‘আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে রোগী ভর্তি করে ফেলা হতো বিলের ফাঁদে’

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সরকারি হাসপাতাল থেকে দালালদের মাধ্যমে রোগী ভাগিয়ে রাজধানীর শ্যামলীর ‘আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে’ ভর্তি করার পর বিলের ফাঁদে রোগীকে জিম্মি করা হতো। আদায় করা হতো মোটা অংকের টাকা। আর বনিবনা না হলে বের করে দেওয়া হতো রোগীকে। গত ২ জানুয়ারি সাভার থেকে অসুস্থ যমজ শিশুকে নিয়ে শ্যামলীর একটি সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন এক নারী। পরে দালালরা তাকে সেখান থেকে ভাগিয়ে বেসরকারি এই হাসপাতালে (আমার বাংলাদেশ) ভর্তি করান। দুইদিনে তার বিল করা হয় লাখ টাকা। ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করার পর আর বিল দিতে পারবেন না জানালে তাকে ঘটনার দিন রাতে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে হাসপাতালের বাইরে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ঘটনার পর ওই নারী ঢাকা মেডিকেলে যান। সেখানে তিনি মৃত শিশুকে এক কোলে এবং অসুস্থ এক শিশুকে আরেক কোলে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন। ঘটনাটি বিভিন্ন গণমাধ্যম ও র‌্যাবের গোয়েন্দাদের নজরে আসে। এরপর আজ শ্যামলীর ওই হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়। তার নাম গোলাম সারওয়ার। শুক্রবার (৭ জানুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি জানান, নিয়মানুযায়ী হাসপাতালটিতে দুটি আইসিইউ থাকার কথা কিন্তু সেখানে ছয়টি আইসিইউ অর্থাৎ ৪টি আইসিইউ বেশি। এর মধ্যে ভেন্টিলেটর রয়েছে মাত্র দুটিতে। ৯টি এনআইসিইউ থাকলেও ইনকিউভেটর মাত্র একটি। করোনাকালে আইসিইউর চাহিদা বেশি থাকার সুযোগে অধিক মুনাফার ফাঁদ হিসেবেই অনুমোদন ছাড়াই চলছিল অতিরিক্ত চারটি আইসিইউ।
শুধু তাই নয়, ৩০টি সাধারণ বেড থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ১৫টি। হাসপাতাল পরিচালনার বিধি অনুযায়ী ছয়জন নার্স থাকার কথা থাকলেও নার্স রয়েছে মাত্র দুজন। আর তিনজন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও একজন চিকিৎসকের দায়িত্বে চলছিল আমার বাংলাদেশ হাসপাতালটির সার্বিক ব্যবস্থাপনা। যদিও সেই নার্স ও চিকিৎসক, আইসিইউ ও এনআইসিইউ পরিচালনার মতো অভিজ্ঞ ছিলেন না। তারা সাধারণ নার্স ও চিকিৎসক ছিলেন। মূলত আইসিইউকেন্দ্রিক ব্যবসার ফাঁদ তৈরি করে তিনি অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছেন। র‌্যাব বলছে, সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে ভর্তির পর বিলের ফাঁদে জিম্মি করা হতো রোগীকে। আদায় করা হতো মোটা অংকের টাকা। আর বনিবনা না হলে তাদের বের করে দেওয়া হতো।
এদিকে, যমজ শিশুর মধ্যে আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় ভুক্তভোগী নারী রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের মালিক ও পরিচালককে আসামি করে একটি মামলা করেন। মামলার পর র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাব-২ ও র‌্যাব-৩-এর যৌথ অভিযানে শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা হতে ওই হাসপাতালের মালিক মোহাম্মদ গোলাম সারওয়ারকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার গোলাম সারওয়ার র‌্যাবকে জানান, আমার বাংলাদেশ হাসপাতালে রোগী ভর্তির লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে দালাল নিয়োগ করা আছে। দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বেসরকারি ওই হাসপাতালটিতে গত ২ জানুয়ারি যমজ ভ্রাতাকে ভর্তি করা হয়। ভর্তির পর থেকে বিল পরিশোধের জন্য চাপ দেওয়া হয়। অন্যথায় চিকিৎসা করা হবে না বলে জানানো হয়। ভিকটিম ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করে। তবে অতিরিক্ত আরও টাকা দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অর্থ না দেওয়ায় চিকিৎসা বন্ধ রাখা হয় বলে ভুক্তভোগী অভিযোগ করে। একপর্যায়ে অর্থ না পাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ভুক্তভোগীর মায়ের যমজ সন্তানকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া হয়।
গ্রেফতার সারওয়ার র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি দীর্ঘ ২০-২২ বছর ধরে রাজারবাগ, বাসাবো, মুগদা, মোহাম্মদপুর ও শ্যামলী এলাকায় ছয়টি হাসপাতাল পরিচালনা করে আসছেন। সেগুলো হলো ঢাকা ট্রমা, বাংলাদেশ ট্রমা হাসপাতাল, মমতাজ মেমোরিয়াল ডাগনস্টিক, আরাব ডায়াগনস্টিক, মোহাম্মদিয়া মেডিকেল সার্ভিসেস ও আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল। এর মধ্যে আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল বাদে সবই বন্ধ করেছেন নানা অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগ ওঠার পর। প্রায় এক বছর ধরে শ্যামলীতে আমার বাংলাদেশ হাসপাতাল খুলে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেন তিনি। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আমার বাংলাদেশ হাসপাতালের সঙ্গে দালাল সিন্ডিকেট জড়ান। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল হতে রোগীদের ফুসলিয়ে নিজের হাসপাতালে নিয়ে আসতেন। অনুমোদন পাওয়ার শর্ত না মেনেও কী করে হাসপাতালটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন পেয়েছে সে ব্যাপারে র‌্যাব কোনো তথ্য পেয়েছে কি না জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, বিগত সময়ে যখনই অনিয়ম-প্রতারণা ও রোগী জিম্মির বিষয়টি সামনে এসেছে তখনই তিনি হাসপাতাল বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি বন্ধ করেছেন। এরপর নতুন নামে ফের আরেকটি প্রতিষ্ঠান চালু করেছেন। তিনি যখন অনুমোদন পান তখন হয়তো সেই ধরনের শর্তপূরণের বিষয়টি তিনি ইন্সপেক্টশনে দেখিয়েছেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা অভিযানের সময় ছিলেন, তারাও নিশ্চয় বিষয়টি পর্যালোচনা করবেন। আমরা বিশদ জিজ্ঞাসাবাদে বিষয়টি জানার চেষ্টা করবো। তিনি আরও বলেন, অবহেলাজনিত মৃত্যুর ঘটনায় মামলা হয়েছে। যেহেতু জোরপূর্বক নির্যাতন করে বের করে দেওয়ায় যমজ এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এতে হত্যার অভিযোগ আনা হবে কি না জানতে চাইলে কমান্ডার মঈন বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা বিষয়টি দেখবেন। যেহেতু এখানে পোস্টমর্টেমের বিষয় আছে। মামলায় ভুক্তভোগী মাও অভিযোগ করেছেন যে, তাকেসহ যমজ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। তদন্তে ও ময়নাতদন্তে তা উঠে আসলে অবশ্যই হত্যার বিষয়টিও অভিযোগপত্রে আসবে।