কালের কবলে শীত ও আগামী প্রজন্মের ছাড়পত্র

0

জয়নুল আবেদীন
‘বাংলাদেশে এবার আগেভাগেই শীত নামবে’ : খবর আবহাওয়া অধিদফতরের। কারণ, দেশের উত্তর-পশ্চিমের একটি চাপবলয়ের অবস্থান। শীত বিদায় নেয়ার প্রক্রিয়াটি স্লো পয়জনিংয়ের মতো খুবই ধীরগতিতে সম্পন্ন হচ্ছে বলে আমরা টের পাই না। শৈশবে দেখা শীত মনে করতে গিয়ে বারবার রমজান মাসের সাহরি খাওয়ার সময়টা সামনে চলে আসে। আমাদের ছিল তিন কক্ষবিশিষ্ট বড় চৌচালা টিনের ঘর। মাঝখানে মাটির ফ্লোরে খড় বিছিয়ে এর ওপর মোর্তার বিছানা পেতে মায়ের সাথে শুতাম। রোদে গরম কাঁথা শক্ত করে পেঁচিয়ে তুলে রাখতেন গাঞ্জিয়ায়। গরম কাঁথার নিচে শুতে না শুতেই ঘুম চলে আসত। মৃত্তিকাপাত্রে (আইল্লা) তুষ রেখে তুষের ওপর রাখতেন ঘুটের আগুন। কাঁথা ঠাণ্ডা হয়ে গেলে কাঁথার তলায় রাখতেন গরম আইল্লা। কাঁথা যতক্ষণ গরম না হতো ততক্ষণ কারো ঘুম আসত না। ঢাকা থেকে সি-বার্ড লঞ্চ আমাদের গ্রাম বরাবর পৌঁছত রাত ১টায়। সাহরির জন্য তখন রান্না চড়াতেন মা। শুতে যাওয়ার আগেই রান্নার সামগ্রী জোগাড় করে রাখতেন। কনকনে শীতে রান্নার সামগ্রীসহ পুরনো শাড়িকাপড় দু’ভাঁজ করে শরীরে জড়িয়ে মা পাকের ঘরে প্রবেশ করতেন। বাবার অজু করা ও খাওয়ার জন্য পানি গরম করাসহ রান্না শেষ করে যখন ঘরে ঢুকতেন তখন রাত ৩টা। সাহরি খাওয়া শেষ, আজান শুরু। রাখাল-লাঙল-গরু ঠিক করতে করতে নামাজ শেষ করে মাঠে রওনা হতেন বাবা। ভোরে আগুন জ্বালানোর জন্য আগের দিন খড়কুটো জড়ো করে রাখতাম। মাঝ উঠানে আগুন জ্বালতে না জ্বালতে মানুষ ভিড় করত চারপাশে। আগুনের সামনে দু’হাত মেলে ধরে গরম হাতের তালু চেপে ধরতেন কানে। বয়স্ক পুরুষরা একপ্রকার কানটুপি পরতেন। অনেকেই মাফলার ও গামছা দিয়ে মাথা ও কান বেঁধে রাখতেন। একপ্রকার মোটা সুতার তৈরি চাদর গায়ে জড়াতেন পুরুষরা আর মহিলারা গায়ে জড়াতেন দু’ভাঁজকৃত পুরনো শাড়ি। শহরে যাদের যাতায়াত ছিল সেসব পরিবারের গায়ে মহিলাদের চাদর দেখা যেত। শীতবস্ত্রের অভাবে জীর্ণ-বৃদ্ধ মানুষ মারা যাওয়ার সংবাদও মাঝে মাঝে আসত। যখন গোসল করতে যাই তখনো নদীর পানির ওপর কুয়াশা ভাসত। একসময় গামছা পরে চোখ বন্ধ করে দৌড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম পানিতে। কখনো কখনো কনকনে শীতের সাথে বইতো উত্তুরে ঠাণ্ডা হাওয়া। গরুর গায়ের পশম খাড়া হয়ে থাকত। অসুস্থ হয়ে পড়তো কোনো কোনো গরু। বাঁচানোর জন্য গরুর গা পাটের চট দিয়ে ঢেকে রাখা হতো।
গাঁয়ের তিন পাশে নদী। বর্ষার শেষদিকে নদীর বাঁকে বাঁকে সুবিধাজনক স্থানে গাছের ডাল ফেলতেন মাছ ব্যবসায়ীরা। কয়েক বিঘা স্থানজুড়ে ডালপালা ফেলে এর ওপর কচুরিপানা ইত্যাদি আটকিয়ে মাছের কৃত্রিম অভয়াশ্রয়ের নাম ‘ঝোপ’। বর্ষার পানি কমতে শুরু করলে নানা প্রকার মাছ আশ্রয় নেয় ঝোপে। শীত যত বাড়ে ঝোপের মাছ তত বাড়ে। হিমশীতল কনকনে শীতই ঝোপের মাছ ধরার উপযুক্ত সময়। ঝোপের চারদিকে জাল পাতা হয়। পোতা বাঁশে জালের ওপরের মাথা আটকিয়ে নিচের মাথা আটকাতে হয় মাটির সাথে। ১০-১৫ ফুট পানির নিচে নিরাপদ জাল বিছানোর কাজ করতে হয় রাতের