কবে হবে আমাদের নিরাপদ জীবন

0

॥ড. মাহবুব হাসান॥
নিরাপদ সড়ক আর নিরাপদ জীবন কিংবা নিরাপত্তাময় নাগরিক জীবনের দাবি আমাদের। কেন এই দাবি করছে আমাদের শিশু-কিশোররা? সড়কে তাদের জীবন নিরাপদ নয়। তাই তারা এই দাবি করছে। যুবকদের বা পূর্ণ বয়স্ক বা পৌঢ় মানুষ যারা সড়কে যাতায়াত করেন, তাদের জীবনও নিরাপদ নয়। যারা বৃদ্ধ, যাদের জীবন নির্ভরশীল সন্তানদের ওপর, তাদের জীবনও নিরাপদ বা নিরাপত্তাময় নয়। আমাদের সমাজ স্ট্রাকচার অনুযায়ী বাবা-মা নির্ভরশীল তাদের সন্তানদের ওপর। কিন্তু আজকাল অনেক বাবা-মা-ই সন্তানদের কাছে বোঝা হয়ে উঠেছে। তারা আর মা-বাবাকে নিজেদের আশ্রয়ে রাখতে চায় না। অনেক বৃদ্ধই এখন বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা। যাদের সেই সামর্থ্য নেই, তারা পরিত্যক্ত হয়ে অন্যের আশ্রয়ে থাকছে। কিছু মানুষ আশ্রয় নিয়েছে খোলা আকাশের নিচে, ফুটপাতে, কারও বাড়ির বারান্দায় রাতটুকু কাটিয়েই নেমে যান পথে। যতদিন পর্যন্ত দলীয় লোকদেরই জনগণ বলে মনে করবেন তারা, ততদিন পর্যন্ত তারা সড়ক অনিরাপদ ও হন্তারক বাসেচালক/মালিকদের বাঁচাবার আয়োজনই করবেন। এই অন্ধ গলি থেকে বেরিয়ে আসার আবেদন ওই সব শিশুর। নিরাপদ সড়কের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিশুরা লিখছে- নিরাপদ সড়ক চাই।
সরকার এদের খবর জানে, কিন্তু তাদের নিয়ে কিছু করার আগ্রহও দেখায় কিন্তু কিছু করে না। আমি জানি, আমার এ কথায় সরকারের নীতিনির্ধারকদের মনে গোস্যা জমবে, কিন্তু তার সত্যতা মানবে না। বলবেন সরকার অনেক কিছু করছে। অনেক প্রকল্প নিয়েছে। এরকম সাফাই অহরহ করছে সরকারি লোকেরা।
প্রথম, প্রকাশ্য আলোচনার বিষয় হচ্ছে নিরাপদ সড়ক। শিশু-কিশোররা নিরাপদ সড়কের দাবি তুলেছে তাদের সহপাঠীকে বাসের নিচে ফেলে হত্যার পর। রোড অ্যাক্সিডেন্ট যে কতোটা ক্ষতিকর, তার আঘাত যে একটি পরিবারকে বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেয়, তা কিন্তু বুঝতে পারে না বাসচালক, মালিক, সড়ক কর্তৃপক্ষ এবং সরকারও। আমি জানি, এরা কেউই এটা মানবেন না। সরকার দোষ দেবেন বাস/ট্রাকচালকদের ওপর। মালিকদের ওপরও দোষ চাপানো যায়। ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই বা অদক্ষ চালকের হাতে বাস/ট্রাক ছেড়ে দেওয়ার ফলেই যে সড়কগুলো নিরাপত্তাহীন এক খুনের সড়ক হয়ে উঠেছে, সেটা না বললেও সবাই তা জানে। কিন্তু কোনো কর্তৃপক্ষই জানে না কীভাবে সড়ক নিরাপদ করা যাবে। যখন শিশু-কিশোররা রামপুরা ব্রিজের ওপর নিরাপদ সড়ক চাই লিখছিল, তখন একটি প্রশ্ন মাথায় এলো- ওই শিশুকিশোররা কার কাছে নিরাপদ সড়ক চাইছে? প্রথমেই মনে পড়ে সরকারের চেহারা। তারপর বাস/ট্রাকের মালিকদের অ্যাবস্ট্রাক্ট মুখ। তারা কারা চেনা যায় না।
