মহান শহীদ ও ভাষা দিবস সংখ্যা-২০২২

0

একুশের চেতনা
নার্গিস বেগম

২১শে ফেব্রুয়ারি। মহান শহীদ দিবস। একই সাথে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতি যথাযোগ্য মর্যাদায় আবেগাপ্লুত হৃদয়ে মহান শহীদদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে শ্রদ্ধাবনত হবে। গণমাধ্যমে, সভা-সেমিনারে একুশের চেতনার কথা সাড়ম্বরে উচ্চারিত হবে। কি সেই চেতনা ? একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। আমি তখন সবেমাত্র স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ছাত্রী। কলেজ থেকে একুশের শহীদদের স্মরণে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে আয়োজিত মিছিলে অংশ নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে বাড়ি ফিরেছি। স্লোগানে স্লোগানে শহর প্রকম্পিত। অনেক স্লোগানের মধ্যে একটি ছিল, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। স্লোগানটি আমার তৎকালীন সীমিত জ্ঞানে অপ্রাসঙ্গিক মনে হওয়াতে আব্বাকে খানিক বিরক্তি নিয়েই প্রশ্ন করেছিলাম- ‘শহীদ দিবসে এ স্লোগান কেন ? এটা কি বোকামি নয় ? আব্বা সেদিন বুঝিয়েছিলেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠা করা শুধু নয়, আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, খাদ্যসহ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সকল দাবি বাস্তবায়ন করতে হলে স্বায়ত্তশাসন অর্থাৎ নিজের বিষয়ে নিজের সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীনতা প্রয়োজন। সেজন্যেই স্বায়ত্তশাসনের দাবি।


ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেই কিন্তু সেদিন আন্দোলন থেমে যায়নি। ধারাবাহিক আন্দোলনের রক্তাক্ত পথ বেয়ে স্বায়ত্তশাসন নয়, অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। পাকিস্তানের একাংশ পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নাম নিয়ে স্বাধীন দেশ হিসাবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। সংগ্রামী জনতা, নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে স্বজন, সম্পদ হারানো কোটি কোটি মানুষ উজ্জীবিত হয়ে উঠলো লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশায়। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় অচিরেই দেশবাসী মুহ্যমান হয়ে পড়লো। যে বীর যুবকের দেশ মাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে জীবন তুচ্ছ করে অস্ত্র হাতে শত্রু নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাদের অধঃপতন, পথভ্রষ্টতা বিস্মিত, সাথে সাথে শঙ্কিত করে তুললো দেশবাসীকে। নব্য স্বাধীন দেশে শহীদ মিনার ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবাঞ্ছিত কর্মকাণ্ডে কলঙ্কিত হল। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধায় দেশ ভরে গেল। শব্দ ভাণ্ডারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নামে নতুন শব্দ সংযোজিত হল। জন্ম নিল নতুন ‘বাদ’। যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এত লড়াই সেই গণতন্ত্র নিহত হল নব্য আমদানিকৃত বাক্শালের নিষ্পেষণে। ভিন্ন মতের প্রায় অর্ধলক্ষ মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেল। যত্রতত্র লাশ আর লাশ। খাদ্যের জন্য কুকুরে মানুষে লড়াই। বস্ত্রহীনের লজ্জা ঢাকবার একমাত্র উপায় রাতের আঁধার। এই ঘোর অমানিশা কাটাতে ঐক্যবদ্ধ হল সিপাহী জনতা। পরিবর্তন এল রাজনীতিতে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশবাসীর স্বতন্ত্র রাষ্ট্রীয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় নিশ্চিত হল। প্রতিষ্ঠিত হল বহুদলীয় গণতন্ত্র। কিন্তু আবারও ষড়যন্ত্র। দেশি-বিদেশি চক্রান্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের নায়ক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলেন। জেঁকে বসলো সামরিক শাসন। দীর্ঘ নয় বছর আপোষহীন লড়াই করে শহীদ জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরী বেগম খালেদা জিয়া সামরিক জান্তার সরকারকে উৎখাত করেন সংগ্রামী জনতাকে সাথে নিয়ে। একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুল গণরায়ে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী দল বিজয়ী হয়। সরকার গঠন করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে গণতন্ত্রের পথ চলাকে সুগম করতে সচেষ্ট হন তিনি। কিন্তু থেমে থাকেনি চক্রান্ত। নব্য বাকশালীরা প্রতিজ্ঞা করলেন, একদিনও শান্তিতে থাকতে দেবেন না। তাই হল। সরকারের উদারতা ও সহিষ্ণুতার সুযোগ নিয়ে সমগ্র দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে আওয়ামী লীগ। ১৭৬ দিন হরতাল করে দেশ অচল করে দেয় আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করলেন। আওয়ামী লীগ সে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সেই নির্বাচনের মাধ্যমে সৃষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচিত হয়ে ১৯৯৬তে সরকার গঠন করেছে। একই ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচিত হয়ে ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয় পুনরায়। ২০০৭ সালের নির্ধারিত নির্বাচনের পূর্বে পুনরায় অস্থিতিশীল অবস্থা সৃষ্টি করে সেনা সমর্থিত অগণতান্ত্রিক সরকারকে স্বাগত জানায়। গণতন্ত্র আবারও অন্ধকারে নিমজ্জিত হল। দু’বছর রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং রাজনীতিবিদরা নিগৃহীত, নির্যাতিত, অপদস্ত হলেন। ২০০৮ এ জনদাবির মুখে ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দীন-এর সরকার নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাদের স্বাগত জানানোর জন্য কৃতজ্ঞতাবোধ ও গত দু’বছরের অপকর্মের দায়মুক্তির নিশ্চয়তার বিনিময়ে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করতে সমস্ত প্রশাসনকে ব্যবহার করে। সে নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া ডাক দিয়েছিলেন ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’। কিন্তু শেখ হাসিনা দশ টাকা সের চাল এবং ঘরে ঘরে চাকরি দেবার চটকদার প্রতিশ্রুতিতে দেশবাসী বিভ্রান্ত হয়েছিল। দেশবাসীর ভ্রান্তি এবং মঈন-ফকরুদ্দীন-এর অবৈধ সরকারের সহায়তায় শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হলেন। তারপর থেকে দশ বছর চলছে তার শাসন। ২০১৪তে ভোটারবিহীন নির্বাচনে ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে নতুন ইতিহাস গড়লেন। ২০১৮তে একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। নির্বাচনের নির্দিষ্ট দিনের পূর্ব রাত্রিতেই প্রশাসনের সাহায্যে ব্যালটবাক্স ভর্তি করে ফেলা হল। বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের এবং তার কর্মীদের ভোট কেন্দ্রের ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেওয়া হল না। এভাবে আবারও জঘন্য পন্থায় শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হলেন। এই নির্লজ্জ এমপিগণ নিজেদের জনপ্রতিনিধি হিসাবে দাবি করে সংসদ আলো করে বসে আছেন। আবার শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভাঙা রেকর্ডের বাজনা।