বেলা ডুব দিয়ে দিয়ে। কোনো কোনো শীতে মহামারী আকারে দেখা দিত কলেরা। স্যালাইন তখনো শুরু হয়নি। কলেরায় আক্রান্ত হওয়ার অর্থ, মারা যাওয়া। তখনকার মানুষের বিশ্বাস – কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি ভয়ঙ্কর ব্যামো মানুষের বেশ ধারণ করে যার ওপর নজর দেয় সেই আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে ধুতি পরিহিত নারীর বেশ ধারণ করে এলাকায় ভর করে। কবিরাজকে গ্রামরক্ষার দায়িত্ব দিয়ে অন্ধকার হওয়ার আগেই ঘরে ঢুকে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়া হতো। এরপরও প্রতিদিন ভোরে কোনো না কোনো বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসত।
শীত এবং পৌষপার্বণ এক সাথেই শুরু হয়। পৌষপার্বণের ১২ প্রকারের পিঠার মধ্যে ভাপাপিঠার কথা ভুলতে পারছি না। হাইস্কুলে সোনারগাঁ অবস্থানকালে ভোরে নদীর পাড়ে হাঁটতে যেতাম। এক মহিলা ছোট ছোট ভাপাপিঠা বানিয়ে একআনা করে বিক্রি করত। সামান্য নারিকেল ও খেজুরের গুড় লাগানো ভাপাপিঠার স্বাদ জিহ্বায় লেগে রয়েছে। শীতকালের আরেক আকর্ষণ খেজুরের রস। পাশের গাঁ থেকে ভাঁড় বেয়ে এক লোক নিয়ে আসত খেজুরের রস। খেজুরের রসের খাঁটি গুড়ের শিরনি-পায়েস অতুলনীয়। যাদের জমি-জমা নেই; নিত্য এনে নিত্য খায়, কোনো কারণে হাতে কাজ না থাকলে তাদের কষ্টের সীমা-পরিসীমা থাকত না। ক্ষুধা কত বড় যন্ত্রণা যার জীবনে না আসে সে বুঝতেই পারে না। পঞ্চাশের দশকে আশ্বিনের ঝড়ে একবার মাঠের সব ধান ভেসে গিয়েছিল। কৃষির ওপর নির্ভরশীল এলাকা। জমি ধানশূন্য হয়ে পড়ায় শুরু হয় অভাব। ভাসিয়ে নেয়া ধানের জমিতে মাষকলাই বুনা হয়। আশাতীত পরিমাণে কলাই হয়। তখন মানুষকে চালের সাথে কলাই মিলিয়ে খেতে দেখেছি। রান্নার সময় খাবারের অপেক্ষায় চুলার পাড় বসে থাকলে ‘মুখ দিয়েছেন যিনি, আহার দেন তিনি’ মা এই কথাটি প্রায়ই বলতেন। উদাহরণ হিসেবে খলিফা হজরত ওমর রা:-এর কাহিনী শোনাতেন। ওমর রা: রাজ্যের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য রাতে একাকী বের হতেন। একরাতে ছদ্মবেশে বের হয়ে এক জায়গায় দেখেন এক মা চুলায় হাঁড়ি চড়িয়ে কান্না করছেন। পাশে ঘুমিয়ে রয়েছে দুই শিশুসন্তান। কাছে গিয়ে কান্নার কারণ জানতে গিয়ে জানতে পারেন, দুই শিশু ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে চুলায় হাঁড়ি চড়িয়ে শূন্য হাঁড়িতে আগুনের আঁচ দিতে শুরু করেন। ক্রন্দনরত শিশুদের এই বলে সান্ত¡না দেন যে, ‘রান্না হচ্ছে আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। অপেক্ষা করতে করতে দুই শিশুই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে খাবার চাইলে কী উত্তর দেবো? তাই কাঁদছি।’ এ কথা শোনার পর খলিফা ওমর রা: বিলম্ব না করে স্থান ত্যাগ করেন। মালখানা খুলে এক বস্তা আটা নিজে মাথায় করে নিয়ে যান মহিলার বাড়িতে। অসহায় মানুষ আর কনকনে শীতের কথা মনে পড়তেই সামনে চলে আসে গণমানুষের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা। কবি বলেন,
‘হে সূর্য! শীতের সূর্য!
