শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পাঁয়তারা শুভ নয়

0

ড. আবদুল লতিফ মাসুম
গত দু’বছর ধরে মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাবে গোটা বিশ্বের জনজীবন বিপন্ন হয়েছে বারবার। জীবনের গতি ভারাক্রান্ত হয়েছে। থেমে গেছে শিল্পের চাকা। শ্রমিকের হাতিয়ার। অর্থনীতিতে নেমেছে ধস। রাজনীতি হয়েছে স্থবির। এর মাঝে সব ক্ষতি ছাপিয়ে যা আমাদের এই প্রজন্মকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিপর্যয়ের সম্মুখীন করেছে- তা হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্ডারগার্টেন থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত এই ক্ষতি হয়েছে পরিব্যাপ্ত। এর মোকাবেলায় উন্নত জাতিসমূহ গ্রহণ করেছে উন্নত ব্যবস্থা। মহামারী নিরোধক ব্যবস্থা থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কাঠিন্য প্রদর্শিত হয়েছে সর্বত্র। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে এবং অবাস্তবভাবে সমগ্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকেনি কোথাও। যখন যেখানে যেমন-সেখানে তেমন ব্যবস্থাই গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ করোনা সংক্রমিত এলাকায় সাময়িকভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। আবার যেখানে করোনা সংক্রমিত হয়নি, সেখানে যথারীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হয়েছে। এভাবে পার্থক্য এসেছে গ্রাম ও শহরে। বৈচিত্র্য এসেছে স্থান থেকে স্থানান্তরে। মূল কথাটি হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখার পক্ষে সমাজ ও সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু আমরা দুর্ভাগ্যের সাথে লক্ষ করেছি যে, ২০২০ সালের মার্চ মাসের ২৪ তারিখ থেকে বাংলাদেশে সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। করোনা আক্রান্ত ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে যে আইন করোনা অনাক্রান্ত গ্রাম বাংলায়ও সেই একই আইন প্রয়োগ করা হয়। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়।
এটি ছিল সরকারের পক্ষ থেকে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত। করোনার প্রথম ধাপ যখন ঢাকা শহরকে গ্রাস করছিল, তখন সীমান্তসহ বৃহত্তর গ্রাম বাংলা, হাওর-বাঁওড় ও উপক‚লীয় অঞ্চল ছিল সম্পূর্ণ করোনামুক্ত। আবার করোনার দ্বিতীয় ধাপে সীমান্ত যখন আক্রান্ত তখন ঢাকা শহর অত বিপদ সঙ্কুল ছিল না। অথচ ঢাকা শহরকে একরকম অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। তৃতীয় ঢেউয়ের এই সময়ে যখন প্রতিটি মানুষকে টিকার আওতায় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে, করোনার প্রকোপ ওমিক্রন নামে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে- তখন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ তৃতীয়বারের মতো বন্ধের সম্মুখীন হয়েছে। করোনার ঘনঘটার প্রাথমিক অবস্থা থেকেই সরকারের অবাস্তব ও বিমাতাসুলভ সিদ্ধান্তের পরিচয় পাওয়া যায়। প্রথম থেকে সর্বশেষ ধাপ পর্যন্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়নি কখনো। প্রথমবারে যখন কিছু সময়ের জন্য গার্মেন্টস শ্রমিকদের ছুটি দেয়া হয়েছিল, অল্পকাল পরেই তা বাতিল করা হয়। এভাবে সরকারের তুঘলকি কাণ্ড কারখানার কারণে শ্রমিকদের আশা-যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক কষ্ট করতে হয়। অদ্ভুত এদের সিদ্ধান্ত। শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছুটি দিয়ে পরে যখন খোলার সিদ্ধান্ত দেয়া হয়, তখন গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন যখন অফিস-আদালত, শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আমোদ-প্রমোদের জায়গাগুলো একদম খোলা, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে একরকম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গোটা দেশের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার পক্ষে, তখন সরকার উল্টো সিদ্ধান্ত নিলো। বিগত ২১ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তথাকথিত