এই চেতনার ফেরিওয়ালারা আজ সারাদেশে প্রেতনৃত্য করছে। ভাষা শহীদদের চেতনায় যে মুক্তবাকের স্বপ্ন ছিল, পরবর্তীতে যা স্বায়ত্তশাসনের দাবির মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিণত হয় সে স্বপ্ন আজ ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। একুশের শিক্ষা হচ্ছে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াবার শিক্ষা। ন্যায্য দাবির পক্ষে জোরালো কন্ঠে আওয়াজ তোলা। অন্যায়ের প্রতিবাদে দুষ্ট দমনে সাহসী ভূমিকা নেওয়া। আজ সেই শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। যুগে যুগে যে যুবশক্তি জীর্ণ পুরাতনকে হটিয়ে নতুনকে আহ্বান করেছে সে শক্তি আজ হীনবল, নিবীর্য। ভীরু, নিরুদ্যম। যে স্বাধীনতার জন্য দামাল ছেলেরা জীবনবাজি রেখেছিল সে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আজ অন্যের অঙ্গুলি হেলনে নিয়ন্ত্রিত। একটি নতজানু, পুতুল সরকার নিজ স্বার্থে সার্বভৌমত্বকে বিকিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু জাতি আজ প্রতিক্রিয়াহীন। রুদ্ধ গণতন্ত্র, পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন ব্যবস্থা, বিধ্বস্ত অর্থনীতি, ধ্বংসপ্রাপ্ত, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীনতা, অকার্যকর শিক্ষা ব্যবস্থা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, শিশু ও নারীর প্রতি সীমাহীন সহিংসতা কোন কিছুই যেন জাতির মরণ ঘুমকে বিঘিœত করতে পারছে না।
একুশের চেতনা, শিক্ষা তো এটি নয়। তাহলে কেন এই নিষ্ক্রিয়তা ? আমরা কি নতুন করে অন্য কারো শৃঙ্খলাকে কন্ঠে ধারণ করবো ? সিকিম ও সম্প্রতি কাশ্মিরী জনগণের ভাগ্য কি আমাদের শঙ্কিত করে না ? যে গণতন্ত্রের জন্য সেই ১৯৪৭ থেকে এদেশের মানুষ ধারবাহিকভাবে নিরন্তর সংগ্রাম করেছে সেই গণতন্ত্র আজ শৃঙ্খলাবদ্ধ। কণ্ঠরোধ করে আছে নিবর্তনমূলক আইন। জঙ্গীবাদের জুজুর ভয় দেখিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তুলে সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি বিনষ্ট করে বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে যুবশক্তিকে মাদক এবং লোভের গহ্বরে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ভিন্ন মতের কারণে জীবনাশংকা দেখা দিচ্ছে। এ সবই একুশের শিক্ষা ও আদর্শের বিপরীত। এই ফেব্রুয়ারিতে শপথ নিতে হবে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার। এ লক্ষ্যে প্রয়োজন খালেদা জিয়ার মুক্তি। তিনি মুক্ত হলে গণতন্ত্র মুক্ত হবে। দেশ বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে। শপথ হোক মাথা উঁচু করে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াবার।


রাষ্ট্রভাষা মাতৃভাষা
পাভেল চৌধুরী

রাষ্ট্রভাষা আর মাতৃভাষা বিষয়টাকে কোনো ভাবে এক করা যাবে না। মাতৃভাষা সহজাত কিন্তু রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। রাষ্ট্রের গৃহীত সিদ্ধান্তে মাতৃভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বা অসন্তোষ দেখা দিতে পারে, সেই অসন্তোষ আন্দোলনেও রূপ নিতে পারে। ৫২র ভাষা আন্দোলন ছিল এমনই একটা আন্দোলন। যদিও এই আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত ছিল আরও বিস্তৃত। ভাষার প্রশ্নটা সামনে এসেছিল ১৯৪০ সালে পকিস্তান প্রস্তাব পাশ হওয়ার পরপরই। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এটাই ছিল প্রশ্ন। তারও আগে ভারতের স্বাধীনতার দাবি যখন উঠেছিল তখনও রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটা সামনে এসেছিল। স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এই প্রশ্নে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উঠেছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বিরোধীতা করেছিলেন এই প্রস্তাবের। যাহোক, বিভিন্ন ভাষাভাষী প্রদেশ নিয়ে গঠিত হয়েছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষার জন্য প্রধানত দুইটা বিষয়কে নির্ধারণ করা হয়েছিল; ধর্ম এবং ভাষা। এই উদ্দেশ্যেই উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব হয়েছিল। এই প্রস্তাবের পেছনে ধারণা করা হয় প্রচ্ছন্ন সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা ছিল আর সেটা হলো প্রদেশ সমূহের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে দূর্বল করা। উর্দু পাকিস্তানের কোনো প্রদেশেরই মাতৃভাষা ছিল না। স্বয়ং মুহম্মদ আলী জিন্নাহর মাতৃভাষাও উর্দু ছিল না। সমগ্র পাকিস্তানের সাকুল্যে শতকরা ৩/৪ জন মানুষের মাতৃভাষা ছিল উর্দু। কাজেই উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত যে কোনো ব্যক্তি বিশেষের একক ইচ্ছের প্রতিফলন এরকম মনে করার কারণ নেই। অনেক স্বনামধন্য বাঙালি বুদ্ধিজীবীর সম্মতি ছিল এই সিদ্ধান্তে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হলে উর্দৃু ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে দাবি করেন সদস্য ধিরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করেন নাজিমুদ্দিন তমিজউদ্দীন খান সহ বাঙালি অবাঙালি নির্বিশেষে গণপরিষদের সকল মুসলিম লীগ সদস্য। গণপরিষদে বাংলা ভাষা বিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও তমুদ্দুন মজলিসের যৌথ উদ্যোগে ২রা মার্চ ফজলুল হক হলে কামরুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত রূপ দেওয়ার জন্য গণ আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমুদ্দুন মজলিস, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ইত্যাদি দল থেকে প্রতিনিধি নিয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ নামে একটা সর্বদলীয় পরিষদ গঠন করা হয়। ১১ মার্চ এই পরিষদ সমগ্র পূর্ব বাংলায় ধর্মঘট আহ্বান করে। এভাবেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ইতিহাস দেখলে দেখা যাবে ভারতের রাষ্ট্রভাষা একসময় ছিল ফারসি। বাংলা ভাষা তখন সংগঠিত রূপ লাভ করেছিল। বাংলা ভাষায় বিখ্যাত সব কবিদের
