যশোর শিক্ষা বোর্ডের ৭ কোটি টাকা লোপাট তদন্ত কর্মকর্তা বদলি ও চেয়ারম্যান-সচিবকে দায়মুক্তির সুপারিশে ঘটনা চাপা পড়ার শংকা

0

তহীদ মনি ॥ যশোর শিক্ষা বোর্ডের জালিয়াতির মাধ্যমে ৩৮টি চেকের বিপরীতে ৭ কোটির অধিক টাকা লোপাটের ঘটনা চাপা পড়ে যেতে পারে বলে অনেকেই আশংকা করছেন। যশোর দুর্নীতি দমন কমিশনে চলমান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার হঠাৎ বদলি, শিক্ষা বোর্ডের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির রিপোর্টে চেকে স্বাক্ষরকারী চেয়ারম্যান ও সচিবকে দায়মুক্তির সুপারিশ করা এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আব্দুস সালাম ও ঠিকাদার শেখ শরিফুল ইসলাম বাবুকে জালিয়াতির মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করায় এই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যদিও সদ্য বিদায়ী দুদকের তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. নাজমুচ্ছায়াদাত জানিয়েছেন, কারো পার পাবার সুযোগ নেই। তদন্ত কর্মকর্তা বদল হলেও মামলা বা মামলার মেরিট বদল হওয়ার সুযোগ নেই।
শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত ৭ সেপ্টেম্বর ৯টি চেক জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। পরে আরো ১টি মিলে মোট ১০টি চেকে ১২ হাজার ৩১২ টাকার স্থলে জালিয়াতি চেক ২ কোটি ৫৫ লাখ ৪২ হাজার ২০ টাকা বোর্ডের ব্যাংক একাউন্ট থেকে উত্তোলন করে নেয়। এ ঘটনায় যশোর দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ১০ সেপ্টেম্বর একটি মামলা হয়। এ সময় আরো ২ দফায় ২৮টি চেক জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। সে হিসেবে মোট ৩৮টি চেকে ৭ কোটির অধিক টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। এ ঘটনায় শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ কলেজ পরিদর্শক কেএম রব্বানীকে প্রধান করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ৯ সেপ্টেম্বর তাদেরকে ৭দিন সময় দিলেও ১ মাস ৬দিন পর ১৪ অক্টোবর তারা প্রতিবেদন জমা দেয়। তাছাড়া দুদকের পক্ষ থেকে তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমির হোসেন, সচিব প্রফেসর এএমএইচ আলী আর রেজা, বোর্ড কর্মচারী মো. আব্দুস সালাম, ভেনাস প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিংয়ের মালিক শেখ শরিফুল ইসলাম বাবু ও মেসার্স শাহীলাল স্টোরের মালিক শরিফুলকে আসামি করা হয়। এরপর নতুন নতুন চেক ধরা পড়ার পর এবং নতুন নতুন প্রতিষ্ঠানের নাম যুক্ত হওয়ায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) মো. নাজমুচ্ছায়াদত জানিয়েছেন, টাকার সর্বশেষ গন্তব্য পর্যন্ত যাওয়া হবে এবং সংশ্লিষ্ট সবাই মামলায় যুক্ত হবেন।
সূত্র মতে, গত ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমির হোসেন পক্ষের লোকজন বলেন, শিক্ষা বোর্ড এই টাকা ফেরত পাবে না, মামলা এক সময় অকার্যকর হয়ে পড়বে এবং খুব শিগগিরই যশোর দুদকের উপপরিচালক ও মামলার আইও বদলি হয়ে যাবে। তারা আরো বলেন, সাবেক চেয়ারম্যান ও এই জালিয়াতি চক্রের হাত অনেক লম্বা। তারা সব ব্যবস্থাই করে ফেলবেন। এই পক্ষের কথা সত্যি মিথ্যে যাই হোক গত ২৬ ডিসেম্বর দুদক যশোরের উপপরিচালক ও মামলার আইও মো. নাজমুচ্ছায়াদাতকে চট্টগ্রাম মহানগরে বদলি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তিনি সেখানে যোগদান করেছেন। তার স্থলে যশোরে এসেছেন মো. আল আমিন। বর্তমানে