স্বায়ত্তশাসন থাকার কারণে তাদের নিজ নিজ দায়িত্বে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কিন্ডারগার্টেন থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যে ভিন্নতা রয়েছে, তা উপেক্ষিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিণত বয়সের নাগরিকরা পড়াশুনা করে। তারা শিশু অথবা বালক নয়। কলেজেও রয়েছে ভিন্নতা। মাধ্যমিক স্কুলসমূহ সতর্কতার সাথে পরিচালিত হতে পারত। প্রাথমিক বিদ্যালয় বা কিন্ডারগার্টেনগুলো অবশ্য সাময়িক ছুটি ঘোষণা করতে পারত। তা না করে সাধারণভাবে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষিত হওয়ায় পাঠক্রম ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়েছে। দেড় বছর বন্ধ থাকার পর মাত্র এক মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে না খুলতেই আজগুবি সিদ্ধান্তের সম্মুখীন হয়েছে। অথচ এর আগে শিক্ষামন্ত্রী বারবার আশ্বস্ত করছিলেন যে, এবারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সহজে বন্ধ হবে না। নিজেই নিজের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দিলেন। অবশ্য শিক্ষামন্ত্রীর এরকম আচরণ নতুন নয়। এর আগেও জনমতকে সঠিকভাবে অনুধাবন না করে তিনি অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এবারের নির্দেশনায় বলা হয়েছে ২১ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। নিদের্শনায় আরো বলা হয়েছে : রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সমাবেশ বা অনুষ্ঠানে একশ জনের বেশি সমাবেশ করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যারা যোগ দেবেন তাদের অবশ্যই ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট দেখাতে হবে। সরকারের এই অবাস্তব ও অকারণ সিদ্ধান্তের সমালোচনা এসেছে সুধীজন থেকে। তারা বলছেন, এখনো এ দেশে এরকম অবস্থা হয়নি যে বিয়ে বা জানাজায় লোকজন গুনে গুনে অংশগ্রহণ করবে। অথবা কারো করোনার টিকার সার্টিফিকেট দেখিয়ে প্রবেশ করবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা জনবিচ্ছিন্ন আজব জীব নয় যে, তারা ঘরে বসে থাকবে। আর সব কিছু সচল থাকবে। কোথাও তাদের প্রবেশাধিকার থাকবে না। ইতোমধ্যে সরকারের এই সিদ্ধান্তের অসারতা প্রমাণিত হয়েছে। সরকার শিক্ষার্থীদের সবাইকে টিকা না দিয়ে কী করে তাদের সার্টিফিকেট দেখাতে বলতে পারে! সরকারের সদিচ্ছা থাকলে ইতোমধ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়া সম্ভব ছিল। উল্লেখ্য যে, এই কিছু দিন আগে যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হয় তখন তাদের প্রায় সবার টিকা নেওয়া নিশ্চিত করা হয়েছিল। তাহলে এখন কোন যুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেয়ার পাঁয়তারা কষছে! তাহলে সেটা কি সত্য যেভাবে বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বলছেন- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘকাল থেকেই রাজনীতির সূতিকাগার বলে পরিচিত। এ দেশে যা কিছু অর্জন, তার পেছনে ছাত্রসমাজের বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে। এই সরকারের সে অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। সরকার শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলন দেখেছে। ছলে-বলে-কলে-কৌশলে তাদের ওই আন্দোলন মোকাবেলা করেছে। আবার নিরাপদ সড়কের জন্য যখন শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে, তখনো সরকারকে কোমল ও কঠোর কৌশলে তাদের বাগে আনতে হয়েছে। এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরপরই নতুন করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন জেঁকে বসে। প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনার পর তারা ঘরে ফিরে যায়। দেখা যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা সব সরকারের জন্য সবসময়ই মাথাব্যথার কারণ হয়েছে। বিশেষত এই সময়ে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের ঘোষণা জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। আগামী ৬ ফেব্রæয়ারি, রোববার পর্যন্ত বন্ধের নোটিশ রয়েছে। ইতোমধ্যে ওই বন্ধ আর না বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে শিক্ষার্থীদের অর্থাৎ ছাত্রদের সংগঠনগুলো, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, শিক্ষক সমিতি এবং অভিভাবকরা। এই নিবন্ধটি যখন প্রকাশিত হবে তখন সরকারের প্রকৃত সিদ্ধান্ত জানা যাবে। কিন্তু জনগণের আশঙ্কা যে, এই বন্ধটি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। কমপক্ষে এক মাসের ছুটি দেওয়া হতে পারে বলে গুজব শোনা যাচ্ছে। এক মাস পরে এপ্রিলের প্রথম থেকে রমজান মাস শুরু হবে। সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে রমজান পর্যন্ত ছুটি প্রলম্বিত করার মতলব আঁটছে- বলে আগাম বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। যদি সাধারণ মানুষের ইচ্ছা অনুযায়ী ছুটি আর দীর্ঘায়িত না হয়, তাহলে সরকার অবশ্যই সাধুবাদ পাবে। আর যদি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তাহলে তাদের রাগ, ক্ষোভ ও হতাশা আরো বাড়বে। আর সেসবের জন্য সরকারকে দায়ী করবে সবাই। সরকারের ক্ষয়িষ্ণু জনপ্রিয়তা আরো ক্ষয়িষ্ণু হবে। ইতোমধ্যে সরকার বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে সশরীরে ক্লাস বন্ধ করে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে যে, কথিত অনলাইন শিক্ষা বাংলাদেশের জন্য বাস্তবসম্মত নয়। শিক্ষক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতাও অনুরূপ। ছাত্ররা এরকম ছুটি পেলে ঘরমুখো হয়। সেখানে গিয়ে তারা ক্লাস বাদে আর সবকিছুই করে। প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে তাদের অনেককে যোগাযোগ করা হলেও তারা যথার্থ সাড়া দেয় না। অবশ্য পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এলে তাদের আবদার ও আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। তখন নামকাওয়াস্তে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অনেকে। অনলাইন ব্যবস্থায় দেখে দেখে লেখারও নিয়ম আছে। সেভাবেই তৈরি হয় অ্যাসাইনমেন্ট। শিক্ষার ক্ষেত্রে এটা কোনো কাজে আসে না। সরকার গত দু’বছরে অটো পাস দিয়ে শিক্ষার সর্বনাশ ঘটিয়েছে। অন্যত্র তথাকথিত সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের নামে নামকাওয়াস্তে শেখার ব্যবস্থা করেছে। এভাবেই শিক্ষাক্ষেত্রে গোটা জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। আগামী দিনগুলোতে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে এই কমতি ও ঘাটতি পুরো জাতিকে পুরোদমে ভোগাবে।
এমতাবস্থায় গোটা জাতির তরফ থেকে সরকারের কাছে বিনীত নিবেদন- দয়া করে শিক্ষার আর সর্বনাশ করবেন না।
সরকারকে যা করতে হবে, তা হলো :
১. শিক্ষার সব স্তরে টিকাদান ১০০% নিশ্চিত করা।
২. স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে প্রয়োগ করে সরাসরি অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা।
৩. নো এক্সাম, নো প্রমোশন- অর্থাৎ পরীক্ষা ছাড়া কোনো স্তরেই কোনো পাস না দেওয়া।
৪. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা।
৫. স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতকরণে উপায় হিসেবে পর্যাপ্ত একোমোডেশন এবং ফার্নিচার নিশ্চিত করা।
৬. শিক্ষকদের মর্যাদাকর বেতনভাতা প্রদান করা।
৭. অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
৮.গণমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উপকারী উপদেশনামূলক অনুষ্ঠান পরিচালনা করা।
৯.শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতকরণের জন্য ছাত্ররাজনীতির নামে অরাজকতা বন্ধ করা।
১০. পর্যাপ্ত শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করা।
এসব ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা হলে আশা করা যায় যে, শিক্ষার্থীদের সশরীরে উপস্থিতি মহামারী প্রতিরোধক হবে। বাংলাদেশে উন্নত দেশগুলোর মতো শিক্ষার পরিবেশ সম্ভব নয়। সীমাবদ্ধতা ও সমস্যার মধ্য দিয়ে শিক্ষাঙ্গনকে সচল রাখতে হবে- এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়