আবির্ভাব হয়েছিল সেই সময়। এর আগে সূলতানি আমলে রাষ্ট্রভাষা কি ছিল সে ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না তবে বাংলা ভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর। তখন আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাষা সংস্কারের নামে বাংলা ভাষায় বহমান আরবি ফারসি শব্দ বর্জন করে সেখানে সংস্কৃত শব্দের প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। তারও অনেক পরে ১৮৩৭ সালে ভারতের রাষ্ট্রভাষা হলো ইংরেজি (১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতের একচেটিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা সত্ত্বেও প্রায় ১০০ বছর ইংরেজরা ভারতে রাষ্ট্রভাষা ফারসি অব্যাহত রেখেছিল)। বলা যাবে না রাষ্ট্রভাষার এই সিদ্ধান্ত বাংলা ভাষাকে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত করতে পেরেছিল। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক সব কবি সাহিত্যিকদের জন্ম হয়েছিল সেই সময়ে। ভাবতে অবাকই লাগে ১৮৩৫ সালে প্রথম যখন কলকাতায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তখন সেখানে চিকিৎসাশাস্ত্র বাংলায় পড়ার সুযোগ ছিল। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে কেন সারা পূর্বপাকিস্তানের জনগণ বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছিল তার কারণ শুধুমাত্র ভাষা প্রশ্নের মধ্যেই খুঁজলে পাওয়া যাবে না। এর উত্তর খুঁজতে হবে আরও বিস্তৃত পরিসরে। যেখানে শুধু মাত্র ভাষা না, নব গঠিত পূর্বপাকিস্তানের আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক
পরিস্থিতি বিবেচনায় আনতে হবে। আগেই উল্লিখিত হয়েছে ১৯৪০ সালে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এই বিতর্ক উঠেছিল। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব পর্যন্ত এই বিতর্ক ছিল কাগজে কলমে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরই নবগঠিত সরকারের নানাবিধ সিদ্ধান্তের ফলে এই জনপদের মানুষের মনে অসন্তোষ আর সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছিল। প্রথমত শাসক দল মুসলিম লীগের মধ্যেই নানা ধরনের বিরোধ চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছিল। এই বিরোধ ছিল মুসলিম লীগের কায়েমি স্বার্থবাদী অংশ- পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠি আর পূর্বপাকিস্তানের নবাব-
খাজা পরিবারের সাথে পূর্বপাকিস্তানের গণমুখি রাজনীতিকদের। এদিকে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্বপাকিস্তানের প্রতি কেন্দ্রের বৈষম্যমূলক নীতি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। যে বিপুল স্বপ্ন আর সম্ভাবনায় উজ্জিবিত হয়ে এই জনপদের মানুষ অকাতরে পাকিস্তান সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিল অচিরেই তাদের মনে হতাশার কালো ছায়া ঘনিভূত হয়ে উঠছিল। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দুর্ণীতি ইত্যাদির উত্তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছিল আর স্পষ্ট হচ্ছিল দুর্ভিক্ষের আভাস। মুসলিম লীগের নেতারা তখন ক্ষমতার লড়াই আর নিজেদের আখের গোছানোয় ব্যস্ত। এমত পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে জীবনে প্রথমবারের মতো ঢাকায় এসে ২১শে মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দি উদ্যান) উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে এই ঘোষণার মধ্যে এই জনপদের মানুষ তাদের অধিকার হারানোর সুর শুনতে
পায়। পাকিস্তানের প্রদেশ সমূহের মধ্যে পূর্বপাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সর্বাধিক। ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যাও ছিল সবার চেয়ে বেশি, কাজেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবি কোনোঅংশে অযৌক্তিক ছিল না বরং শুরু থেকে পাকিস্তানের শাসকরা নানা প্রশ্নে পূর্বপাকিস্তানের প্রতি বৈমাত্রেয় সুলভ আচরণ করছিল, যে কারণে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত হতে সময় লাগেনি। পরবর্তীতে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃতি পেলেও সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করা, শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করা ইত্যাদি দাবিসহ আরও সব গণতান্ত্রিক দাবিতে গণআন্দোলন সোচ্চার হয়ে উঠেছিল, যার পরিণতিতে ‘৬৬ সালের ৬ দফার আন্দোলন, ‘৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০ সালের নির্বাচন অতঃপর ‘৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। কাজেই দেখা যাচ্ছে মাতৃভাষা বিকাশের জন্য শুধুমাত্র রাষ্ট্রভাষার স¦ীকৃতি লাভই একমাত্র শর্ত না। মাতৃভাষা বিকাশের শর্ত আরও অনেক গভীরে নিহিত, যার সাথে রাষ্ট্রের শাসকদের শ্রেণিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আর রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, কাজেই ভাষা সংক্রান্ত সকল বিতর্কেও অবসান হবে সেটাই প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু কার্যত যেটা দেখা গেল সেটা হলো বাংলা ভাষার ক্রমাবনতি। ইংরেজি ভাষার প্রতি আপামর মানুষের আনুগত্য এখন সুদূর গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে। কিন্ডারগার্টেনের লোভনীয় বিজ্ঞাপনের দেখা মিলছে সর্বত্রই। সেখানে কি পড়ানো হয়, কারা পড়ায়, কারা পড়ে, সেসব ব্যাপারে কোনো তদারকি বা সচ্ছতা না থাকলেও মাসান্তে বিপুল অংকের টাকা গুনতে হয় অভিভাবকদের। ভাষার অবলম্বন হচ্ছে শিক্ষা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সর্বজনগ্রাহ্য গণমুখি কোনো শিক্ষানীতি কর্যকর করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে বাংলা ভাষা ক্রমান্বয়ে নির্বাসিত হচ্ছে। এক ধরনের উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার প্রচলন হয়েছে সত্যি কিন্তু সেই শিক্ষা থেকে ডিগ্রি প্রাপ্তির সান্তনা ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না। শিক্ষার আন্তজার্তিক মানের ধারে কাছেও সেই শিক্ষা নেই। সামাজিক ভাবেও বাংলা ভাষা মর্যাদা হারাচ্ছে। মৌখিক ভাষায় এখন ইংরেজি শব্দের অযৌক্তিক ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। একটা সময় ছিল যখন