তিনি একটি প্রশিক্ষণে যশোরের বাইরে আছেন বিধায় তার সাথে কথা বলা যায়নি। এদিকে মো. নাজমুচ্ছায়াদাত বদলি হওয়ায় বোর্ডের চেক জালিয়াতির মামলা ও তার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিক্ষা বোর্ড কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মাকসুদ আল হাবীব এবং শিক্ষা বোর্ড এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সভাপতি মো. আসাদুজ্জামান বাবলু। তারা জানান, মামলার কার্যক্রম অনেকদূর এগিয়েছিল। অনেক তথ্য দুদক নিয়েছে। বিদায়ী আইও যতটা জেনেছেন, গভীরতায় পৌঁছেছেন। একজন নতুন আইওকে ততোটা গভীরে যেতে অনেক সময় লাগতে পারে। তারা আরো জানান, আইও বদলির খবরের পর থেকে শিক্ষা বোর্ডে কারো কারো আচরণে বিজয়ের ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে, সদ্য বিদায়ী উপপরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত চট্টগ্রাম থেকে মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন, আশঙ্কার কিছু নেই। আইও বদল হয়েছে, মামলা বদলি হয়নি। তিনি বলেন, মামলা ও তদন্ত দু’টোই এমন এক গভীরতায় পৌঁছেছে এবং এমন তথ্য ও নথি জব্দ করা হয়েছে যার মাধ্যমে সকল অপরাধীকে আটকানো সম্ভব। তদন্তাধীন বিষয় বলে বিস্তারিত মন্তব্য না করলেও তিনি জানান, টাকা কোথা থেকে কার নির্দেশে কোন কোন হাত ঘুরে কোন কোন ব্যাংকে গেছে সব প্রমাণ দুদকের হাতে আছে। এ জাতীয় মামলার জন্যে কর্তৃপক্ষ ১৮০ কার্যদিবসের সময়সীমা নির্ধারণ রয়েছে তার আগেই যশোরবাসী সমস্ত বিষয়ই অবগত হতে পারবেন। এদিকে, যশোর শিক্ষা বোর্ডের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি ৫৮ পৃষ্ঠার যে তদন্ত রিপোর্ট শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে তা একপেশে দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন শিক্ষা বোর্ডের সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সিবিএ নেতারা। তদন্ত প্রতিবেদনে তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মোল্লা আমিন হোসেন ও সচিবকে এক প্রকার দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। বোর্ডের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা জানান, প্রথমত ওই রিপোর্ট ভিত্তিহীন এবং অবৈধ। তাদের মতে, একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দুর্নীতি কখনোই তার অধঃস্তন কেউ তদন্ত করতে পারে না এবং তিনি যদি তার চেয়ারে সমাসীন থাকেন, তবে আরো অবৈধ। এসব কর্মকর্তার মতে, কমপক্ষে সমমর্যাদা বা সমপদের কেউ তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হবেন। এসব কর্মকর্তা দাবি করেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি ওই রিপোর্টকে ভিত্তি ধরে, তাহলে প্রকৃত অপরাধী শনাক্ত হবে না এবং আত্মসাৎ করা টাকা ফেরত পাওয়া ও একপ্রকার অসম্ভব হবে। এদিকে মন্ত্রণালয়ে জমা হওয়া অসম্পূর্ণ ও একপেশে তদন্ত রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করা হবে কিনা বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নতুন করে তদন্তের অনুরোধ জানানো হবে কিনা এমন প্রশ্নের বেশিরভাগ দিক এড়িয়ে যান বর্তমান চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আহসান হাবীব। তিনি জানান, এটা আগের চেয়ারম্যানের সময় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট। মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে। তারা যে ব্যবস্থা নেবে সেটাই কার্যকরী হবে।