শাজাহান খান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু তার প্রথম পরিচয় তিনি রাজনীতিক। তারপরের পরিচয় তিনি পরিবহন খাতের শ্রমিক নেতা, তারপর তিনি সরকারের একজন সাবেক মন্ত্রী। এক ব্যক্তি যখন বহু পরিচয়ের ভেতরে বাস করেন, তখন তাকে কেউ চিনতে পারে না। ফলে সেই চেহারা অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়ে পড়ে। উদাহরণের জন্য শাজাহান খানের নাম ব্যবহার করা হলো। এখন আমরা বুঝতে চাইছি শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা কার কাছে সড়কে তাদের যাতায়াত নিরাপদ করার দাবি করছে। সরকার ও বাস/ট্রাকের মালিকরা বলবেন তারা ওই সব যানবাহন চালান না। যানবাহনের চালক হচ্ছে সেই সব সাধারণ মানুষ যারা খুব কষ্টে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নিয়েছে। সে গাড়ি চালাতে পারুক বা না পারুক, সে যদি চাহিদা মোতাবেক ঘুস দেয় তাহলে লাইসেন্স সে পাবেই। ওই লাইসেন্স নিয়ে সে জোগাড় করে নেয় বাস/ মিনিবাস/ট্রাক/মিনি ট্রাক চালানোর চাকরি। কারণ চাকরি না পেলে সে তার পরিবার-পরিজন নিয়ে বাঁচতে পারবে না।
মানুষের প্রধান আকাঙক্ষার নাম বেঁচে থাকা। সেই সংগ্রামেই সে নিজেকে তৈরি করতে থাকে সেই সুদূর শৈশবকাল থেকেই। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তাকে সেই সব সুযোগ সহজলভ্য করে দেয়নি। যদি কিশোরকালেই চালক হওয়ার চেষ্টায় সে বা তারা স্কুলিং শিক্ষা ও প্রাকটিক্যাল শিক্ষা পেতো, পেতো তার ড্রাইভিং করার লাইসেন্স বিনা ঘুসে, যদি কিশোরদের ম্যানপাওয়ার ওই বয়সেই ভাগ হয়ে যেতো বিভিন্ন পেশায়, তার প্রশিক্ষণে, তাহলে কিন্তু সড়কে এতো জীবন ধ্বংস হতো না সড়ক দুর্ঘটনায়। কারণ সেই সব চালক শিক্ষিত ও তার দক্ষতা ড্রাইভিংয়ে। সে জানতো একটি দুর্ঘটনা মানে তার জীবনের সব আশা-ভরসা শেষ। সে তাই ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি চালাতো। কিন্তু আজ যারা ট্রাফিক আইন মানছে না, তারা দেখছে, প্রাইভেটকারের চালকরাও আইন মানে না, হরহামেশাই তারা লঙ্ঘন করে চলছে সড়কের আইন, তখন সেই পথেই পা দেয়। লাইসেন্স দেনেওয়ালা ঘুস নিয়ে লাইসেন্স দিয়ে একবারও ভাবেননি, তার ছেলে/মেয়ে কিংবা তিনিও তার স্ত্রীও ওই অবৈধ ও অদক্ষ চালকের হাতেই মারা যেতে পারেন। এটা তিনি ভাবেন না। কারণ সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকার এ ভাবনার কোনো সুযোগ রাখেনি। যে শিশু বা সাধারণ কর্মজীবী দুর্ঘটনায় মারা পড়ছে, তার দায় গিয়ে পড়ছে চালকের ওপর। কিন্তু ওই চালকের লাইসেন্স ও অদক্ষতা যে পুলিশের ট্রাফিকের ঘুসখোর লাইসেন্সদাতার, তিনি বা তারাই যে প্রকৃত খুনি, সেটা ভাবতে হবে আমাদের। ঠিক এই পথে এগুলোই সড়কে দণ্ডায়মান ট্রাফিক পুলিশকেও আমরা দোষী সাব্যস্ত করতে পারি। তারা ট্রাফিকের নিয়ন্ত্রক। কিন্তু জনবলের অভাবে এবং চালকদের আইন অমান্য করার প্রবণতার কারণে সড়ক বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। মূলত ড্রাইভিং শিক্ষাটা গোড়া থেকে দিতে হবে। যেমন- এসএসসি পাস না করা হলে তাকে লাইসেন্সের জন্য দরখাস্ত না করতে দেওয়া, লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে পরীক্ষা দিতে হবে এবং ৮০ শতাংশ নম্বর পেতে হবে।