বাংলা ভাষায় বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পত্র ছাপানোর মধ্যে এক ধরনের গর্ব ছিল, এখন ইংরেজি ভাষায় আমন্ত্রণ পত্র ছাপানোর
প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইংরেজি ভাষা সামাজিক মর্যাদা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ইংরেজি বিদেশী আন্তর্জাতিক ভাষা। বাংলা ভাষা কোনোভাবেই ইংরেজি ভাষার প্রতিপক্ষ না। দেখা যাবে যেসব দেশ একসময় বৃটিশ উপনিবেশ ছিল সেসব দেশ ছাড়া প্রায় কোনো দেশেই ইংরেজি ভাষার দাপট বা আধিপত্য নেই। তাতে করে সেইসব দেশ যে উন্নয়নে বা জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় কোনো ভাবে বাঁধাগ্রস্ত হয়েছে এমন বলা যাবে না। চীন
জাপান কোরিয়া রাশিয়া জার্মান ইত্যাদি দেশ হচ্ছে তার উদাহরণ। প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের জন্য মাতৃভাষার বিকল্প নেই। এই কথা ধ্রুব সত্যের মতো সব দেশের সব মনিষিই স্বীকার করেন। আমরা যে বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে ইংরেজি ভাষার প্রতি আনুগত্য দেখাচ্ছি ভাষার ক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি ছাড়া এর কোনো সুফল নেই। এই নৈরাজ্য যে শুধু ভাষার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে এমন না, জাতীয় জীবনের নানা ক্ষেত্রেই এই নৈরাজ্য পাখা বিস্তার করে। মূল কথা, ভাষা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক না হলে গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত হয় না। ৫২র ভাষা আন্দোলন ভাষাকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হলেও আসলে সেটা ছিল এই জনপদের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের অংশ। ভাষা আন্দোলনকে তাই বিছিন্নভাবে দেখার উপায় নেই। আজকের দিনেও মাতৃভাষার প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা নির্ভর করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের
লড়াইয়ের ভেতর। প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারি মাস বা ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা প্রীতির আদিখ্যেতা প্রদর্শন আসলে মাতৃভাষা নিয়ে এক ধরনের মশকারা। এই মশকারার সাথে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার প্রকৃতপক্ষে কোনো সম্পর্ক নেই।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী: বাংলা ভাষার বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতি
গোলাম কিবরিয়া পিনু

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা পালনও করলাম, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীও অতিবাহিত হলো, ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরও পার করছি, তারপরও বাংলা ভাষার জন্য কোনো সুখবর কি আছে? নেই! সর্বদিক থেকে বাংলা ভাষার জন্য এক বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতি! সরকার বা সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কি আমাদের ভাষা নিয়ে কোনো জরিপ হয়েছে? হয়নি! আমাদের ভাষা বিষয়ক কোনো জরিপ থাকলে আমাদের বাংলা ভাষার বর্তমান পরিস্থিতি আমরা আরও পরিষ্কারভাবে জানতে পারতাম, বাংলা ভাষা প্রচলন ও অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের সুবিধে হতো। বাংলা ভাষা আজ বিভিন্ন পর্যায়ে অবহেলার শিকার হয়ে কাতরাচ্ছে! ব্যক্তি, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সরকার ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন পরিধিতে চোখ মেললেই তা সহজে অনুমেয় হয়।
ভাষাবিজ্ঞানে ভাষা জরিপের বিষয়টি আছে, এই জরিপ অন্যান্য জরিপের মতোই। আমরা তো জরিপ বলতে বুঝি– কোনো কিছু পরিমাপ বা ধারণা করার জন্য উপাত্ত সংগ্রহ করা। বিভিন্ন দেশে এই ভাষা জরিপ হয়ে থাকে। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের ভাষা জরিপ ২০০২ সালে সমাপ্ত হয়, প্রায় ১০ বছরের প্রচেষ্টার ফলে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও ভাষা জরিপের কর্মকান্ড লক্ষ করা যায়। অথচ প্রধানত বাংলা ভাষা অধ্যুষিত ও ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন করা একটি দেশে আজ পর্যন্ত কোনো ভাষা জরিপ হয়নি! একুশে ফ্রেবুয়ারি এলে আনুষ্ঠানিকভাবে মেতে উঠলেও ভাষা বিষয়ে ভাবনা, বিবেচনা ও উদ্যোগের কথা বছরের অন্যান্য সময়ে বেমালুম আমরা ভুলে যাই। ভাষা জরিপ থাকলে রাষ্ট্র, সরকার, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে ভাষার উন্নয়নে ভূমিকা রাখা আমাদের জন্য অনেক সহজ হতো।
শুধু ভাষা জরিপ কেন? ভাষা ব্যবহারের জন্য হঠাৎ হঠাৎ করা কিছু পদক্ষেপ ও ঘোষণা এসেছে কিন্তু একটি জাতীয় ভাষানীতি আমরা ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পার হওয়ার পরও প্রণয়ন করতে পারিনি! এর ফলে বাংলা ভাষা নিয়ে বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন অরাজক পরিস্থিতিরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাদের দেশে শিক্ষানীতি, কৃষিনীতি, খাদ্যনীতি, ক্রীড়ানীতি, বাল্যবিবাহনীতি এবং আরও কত নীতি আছে! কিন্তু ভাষানীতি নেই! একটি ভাষানীতি থাকলে– শিক্ষার মাধ্যম কী হবে, প্রশাসনের ভাষা কী হবে, বানানরীতি কী হবে, আদিবাসীদের ভাষা কী পর্যায়ে থাকবে, ইংরেজিসহ বিদেশি ভাষার অবস্থান কী হবে, কম্পিউটারে ভাষার পরিস্থিতি কী হবে, পরিভাষা কী হবে, রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকা কী হবে– এগুলো নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা ও দিক-নির্দেশনা থাকত। কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই সংশ্লিষ্ট কারোরই! ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, রাশিয়া, চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর ভাষানীতি আমারা বিবেচনায় নিতে পারি। তারা তো জাতীয় ভাষা ত্যাগ করে ইংরেজি গ্রহণ করছে না। আমরা উল্লিখিত দেশের কথা বাদই দিলাম, পাশের দেশ নেপালের কথাই বলি, সে দেশেও একটি ভাষানীতি আছে, তারা উচ্চ আদালতে মাতৃভাষা ব্যবহারে সক্ষম হয়েছে অথচ আমরা এখনো আমাদের উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহার করছি না!
