নারী যার ভাষা বাংলা, তার গর্ভে জন্মগ্রহণকারী কোনো শিশু যদি বাংলা ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে তখন বাংলাই হবে তার মাতৃভাষা; অর্থাৎ প্রতিটি শিশুর মায়ের ভাষাই তার মাতৃভাষা, যদিও তার পিতা ভিন্ন জাতি বা মনের ভাব প্রকাশে অন্য ভাষা ব্যবহার করে। রাষ্ট্রীয় কার্যে ব্যবহৃত ভাষাই রাষ্ট্রভাষা। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রজাতন্ত্রের পরিচিতি চ্যাপ্টারে ৩ নং ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। যেহেতু সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের ভাষা বাংলা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে সেহেতু রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ব্যবহারে কোনো আপত্তি নেই এবং রাষ্ট্রের উচ্চ আদালত ব্যতীত রাষ্ট্রীয়ভাবে সব কার্যক্রম বাংলাতেই সম্পাদিত হচ্ছে। তার পরও ফাঁকফোকর অনেক রয়ে যায়; কারণ বাংলার প্রচলন কি সঠিকভাবে হচ্ছে? বিদেশী অনেক শব্দ বাংলায় প্রবেশ করেছে। যেমন- ইংরেজি, উর্দু, ফারসি, ফরাসি, পার্সি প্রভৃতি। ভাষাবিদরা মনে করেন, এতে ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু এর পরও কথা থেকে যায়, যেখানে বাংলায় প্রকৃত শব্দার্থ রয়েছে সেখানে আমরা বিদেশী শব্দকে আমদানি করে বাংলা অভিধানের কলেবর বৃদ্ধি কেন করব? বরং প্রচলিত বাংলা ভাষাকেই শুদ্ধ ব্যাকরণের মাধ্যমে আরো শ্রীবৃদ্ধি করা সম্ভব। বাংলাকে সঠিকভাবে মর্যাদাশীল করার জন্য ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ আন্তর্জাতিক আনুষ্ঠানিকতা লাভ করল বটে, কিন্তু সেখানে ৮ ফাল্গুন প্রতিষ্ঠিত হলো না কেন? বাংলা সন ‘গণনার’ ইতিহাস ১৪ শ’ বছরের অধিক পুরনো এবং বাংলার আদি ব্যবসায় বাণিজ্যসহ জমিদারি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সব প্রকার হিসাব-নিকাশ বাংলা সনকেই অনুসরণ করা হতো। বাংলার সাহিত্যচর্চা এবং বাংলার ঐতিহ্য ও কৃষ্টি পৃথিবীর কোনো ভাষার চেয়ে কম নয় এবং সে কারণেই প্রতিটি বিষয়ে বাংলাকেই অগ্রাধিকার দেয়া বাঞ্ছনীয়। একুশে ফেব্রুয়ারির সাথে ৮ ফাল্গুনকে প্রতিষ্ঠিত করা বর্তমানে একটি যৌক্তিক দাবি এবং এ দাবি বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জাতির মুখ রক্ষা পাবে। মোটাদাগে বলতে হয়, ৮ ফাল্গুন তারিখ বাঙালি কৃষ্টি ও সংস্কৃতির একটি অংশ, পক্ষান্তরে একুশে ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সংস্কৃতি থেকে এসেছে, যারা প্রায় ২০০ বছর আমাদের শাসন, শোষণ ও নানাবিধভাবে নির্যাতন করেছে।
বাংলা ভাষা যথাযথ মর্যাদার সাথে রাষ্ট্রীয়ভাবে আরো মর্যাদাশীল না হওয়ার কারণ হলো-
১. বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধশালী করার জন্য পর্যাপ্ত গবেষণার ব্যবস্থা নেই। গবেষণার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলো বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমি এখন দলীয় কোটারিতে অভিযুক্ত। বাংলা একাডেমি গবেষণার জন্য কেবল সরকারি ঘরানার মানুষগুলোকে মূল্যায়িত করে বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড বা পুরস্কার দেয়ার মাধ্যমে। ফলে বাংলা একাডেমি এখনো সর্বজনীন হতে পারেনি।
২. বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে লিখতে না জানাও বাংলার মর্যাদা রক্ষা করার একটি প্রতিবন্ধকতা। ইংরেজি ভাষাশিক্ষার প্রতি আরো মনোযোগী হওয়ার আমি পক্ষপাতী, কারণ ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে প্রসার লাভ করেছে। ফলে শুদ্ধ আকারে ইংরেজি ভাষাশিক্ষা করা যেমন প্রয়োজন ঠিক তেমনি শুদ্ধভাবে বাংলা লেখাপড়া, উচ্চারণ সঠিকভাবে প্রয়োগের শিক্ষা গ্রহণ করা অত্যন্ত বাঞ্ছনীয়।
৩. বাংলাদেশে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে বটে, কিন্তু গোটা জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ এখনো সাধারণ বাংলা লেখা ও পড়তে পারার জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। স্বাধীনতার পর নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া হলেও পরবর্তী সময়ে সরকারের সদিচ্ছার ভাটা পড়ায় পরিকল্পনাটি ভেস্তে যায়। দেশের শিক্ষিত ছাত্রসমাজ স্বউদ্যোগে বছরে অন্তত পাঁচজন বয়স্ক নিরক্ষরকে অক্ষরজ্ঞান অর্থাৎ লিখতে ও পড়তে শিক্ষা দিলে তবে অতি অল্প সময়ে সরকারি কোনো প্রকার মোটা অঙ্কের বাজেট ছাড়াই জাতিকে নিরক্ষরমুক্ত করা সম্ভব। যে ছাত্র বছরে পাঁচজনকে অক্ষরজ্ঞান দান করবে তাকে বার্ষিক পরীক্ষায় একটি নির্দিষ্ট নম্বর যোগ করার সুযোগ দিলে শিক্ষিত ছাত্ররা প্রাকটিক্যাল ক্লাসে তাদের আশপাশের নিরক্ষর লোককে অক্ষরজ্ঞান দানে উৎসাহী হবে। তবে যে ব্যক্তিকে অক্ষরজ্ঞান দান করা হবে সে যে নিরক্ষর ছিল তা প্রমাণে দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট শিক্ষিত ছাত্রের ওপরই বর্তাবে। এমনিভাবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিয়ে যথাশিগগিরই জাতি নিরক্ষরমুক্ত হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারে। সবাই বলি যে, ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। যে কারণে একুশ সৃষ্টি হলো তা মর্যাদার আসনে না বসাতে পারলে ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে বড় দাগে প্রশ্ন থেকে যাবে।
বাংলা সনের ৮ ফাল্গুনকে অনুসরণ না করে ইংরেজি ক্যালেন্ডারভুক্ত একুশকে কেন টেনে আনা হলো? উল্লেখ্য, ভাষাসৈনিকরা যেদিন ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন করে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল সে তারিখটি ছিল ৮ ফাল্গুন এবং এ কথাটি যেন আমরা সবাই ভুলে গেছি।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, কেন্দ্রীয় নিরক্ষরতা
দূরীকরণ সংস্থা