এ-রকম আরও কিছু নিরীক্ষার পর যখন সেই অ্যাপ্লিক্যান্ট লাইসেন্স পান, তাহলে তাকে গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে গণ্য করা হবে। আবারো তাকে পরীক্ষায়, ফাইনাল পরীক্ষায় বসে পাস করতে হবে। এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গেলে চালকের দোষে সহজে দুর্ঘটনার আশঙ্কা অনেকটাই কমবে। যান্ত্রিক কারণেও অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সিস্টেম পাল্টে দিলে এক্ষেত্রে সুফল মিলবে বলে আমাদের ধারণা। সাধরণত আমরা সব দাবি করি সরকারের কাছে। সেটাই স্বাভাবিক। সরকার যখন রাষ্ট্র পরিচালনায় আসে তখন দায় তারই। সরকার কেন নিরাপদ সড়কের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয় না? সরকার সব সময়ই চায় একটি নিরাপত্তাময় সামাজিক জীবন। কিন্তু তাকে সেটা করতে দেয় না সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা। এই প্রশাসন ব্যবস্থাটি এতোটাই পুরোনো যে তাকে পরিত্যক্ত ও অচল মুদ্রার সঙ্গে তুলনা করতে পারি আমরা। যে মুদ্রা দিয়ে কিছু কেনা যায় না, যে মুদ্রা এক্সপায়ার হয়ে গেছে, তা দিয়ে কোনো কিছু কেনা যায় না। পাকিস্তানি আমলের কোনো মুদ্রা দিয়ে কি স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো পণ্য কেনা যাবে? না, যাবে না। ঠিক সেই রকম এই পরিত্যক্ত [ ব্রিটিশ ও পাকিস্তান কর্তৃক ব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত] প্রশাসনের মনে এই বোধ উদিত হবে না যে তারা যা দিয়ে সেবা দিতে চাইছেন, তা সেবা দেওয়ার বদলে অ-সেবাই [পড়ুন দুর্ভোগ] দিচ্ছে। এটা আসলে বোঝার ব্যাপার। এটা বোঝার কথা সরকারের। কারণ তারা জনগণের নির্বাচিত কিংবা জোর করে ক্ষমতায় থাকা সরকার, যেভাবেই হোক না কেন, তারা মনে করে, তারাই সেবক জনগণের। জোড়াতালি দেওয়া প্রশাসন ও আইনের সংস্কার করে যে একটি স্বাধীন দেশের মানুষের চাহিদা পূরণ করা যায় না, বরং তাকে আরও ঘোলা ও নারকীয় করে তোলা যায়, সেই গত ৫০ বছরে আমরা বুঝেছি। এখন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারকে সেটা বুঝতে হবে। কারণ তারাই ক্ষমতার দণ্ডটি চালাচ্ছেন। আমরা চাই সড়ক নিরাপদ করে তোলার কাজটি সরকার নতুন করে তোলার ভেতর দিয়ে তাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছার সূচনা করুক। সড়ক নিরাপদ করে তোলা গেলে সরকারের স্বচ্ছতাও বাড়বে। বাড়বে জনগণের প্রতি তাদের রাজনৈতিক ওয়াদা ও দায়বদ্ধতা। এখন তাদের পকেটে থাকে দেশের জনগণ। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দলবৃত্তিক অন্ধত্ব পরিহার করতে হবে, এছাড়া দেশের জনগণের কথা তারা হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারবেন না। যতদিন পর্যন্ত দলীয় লোকদেরই জনগণ বলে মনে করবেন তারা, ততদিন পর্যন্ত তারা সড়ক অনিরাপদ ও হন্তারক বাসচালক/মালিকদের বাঁচাবার আয়োজনই করবেন। এই অন্ধ গলি থেকে বেরিয়ে আসার আবেদন ওই সব শিশুর। নিরাপদ সড়কের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিশুরা লিখছে- নিরাপদ সড়ক চাই।
ড. মাহবুব হাসান , কবি, সাংবাদিক