ভাষা জরিপ ও জাতীয় ভাষানীতির কথা আমরা বাদই দিলাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পার হওয়ার পরও আমরা নিদেনপক্ষে একটি ভাষা কমিশনও গঠন করতে পারিনি! ভাষা কমিশন থাকলেও বর্তমান অবস্থায় বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশে কিছু পর্যালোচনামূলক সুপারিশ পাওয়া যেত, প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু দিক-নির্দেশনাও পাওয়া যেত। সরকারের দু’টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, একটি হলো বাংলা একাডেমি আর একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, এই দু’টি প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষা প্রচলনে কতটুকু জোরালো ভূমিকা পালন করছে, তা মূল্যায়ন করা আজ জরুরি। এদের ওপর যে অর্পিত দায়িত্ব রয়েছে, সে বিষয়ে তারা কতটুকু ভূমিকা পালন করছে? বাংলা একাডেমির কথাই ভাবি– তারা কি ভাষানীতি প্রণয়নে কোনো বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছে? কিংবা বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচলনে কোনো বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে? বা সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেছে? না, এ রকম কোনো দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না! এমনকি এই পর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের ১২ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও, এই ১২ বছরে বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষা বিষয়ে কোনো উল্লেখযোগ্য সেমিনার বা কর্মশালা করার পর কোনা সুপারিশ সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছে? আর আছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশের সংস্কৃতির মূলভিত্তি যে ভাষা, সেই মন্ত্রণালয় কি বাংলা ভাষা প্রচলন ও বিকাশে গতানুগতিক কার্যক্রমের বাইরে জাতীয় দিকনির্দেশনামূলক ও বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে?
বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার দিক-নির্দেশনা থাকলেও প্রায় পাঁচ দশক পার হওয়ার পরও বাংলা দাপ্তরিকসহ রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে আবশ্যিক ভাষা হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে না! এই সময়ে এসেও দেখা যায় সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, নামফলক, দেওয়াল লিখন হচ্ছে ইংরেজিতে; সরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন বিলের ভাষা বাংলা নয়, ইংরেজিতে। গণমাধ্যমের বিভিন্ন পর্যায়েও বাংলা ভাষার করুণ পরিস্থিতি। ঘরে ও বাইরে অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে– বাংলা ভাষার আলোটুকু গ্রাস করার জন্য। যা ইচ্ছে তাই ভেবে যুক্তিহীনভাবে এক ধরনের হীনমন্যতার বশে যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানেও ইংরেজি ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। টিভি ও পত্রপত্রিকায় ইংরেজি বিজ্ঞাপনের জয়জয়কার! ঢাকা নগরের অনেক দোকানপাট, প্রতিষ্ঠানের নাম শুধুই ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে!
ভাষার প্রধান বাহন হিসেবে বাংলা ভাষাকে আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি, শুধু পারিনি তা তো নয়, বিশেষত শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাভাষাকে আমরা পরিত্যাগ করছি। আজ বাংলাদেশে ৪২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সমাজবিদ্যায় যতটুকু বাংলা ব্যবহার হয়ে থাকে, বিজ্ঞানে ততটুকু তো নয় বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রবেশাধিকার একদম নেই। বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিগুণের বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, যেগুলোর দু’একটি বাদে বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা অচ্ছুৎ শ্রেণির ভাষা হিসেবে দূরবর্তী অবস্থানে রয়েছে।
শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে একমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা দেওয়া উচিত। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকা উচিত নয়। প্রায় সব এগিয়ে থাকা দেশে প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় বা একমাত্র ভাষার মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে। উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত দেশসমূহে– বিশেষত ইংল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জাপান, ফ্রান্স, জার্মানিতে প্রাথমিক স্তরে প্রথম ভাষা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ভাষায় শিক্ষা দেওয়া হয় না। অথচ আমাদের দেশে ভাষা বিষয়ে বিভিন্নমুখী বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বাংলাভাষাকে সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত না করার মানসিকতা অনেক ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করছি। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রেও বাংলাভাষাকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া লক্ষ করা যাচ্ছে। এ এক বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা।
