কার্বন নির্গমন কমাতে কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের দাবি

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ রাজধানীর একটি আলোচনা সভায় বৈশ্বিক তাপমাত্রাকে সীমাবদ্ধ রাখতে কার্বন নির্গমন কমাতে কয়লা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের জোরাল দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ। সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি) এবং কোস্ট ফাউন্ডেশন, সিসিডিবি, সিডিপি, ইপসা, মালেয়া ফাউন্ডেশন, এসডিএস, ক্যানসা-বাংলাদেশসহ কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে UNFCCC-এর ২৬তম জলবায়ু সমঝোতা সম্মেলনের (কপ-২৬) পরবর্তী পর্যালোচনা ও নাগরিক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। এতে এসব দাবি করা হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন পিকেএসএফ এর সভাপতি ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহম্মেদ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিআরডি’র প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা, অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. নুরুল কাদের, বাংলাদেশ পরিবেশ সংবাদিক ফোরামের সভাপতি কামরুল ইসলাম, ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরামের সভাপতি কাওসার রহমান, সিডিপি’র নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গির হাসান মাসুম, সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র, কোস্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক সৈয়দ আমিনুল হক।
সভাপতির বক্তব্যে ড. খালিকুজ্জামান বলেন, আমাদের নীতি নির্ধরকগণ বিভিন্ন আঞ্চলিক সমস্যা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের দূর্গত মানুষের সমস্যাগুলো দেখেন না। মাঝেমধ্যে দেখা যায় তারা কিছু লোকজন প্রেরণ করেন দূর্গত অঞ্চলে এবং সেখান থেকে কিছু তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। যার ফলে তাদের কথাগুলো সাধারণত হৃদয় থেকে আসে না এই জন্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের আকাঙ্ক্ষাগুলোর বাস্তবায়ন হতেও দেখা যায় কম এবং তার নেতিবাচক প্রভাবও আমরা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালায় লক্ষ্য করি। জলবায়ূ পরির্বতনের নেতিবাচক অভিঘাতের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে, এর জন্যই আমরা দেখছি বহু অঞ্চলে উদ্বাস্তু মানুষের ঢল নেমে যাবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর যদি আমরা বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে না পারি এবং এটিকে ১.৫ এর স্থলে যদি ২ ডিগ্রি ঘোষণা করা হয়, তাহলে সেটি অনেক অঞ্চল এবং দেশের জন্য মৃত্যু দন্ড ঘোষণারই নামান্তর। সকল পরিস্থিতি এবং বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে এই শতাব্দির শেষে গিয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব না, কাজেই এখন থেকেই বিশ্ব সম্প্রদায়কে কার্বন নির্গমন কমানোর পাশাপাশি ব্যাপকভাবে অভিযোজন পরিকল্পনা, প্রযুক্তি এবং দক্ষতার দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
প্রধান বক্তার বক্তব্যে শামসুদ্দোহা বলেন, অনেক সীমাবদ্ধতা এবং সমালোচনা থাকলেও ‘কপ-২৬’ এ অনেকগুলো ভালো অর্জনও আছে। এবারের ‘কপ’ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নতুন কিছু আশার আলো নিয়ে এসেছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের একমত হওয়ার বিষয়টিকে নতুন পথচলার সূচনা বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন আইপসিসি’র রিপোর্ট-৬ প্রকাশিত হওয়ার পর পরই ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রাকে সীমবদ্ধ রাখার বিষয়ে আমাদের দাবিটি আরও দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে। আমাদের বিভিন্ন গবেষণা, বক্তব্য এবং দাবির ফলাফল হিসেবেই কপ-২৬ এ এটি আদায় হয়েছে। কিন্তু ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য সঠিক হারে কার্বন নির্গমন হ্রাস করতে ব্যর্থ হলে সকল প্রচেষ্টা এবং উদ্যোগই বিফলে যেতে পারে। ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রাকে সীমাবদ্ধ রাখতে কার্বন নির্গমন হ্রাসকরণের সময় বয়ে যাচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে আনুপাতিক হারে নির্গমন হ্রাসকরণের বিষয়ে অঙ্গীকার চান এবং এটিকে একটি ‘লিগ্যালি বাইন্ডিং এ্যাগ্রিমেন্ট’ এর আওতায় আনার দাবি জানান। এবারের কপে আমাদের অন্যতম একটি বড় চাওয়া ছিল কয়লার ব্যবহার বন্ধে একটি “ফেইস আউট টাইম ফ্রেইম” নির্ধারণ করা। কিন্তু ভারত, চীনসহ কয়েকটি দেশের বাধার ফলে এইটি আমরা অর্জন করতে পারিনি। ২০৫০ সালের মধ্যে কয়লার ব্যবহারসহ সকল জীবাষ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের জোরাল দাবি জানান। তিনি বাংলাদেশের অভিযোজন পরিকল্পনা গুলোকে আঞ্চলিক চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করে বাস্তবায়নের বিষয়টি তুলে ধরেন এবং সেই সাথে অভিযোজন পরিকল্পনাগুলো বটম আপ এপ্রোচ মেনে তৈরি করার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
ড. নুরুল কাদের বলেন, এরই মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবার নেতিবাচক প্রভাব পর্যবেক্ষণ করেই কপ-২৬ এ বিশ্ব পক্ষ্যগুলো বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে সম্মত হয়েছেন। একই সাথে তিনি বলেন, এই পৃথিবীর ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের মানুষদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পথকে প্রসারিত করবে। তিনি বলেন, বর্তমান বাস্তবতা দেখে মনে হচ্ছে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসই অনেক বেশি, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রির বেশি হতে দেবার কোন সুযোগ নেই। কামরুল ইসলাম বলেন, আমরা এইবারের কপে অংশ নিয়েছিলাম মূলত কয়লার ‘ফ্যাইস আউট’ এর একটি নির্দিষ্ট সময় সীমা পাবার আসায় কিন্তু ভারত, চীনসহ কয়েকটি দেশের বাধায় আমরা কয়লার ‘ফ্যাইস ডাইন’ নীতি গ্রহণে বাধ্য করলেন, দেশগুলো মূলত তাদের হীন আর্থিক লাভের কথা বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বকে একটি বড় বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তিনি বলেন, আগামীর কপ গুলোতে এই ধরনের হটকারী সিদ্ধান্ত মোকাবিলায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমাদের দেশের নেগোশিয়েটরদের মাঝে সবজান্তা সাজার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্ত কার্যক্ষেত্রে তাদের সেই পান্ডিত্বের প্রতিফলন দেখি না। কাউসার রহমান অভিযোগ করে বলেন, কপ প্রক্রিয়াটিকে আস্তে আস্তে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের হাতিয়ারে রূপান্তরিত করা হচ্ছে এবং বৈজ্ঞানিক নানান তাগাদা এবং সাজেশন্সকে পাশ কাটিয়ে যাবার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় আর্থিক সাহায্য দেয়ার পরির্বতে সাহায্যের নামে ঋণ প্রদান এবং ব্যবসায়ীক ক্ষেত্র তৈরির পায়তারার বিষয়ে উন্নয়নশীল দেশ গুলোকে সজাক দৃষ্টি রাখার দাবি জানান। সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, কপ-২৬ এ উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের চাওয়ার যথাযথ প্রতিফলন হয়নি। উপকূলের জন্য আরও সুনিদ্রিষ্ট অভিযোজন পরিকল্পনা নিতে হবে বলেও তিনি উল্লেক করেন। তিনি বলেন, এখনই উপকূলীয় বহু অঞ্চলের মানুষকে জোয়ার ভাটার উপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করতে হয়, বহুমানুষ জোয়ারের সময় তাদের বাড়ি যেতে পারেন না বলে তিনি উল্লেখ করেন।