সখি, ভালোবাসার কি দিবস হয়?

0

॥ লীনা পারভীন॥
১৪ ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার ইতিহাস বা এর পেছনের গল্পটা এরই মধ্যে সবার মুখস্থ হয়ে গেছে। আজকের এ লেখার বিষয় ইতিহাসের ক্লাস নেওয়া নয়। তাহলে কেন এই লেখা? আসলেই তো, কেন লিখতে বসলাম আমি এ ভালোবাসা দিবস নিয়ে? আসলে ভেবে দেখলাম, ভালোবাসার যেমন কোনো কারণ থাকে না তেমনি ভালোবাসা দিবস নিয়ে কয়েক লাইন লিখতেও কোনো কারণ থাকতেই হবে কেন? আমাদের দেশে এ ভালোবাসা দিবস পালনের শুরুটা কবে কেমন করে হয়েছিল সেটাও সবার জানা। অনানুষ্ঠানিকভাবে শুরুটা হলেও ধীরে ধীরে এ দিবসের করপোরেটাইজেশন হয়ে গেলো কেমন করে এ বিষয়টা অবশ্য কারও জানা নেই। ভালোবাসার মানুষগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়তমাকে চুমু খেতেও এখন নেগেটিভ সার্টিফিকেট লাগছে। এই বাস্তবতায় ভালোবাসা দিবস আসুক তুমুলভাবে। মানুষ ফিরে পাক তার হারানো প্রাণ। তুমুল বাঁচুক ভালোবেসে। প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি এলেই আমরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যাই। কেন? এর পেছনে একটা রাজনৈতিক কারণ অবশ্য আছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি শফিক রেহমানের হাত ধরে ভ্যালেন্টাইন দিবসের প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত এই দিনটি ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবেই পালিত হতো। ১৯৮২ সালের এই দিনে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের প্রণীত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে সচিবালয়মুখী এক মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল ১০ জন মানুষ। এরপর থেকেই এ দিনটি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবেই পালন করা হতো। কিন্তু ১৯৯৩ সাল থেকে এই দিনটি দখল করে নিলো শফিক রেহমানের হাত ধরে শুরু হওয়া ভ্যালেন্টাইন দিবস। এ কারণেই এখনও প্রতি বছর এই তর্ক চলতেই থাকে। কিন্তু ভালোবাসা অদম্য। সে কোনো বাধা মানে না। তাই তো বসন্তের বাতাসের হাত ধরে ভালোবাসা ছড়িয়ে গেলো সবখানে। প্রথম দিকে গ্রামগঞ্জে এর ধারণা প্রচলিত না হলেও এখন মোটামুটি মিডিয়া ও বাজার অর্থনীতির যুগে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে কেউ ভুলে না। এজন্য প্রস্তুতিও থাকে ভালো।
কয়েক বছর ধরে ভালোবাসা কেবল একদিনেই আটকে নেই। চকোলেট দিবস, হাগ দিবস, টেডি দিবস, কিস দিবসসহ এমন প্রায় সপ্তাহব্যাপী দিবসের পরে আসে ভালোবাসা দিবস। অর্থাৎ ভালোবাসার ব্যাপ্তি বাড়ছে। এই কয়েকটা দিন ভালোবাসার মানুষগুলো নিজের আবেগের কাছে পরাস্ত থাকে। কোন দিনকে কেমন করে প্রিয়জনের কাছে তুলে ধরবে বা বিশেষ করতে পারবে এ নিয়ে চলে পরিকল্পনাও। করপোরেটাইজেশনের ফলাফল হলেও এর মধ্যে বেশকিছু ভালো দিক কিন্তু রয়ে গেছে। দিবসের একটি বড় অর্থনৈতিক হিসাব আছে। যদিও বাংলা ক্যালেন্ডারের মারপ্যাচের কারণে গত বছর থেকে বাংলা একাডেমি ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবসকে ব্লেন্ড করে দিয়েছে অর্থাৎ এই দুটি দিন এখন আর দুদিনে পালিত হচ্ছে না। একই দিনে হচ্ছে। এই যে একদিনে দুই উৎসব, এজন্য কিন্তু কোটি টাকার অর্থনৈতিক লেনদেন বন্ধ হয়ে গেলো। দুটি দিবসের দুই রঙ, দুই আমেজ, ভিন্ন প্রস্তুতিতে দুই সৌন্দর্য ছিল। এমনকি চর্চাটাও আলাদা। তাই, এই দুটি দিবসকে কেন্দ্র করে প্রচুর ফুল, পোশাক, খাবার ব্যবসায়ীদের একটি ভালোরকম সুযোগ আসতো। দিবসভিত্তিক উদযাপনের এই যে অর্থনৈতিক দিকটি এটিকে কিন্তু কোনোভাবেই উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। চকোলেট ডে’তে কত টাকার চকোলেট বিক্রি হয় বা টেডি দিবসে কতটা বিক্রি হয়, যা হয়তো সারা বছরেও হয় না তার হিসাব হয়তো এখনও শুরু হয়নি কিন্তু অচিরেই শুরু হয়ে যাবে। তাই দিবস মানেই খারাপ কিছু নয়। বা যারা মনে করছেন ভালোবাসার আবার দিবস কি, তারা কিন্তু চাইলেই একটু অন্যভাবেও ভাবতে পারেন। তবে দিনশেষে আমার কাছে মানুষের ভালো থাকাই বিষয়। এর থেকে মূল্যবান আর কিছু হয় না। বিশেষ করে করোনা আসার পর যখন আমরা গোটা বিশ্বের মানুষ মানসিভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় আছি, অনেকেই মৃত্যু গণনা শুরু করেছেন বা এখন তো করোনার ভয় আমাদের একে অপরের কাছেও আসতে দিচ্ছে না।ভালোবাসার মানুষগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়তমাকে চুমু খেতেও এখন নেগেটিভ সার্টিফিকেট লাগছে। এই বাস্তবতায় ভালোবাসা দিবস আসুক তুমুলভাবে। মানুষ ফিরে পাক তার হারানো প্রাণ। তুমুল বাঁচুক ভালোবেসে। ভালোবাসার চেয়ে বড় সৌন্দর্য এই পৃথিবীতে আর কিছু সৃষ্টি হয়নি। এই ভালোবাসা হতে পারে দুজন নরনারীর মাঝে হোক পরিবারের সবার মাঝে বা দুজন বন্ধুর মাঝে। তাও মানুষ ভালোবাসুক। পৃথিবীর বুক থেকে হিংসা বিদ্বেষ সরে যাক। ধর্মের নামে হানাহানি বন্ধ হোক। নারীর প্রতি ভালোবাসা আসুক নির্যাতনকারীর বুকে। স্বৈরাচারের প্রতি ঘৃণাটা থাকুক বুকে তাই বলে ঘৃণার জন্য ভালোবাসাকে সামনে আনা যাবে না এমনটা যেন না হয়। দুজন প্রেমিকের বুকে লেখা থাকুক স্বৈরাচার নিপাত যাক, ভালোবাসা জয় পাক। ভালোবাসার জন্য কোনো দিবস লাগে না কিন্তু দিবসকে কেন্দ্র করে ভালোবাসার জাগরণ ঘটতে তো কোনো মানা থাকতে পারে না। জয় হোক মানবতার, জয় হোক ভালোবাসার।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।