প্রাথমিক শিক্ষায় মাতৃভাষাকে গুরুত্বহীন করে কোথাও কোথাও ইংরেজি ও আরবি ভাষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশি। নানা রকমের প্রাথমিক-শিক্ষা বাণিজ্যের আওতায় টেনে নিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। ‘ইংরেজি মাধ্যম’, ‘কিন্ডারগার্টেন’, ‘প্রি-ক্যাডেট মাদ্রাসা’ নামের তথাকথিত প্রাথমিক শিক্ষালয় নগরে-শহরে-বন্দরে ব্যবসায়ী মনোবৃত্তিতে গড়ে উঠেছে। যার বেশির ভাগই প্রাথমিক শিক্ষার মূল দর্শন থেকে বহু দূরবর্তী অবস্থানে রয়েছে। এসব শিক্ষালয়ের পাঠ্যসূচির কেনো সামঞ্জস্য নেই, নেই শিশু মনস্তত্ত্বের প্রতি লক্ষ রেখে শিক্ষায় গুরুত্ব প্রদান। এসব তথাকথিত শিক্ষালয়ে বাংলাভাষাকে অনেকাংশে অবজ্ঞা আর অবহেলায় টেনে নিয়ে এক কোণায় ফেলে রাখা হচ্ছে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে বাংলা ও ইংরেজির মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এক উদ্ভট পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর জন্য দায়ী আমাদের অবৈজ্ঞানিক এবং অযুক্তিপূর্ণ মন-মানসিকতা।
বাংলাদেশের সংবিধানের মোট চারটি স্থানে ভাষা প্রসঙ্গটি উল্লেখিত হলেও ৩ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।” আর ২৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘‘রাষ্ট্র জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষণের জন্য ব্যবস্থা প্রহণ করিবেন এবং জাতীয় ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পকলাসমূহের এমন পরিপোষণ ও উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন এবং যাহাতে সর্বস্তরের জনগণ জাতীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধিতে অবদান রাখিবার ও অংশগ্রহণ করিবার সুযোগ লাভ করিতে পারেন।”
ভাষা আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল– প্রশাসনিক কাজকর্মে বাংলা ভাষা মর্যাদার সাথে ব্যবহার করতে হবে। এই দাবি দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় কখনো কখনো জোরালো হয়েছিল, তা যেন আজ অমাবস্যার অন্ধকারে অন্তর্ঘাতমূলক অবস্থায় পতিত হচ্ছে, যার ফলে সরকারি পর্যায়ে বাংলাভাষা ব্যবহারের শিথিলতা এখন আগের চেয়ে আরও বেড়েছে! বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার বলে বলে গর্ব করা– সরকারের আমলেও দেখছি, তারা সরকারি পর্যায়ে বাংলা ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্যান্য শাসনামলের চেয়ে উলে¬খযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারছে না! বরং এ সরকারের আমলে বাংলা ভাষা প্রচলনের পূর্ববর্তী নিয়ম-নির্দেশ অবজ্ঞা করা শুধু হচ্ছে না, বাংলা ভাষা প্রচলনের সম্ভাবনা ও শক্তিকে সংকুচিত করা হচ্ছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। তাহলে আমরা কি ভাববো না– এই সরকার বাংলা ভাষার কাঙ্ক্ষিত মিত্র হয়ে উঠতে পারেনি! আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে গিয়ে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ করার জন্য বলেছেন অথচ তার সরকারের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলা এখন কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে, তা বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। শুধু দাপ্তরিক কাজে নয়, আইন-আদালতসহ প্রায় সর্বস্তরে আজ বাংলা ভাষার ব্যবহার কমছে, ইংরেজির ব্যবহার বাড়ছে।
১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির এক সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দৃপ্ত উচ্চারণে ঘোষণা দিয়েছিলেন– ‘‘ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি অফিস-আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করব না। কারণ তাহলে কোনোদিনই বাংলা চালু করা সম্ভবপর হবে না। এই অবস্থায় হয়তো কিছু কিছু ভুল হবে, তাতে কিছু যায় আসে না। এভাবেই অগ্রসর হতে হবে।’’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলী খানের ভাষ্যানুযায়ী বঙ্গবন্ধু যেদিন দপ্তরে বসেছিলেন, সেদিনই ইংরেজিতে লেখা একটি নথি নিয়ে তাকে যেতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে। ইংরেজিতে লেখা নথি দেখে বঙ্গবন্ধু উষ্মা প্রকাশ করে প্রশ্ন করেছিলেন যে– এই স্বাধীন দেশেও কি তাকে ইংরেজিতে লিখিত নথি দেখতে হবে। অতঃপর তিনি তাকে এই মর্মে একটি প্রজ্ঞাপন জারির নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, এখন থেকে সকল নথি বাংলায় লিখিত হতে হবে। আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করলাম, অথচ বঙ্গবন্ধুর ভাষা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা গুরুত্ব দিতে পারিনি এখনো।
আমরা বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী পার করছি, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীও অতিবাহিত করলাম, আমরা ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরও পার করছি, তার পরও বাংলা ভাষার জন্য আমাদের জোরালো ও পরিপূরক ভূমিকার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখাতে পারিনি! এর ফলে বাংলা ভাষা নিয়ে বেদনা-বিহ্বল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, বাংলা ভাষার বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন অরাজক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই অবস্থায় আমরা ভাষা আন্দোলন ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের গৌরবে নিজেদের অহং প্রকাশে আনুষ্ঠানিকভাবে তৎপর হলেও– বাংলা ভাষার বিকাশে তৎপর কতটুকু, তা বিবেচনায় টেনে আনা উচিত। শহীদ দিবসটি গতানুগতিক ও আনুষ্ঠানিকতায় শুধু পালন করব? আমাদের কি বাংলা ভাষার প্রতি আর কোনো দায় নেই? বিবেকতাড়িত সেইসব প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।


অ-তে অধিকার, আ-তে আদায়
মোহাম্মদ জুবায়ের

লোকজন দৌড়াচ্ছে হন্তদন্ত হয়ে। নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নির্বিশেষে সবাই দৌড়াচ্ছে। জীবনের অনেক স্বপ্ন-চাওয়া পূরণ করতে না পারা এই মানুষগুলোর লক্ষ্য একটাই-ধরতে হবে টিসিবির ট্রাক। এই দৃশ্য দেখে আবার কিছু লোক হাসছেনও। হাসতে-হাসতে চোয়াল কষে আসছে, তবু তারা হাসছেন! পৃথিবীর কোনো রেসের ট্র্যাকে নারী-পুরুষ, বুড়ো-গুড়োদের এমন সম্মিলিত দৌড় দেখা যায় না যে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ওই লোকগুলো কেন হাসছে? নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিতদের আর্তনাদ-ছোটাছুটি দর্শনে হাসির খোরাক কোথায়? এর উত্তরও আছে বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘একটি তুলসী গাছের আত্মকাহিনী’ গল্পে ‘অন্যের অপমান দেখার নেশা বড় নেশা’। এই নেশার ঘোরে বুঁদ হয়ে আছে বঙ্গরাষ্ট্র। তাই এই ‘বঞ্চিত-অপমানিত’দের ছুটোছুটি-হুড়োহুড়ি দেখে অনেকে মজা পায়; তাই হাসে।
বেশ ভাইরাল হয়েছে ভিডিওটি। টিসিবির ট্রাকটি ছুটছে, তার পেছনে প্রাণপণ ছুটছে মানুষ। কপালের ঘাম মুছতে-মুছতে, কেউ পথে লুটিয়ে পড়া আচঁল টানতে-টানতে, কেউ ঢিলে হয়ে যাওয়া লুঙ্গির গিট আঁটতে-আঁটতে। প্যান্ট-শার্ট-জুতো পরে কেতাদুরস্ত সেজে দৌড়ানো যায় না, কিন্তু ক্ষুধার দৌড়ানিতে তারাও দৌড়াচ্ছে। ট্রাকের গিয়ারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মানুষের দৌড়ের গিয়ারও বাড়ে। ফার্স্ট হওয়া চাই, নইলে হাতছাড়া হয়ে যাবে পুরস্কার।
কী ‘পুরস্কার’ থাকে এই টিসিবির ট্রাকে? যার জন্য ট্রাকের পেছনে লেখা ‘নিরাপদ দুরত্বে থাকুন’, ‘৫০-১০০ গজ দূরে থাকুন’- জীবন রক্ষাকারী এমন বার্তার তোয়াক্কাও করছে না মানুষ। দৌড়াচ্ছে, পেছনের ডালা ধরে ঝুলছে। ক্ষুধার্ত পেট নিয়ে এসে লাইনে টানা দাঁড়িয়ে থাকার ক্লান্তিতে নেতিয়ে পড়া হাতটি গলে একসময় বেরিয়ে যায় ট্রাকটি।
এই ট্রাকে থাকে চাল। সবাই জানে এক টাকায় আট মণ চালের সেই শায়েস্তা খাঁর আমল নেই। চালের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। কৃষক ধানের দাম ঠিকঠাক পাক বা না পাক, চালের বেপারির পোয়া বারো। বেপারিদের এই ‘বারো’ সংখ্যা শেষ পর্যন্ত কোথায় ঠেকবে কে জানে? এক কেজি নাজির শাহ চাল ৭৭ টাকা। মোটা চাল ৪৪ টাকা কেজি। প্রায়ই দুর্গন্ধময় ডাস্টবিন ঘেঁষে দাঁড়ানো টিসিবির ট্রাকের পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে থাকাদের কাছে সুগন্ধী চালের দাম বলা বোধহয় তাদেরকে আরও একবার অপমানিত করা। তাই ও প্রসঙ্গ বাদ।
চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, ডাল- এসবের সঙ্গে থাকে আরেক মহার্ঘ্য, যার নাম তেল। পণ্যের দাম বাড়াতে অসাধু ব্যবসায়ী, মধ্যসত্ত্বভোগীদের যে তেল খরচ হয়, যোগ্যদের টপকে অযোগ্যদের উপরে উঠতে যে ‘তেল মারতে’ হয়, এ তেল সেই তেল নয়, এ ভোজ্যতেল। যার দাম ইদানিং বাড়ছে উসাইন বোল্টের দৌড়ের গতিতে। ভুখা-নাঙ্গা মানুষ সে দৌড়ের সঙ্গে পেরে উঠবে কিভাবে? বোতলজাত এক লিটার তেলের দাম সবশেষ আরও ৮ টাকা বৃদ্ধির পর দাঁড়িয়েছে ১৬৮ টাকা।
সব মিলিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লাগামহীন। নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের দৌড়াদৌড়িও লাগামহীন। এগুলো নিয়ে কথা হয়। লেখালেখি হয়। একটু-আধটু প্রতিবাদও হয়। কিন্তু কাজের কাজ হয় না মোটেও। ‘যস্মিন দেশে যদাচার’- এইভাবে থেকে যায় সবকিছু। তাই বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি অনায়াসে বলে দিতে পারেন, “ভালো ভালো পোশাক পরা মানুষদেরও এখন টিসিবির লাইনে দেখা যাচ্ছে।” কিন্তু ‘ভালো মন’ নিয়ে কি কেউ ওই লাইনে দাঁড়াচ্ছে?
মনে পড়ছে, চেকে ‘ডিসেম্বর’ বানান বাংলায় লিখেছিলেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। এই ‘অপরাধে’ তা ফেরত পাঠিয়েছিল একটি ব্যাংক। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি লিখেছিলেন, “মন চাইছে আত্মহত্যা করি। একটি চেকে আমি ডিসেম্বর বাংলায় লিখেছি বলে কাউন্টার থেকে চেকটি ফেরত দিয়েছে। কোন দেশে আছি?’। ভাষার প্রতি অবজ্ঞা মন্ত্রী মেনে নিতে পারেননি; আমরাও পারি না। অথচ ট্রাকের পেছনে ছোটা ‘মানুষগুলোকে’ দেখে মনে হয় জীবনের প্রতি অবজ্ঞা তারা সয়ে যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে ছুটছে। আমরাও সয়ে যাচ্ছি এবং শুধু দেখছি; কেউ কেউ হাসছি। অথচ ট্রাকের পিছে হন্তদন্ত হয়ে ছোটা এই মানুষগুলোর পূর্বসূরিরাই ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১-এ ছুটেছে রাজপথে, রণাঙ্গণে। আদায় করে নিয়েছে অধিকার। অধিকারবঞ্চিদের প্রতি তাই আমাদের ভাবুক বন্ধু ভ্যাবলা বিশেষ দরদ অনুভব করে না। বরং চাল-ডালের জন্য দৌড়াদৌড়ির ভিডিও দেখে সে আজ বিশ্রীভাবে হাসছে! হাসির কারণ জানতে চাইলে শিক্ষার শুরুর ‘গলদ’ টেনে বলল, “অ-তে অজগর, আ-তে আমটি আমি খাব পেড়ে-এগুলো না, আসলে হবে অ-তে অধিকার, আ-তে আদায়। বুঝলে?”

‘বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ’
আনিসুর রহমান

ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষার মাস। সারামাস ধরে আমরা নানা গদগদ বুলি আওড়াব, গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সরকারি বেসরকারি নানা অনুষ্ঠানে। আদতে যে আমাদের মাতৃভাষা আজ নিজেদের বেহায়াপনার খপ্পরে আছে তা খোলাসা করে বলার জন্যে কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই !
বাঙালি ও বংলা ভাষার ভাষার নির্লজ্জ দুশমনদের বাড়াবাড়িতে মাথা যখন হেট হতে বসেছে তখন ‘বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ’ কথাটা আমাদের মননে আর মগজে দারুণ নাড়া দিয়েছে। বাঙালি কবি গুরুসদয় দত্তের (১৮৮২- ১৯৪১)কথাকে ধারণ করে বাংলা একাডেমিতে গতবছর জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিক সন্মেলন। এই আয়োজনের নেপথ্যে দুই একজনের ঠিকাদারি স্বার্থের সংযোগ থাকলেও এর একটা দীর্ঘমেয়াদী আবেদন থাকতে পারে। এর ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম নয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৭৪ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ২০১৮ সালের সম্মেলনে ভারতসহ সারা বিশ্বের তিন শ’রও বেশি বাঙালি সাহিত্যিক অংশ নিয়েছিলেন।
বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ ও ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ গতবছরের আয়োজনে প্রধান সহযোগী সংগঠন হিসেবে ভূমিকা রেখেছিল। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বেনারসে আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে প্রথম ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ৯৪ বছরে ৮৯ বার এ সম্মেলন ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় এ সম্মেলন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলন উদ্বোধন করেন । সন্মেলন সম্পর্কে এই ছিল মোটাদাগের খবর। এবার গুরুসদয় দত্তের কথায় ফিরে আসি। গুরুসদয় দত্ত রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১- ১৯৪১) থেকে দুই দশকের ছোট হলেও তাদের পরলোকে যাত্রা একই বছরে, ১৯৪১ সালে। সে হিসেবে লেখালেখিতে তারা ছিলেন সমসাময়িক। সময়টা ছিল বাংলা ভাষা, ভূমি, সাহিত্য ও বাঙালির পরাধীনকাল।
তার প্রায় শতবর্ষ পরে, ১৯৫২ সালে আমাদের মাতৃভাষা আন্দোলন, তারও পরে ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় অর্ধশতকে এসে অনেকটা গালির মতো শোনায়, নিজের কানেও বড় বাজে গো, ’বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ’। আমাদের পরিণতি আর অধঃপতন এতটাই, আমরা দেউলিয়া বাতাসে বয়ে যাই যে! তবু রক্ষে সময় থাকতে হুঁশ হলো। আয়োজকদের সাধুবাদ। উপজীব্য কথাটা ছিল মোক্ষম।
ঔপনেবেশিক জামানার পতনের দীর্ঘ সময় পরেও সেই পুরনো ভূত কেন কর্পোরেট ঢঙে আমাদের আত্মপরিচয়ে আত্মঘাতী থাবা মেলে? আমাদের সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্য থাকার পরও আমাদের হয় উর্দু নয় আরবি- নয় তো ইংরেজির দিকে ঝুঁকতে হবে কেন?
বাসাবাড়ির ভেতরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কিংবা কাজের লোকদের সঙ্গে আমরা কোন খিচুড়ি ভাষায় কথা বলি? ভাষা ও সাহিত্য কোন আজগুবি বা গায়েবানা বিষয় নয়। যারা ঢাকায় থেকে, বাংলার আলো বাতাসে প্রাণধারণ করে ইংরেজি বা আরবিতে পন্ডিতি ফলান, তারা কি বাজারে গিয়ে অইসব ভিনদেশি বোলে বাজারসদাই করেন? তারা কি লালনগীতি, রবীন্দ্র সঙ্গীতসহ পঞ্চকবির গান ইংরেজি বা আরবিতে শোনেন?
এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলি। একবার প্রায় বছর বিশেক পূর্বে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঢাকায় বেসরকারি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। সুনীলের পূর্ববর্তী সকল বক্তা ইংরেজিতে সাহেবি ঢঙে কথা বলে গেলেন। এবার তার পালা। উনি শুরুতেই বললেন, আমি এমন কোনও বিপদে পড়িনি, বাংলাদেশে এসে আমাকে ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে হবে । তারপরেও আমাদের খাসলত যদি ঠিক হয়! আমরা আন্তর্জাতিকতার দোহাই দিয়ে ‘হে উৎসব’ এর নামে বিদেশিয়ানার কর্পোরেট আয়োজন করেই চলছি, তাও আবার জনগণের করের টাকায়।
কায়মনে বাঙালি হবার মানে এই নয় যে বাইরের দুনিয়ার জন্যে আমরা দরজা বন্ধ করে দেব। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে আমাদের মননের যোগাযোগ হবে অনুবাদে। এক্ষেত্রে আমাদের অনুবাদের বাজার দেখতে হবে। অনুবাদ মানে আমরা কেবল ইংরেজির দিকে ঝুঁকবো না। ইংরেজি ভাষাভাষী জগতের চেয়ে প্রাচ্য দুনিয়ায় বিশেষ করে চীনা, জাপানি, কোরিয়ান, হিন্দি, উর্দু, ফার্সি আর আরবি ভাষায় আমাদের সাহিত্যের কদরটা খতিয়ে দেখা দরকার।
একই সঙ্গে আমাদের নিজেদের সংখ্যালঘিষ্ঠ স্বদেশি মানুষের তিরিশের বেশি ভাষা সাহিত্যের দিকে আমাদের দৃষ্টি মেলতে হবে। কায়মনে বাঙালি হতে গেলে তাদের সঙ্গেও আমাদের ভাব ও ভাষার লেনদেন করতেই হবে। তাদের ভাষা বিল্প্তু হবে আর আমরা লম্বা লম্বা কথা বলবো, তা তো হবে না। ইংরেজি নির্ভর ঔপনেবেশিক সাহেবিয়ানা আর তেঁতুল হুজুর মার্কা বাড়াবাড়ি দুটোকেই টুঁটি চেপে ধরতে হবে।
আমাদের শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত, পেশাজীবী, কতিপয় গণমাধ্যমের লোকজন বাংলা বাক্যের শেষে ইংরেজি শব্দ জুড়ে দিয় এক অশ্লীল শ্রুতিকটূ খিচুড়ি ভাষার প্রবর্তন হচ্ছে! এ প্রবণতা এখনই রোধ করা দরকার। একটা বেসরকারি দূরদর্শনের সেরা কণ্ঠ বাছাই অনষ্ঠানে উপস্থাপক থেকে শুরু করে অতিথি বিচারকদের অধিকাংশই এরকম খিচুড়ি ভাষা ব্যবহার করেন। টকশোওয়ালাদের কথা তো বলাই বাহুল্য।
তাই ভাবি তিনশ বছর পরেও আবদুল হাকিমের বহুল পঠিত বঙ্গবাণী কাব্য; বিশেষত দুটি লাইনই কেন হরেদরে প্রাসঙ্গিক:
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
সেই সময় সংস্কৃত নির্ভরতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে আবদুল হাকিম তার ক্ষোভ ঝেরেছিলেন। আজ আমাদের তাকে আশ্রয় করতে হচ্ছে ইংরেজি নির্ভরতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে।
লেখাটি শেষ করার আগে একটা উদাহরণ দিতে চাই। আমাদের খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট প্রায় পুরোটা ইংরেজি নির্ভর। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৮-৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সূতিকাগার ।
আবদুল হাকিম ব্যবহৃত উপমার আক্ষরিক অর্থ না খুঁজেও বলা যায়, তিনি বড় প্রাসঙ্গিক আজ। আর এজন্যই আমাদের ঢাকঢোল পিটিয়ে বলতে হলো, ‘বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ’! আমাদের চেতন হোক।