হিমশীতল সুদীর্ঘ রাত তোমার প্রতীক্ষায়
আমরা থাকি…
সুকান্তের কবিতার মতো অবস্থা ছিল আমাদেরও। স্কুলজীবনে শীত-গ্রীষ্মের কারণসহ পরিচয় ঘটতে শুরু করে মেঘ, বৃষ্টি-ঝড় ইত্যাদির সাথে। পরিচয় হয় বাতাস ও এর উপাদান অক্সিজেন কার্বনের সাথে। অক্সিজেন ছাড়া কোনো প্রাণী বাঁচতে পারে না। উদ্ভিদেরও একান্ত প্রয়োজন কার্বন-ডাই-অক্সাইড। সাধারণ মানুষ অক্সিজেন ও কার্বনের বিষয় কোনো খবরই রাখে না। খবর শুরু হয় ঘোরতর করোনাকালে। জানতে পারে, সামান্য অক্সিজেনের জোগান দিতে বিশে^র দম বের হয়ে যাওয়ার অবস্থা। বিশ্বে প্রাণের উদ্ভব হয়েছিল ৩০০ কোটি বছর আগে। ধীরে ধীরে বৈচিত্র্যময় প্রাণীর বিস্তার। ৩০০ কোটি বছর ধরে লক্ষ-কোটি উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবশ্যকীয় গ্যাসের জোগান দিত কে? পড়েছিলাম যে, প্রাণী অক্সিজেন গ্রহণ করে আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে, উদ্ভিদ কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে আর অক্সিজেন ত্যাগ করে। একবারও জানতে চেষ্টা করিনি, উদ্ভিদ আর প্রাণীর মাঝে এই বিস্ময়কর সমন্বয়টা তৈরি করে দিলো কে? ‘গতির সূত্র এবং সর্বজনীন মহাকর্ষসূত্র নিউটনের সেরা দুটি আবিষ্কার হলেও এদের ব্যবহার সম্পর্কে তিনি সবসময় সতর্ক ছিলেন। এই তত্ত্বদ্বয়ের আশ্রয় নিয়ে মহাবিশ্বকে কেবলমাত্র একটি যন্ত্র আখ্যা দেয়া এবং একটি মহামহিম ঘড়ির নিয়ন্ত্রণে এর বিকাশকে ব্যাখ্যা করা – এমনতর ব্যবহারের ঘোরবিরোধী ছিলেন তিনি। এ সম্বন্ধে নিউটন বলেন, ‘অভিকর্ষ গ্রহসমূহের গতির বিষয়টি ব্যাখ্যা করে। কিন্তু এটি ব্যাখ্যা করতে পারে না, কে এগুলোকে গতিশীল হিসেবে নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করে দিলো? নিশ্চয়ই একজন আছেন, যিনি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন এবং যা কিছু ঘটছে বা যা কিছু ঘটা সম্ভব তার সবই তিনি জানেন।’ সব কিছু যার নিয়ন্ত্রণে সেই মহান কারিগরই প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণী, উদ্ভিদ এমনকি অণু-পরমাণুর মাঝেও পরস্পরের ব্যালান্স তৈরি করে দিয়েছেন। মহান কারিগরের সুশৃঙ্খল কাজ বিশৃঙ্খল করতে চাওয়ার পরিণামে -যা ঘটতে পারে : যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার ১৬টি দেশ থেকে তাদের সংস্করণ প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে এমন কতগুলো ঝুঁকিপূর্ণ শহরের কথা বলা হয়েছে যেগুলো হারিয়ে যেতে পারে যেকোনো মুহূর্তে। ঝুঁকিপূর্ণ শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে জাকার্তা, ব্যাংকক, ম্যানিলা, লাগোস, টোকিও, তেহরানসহ লন্ডন। প্রতিবেদনে প্রকাশ, প্রতি বছর ১০ ইঞ্চি করে ডুবছে জাকার্তা। এটা অশনিসঙ্কেত। সমুদ্রস্তর বাড়লেই বিপদ ম্যানিলার। সৌন্দর্যে ম্যানিলা এতটাই মনোমুগ্ধকর যে, প্রতি বছর ১০ লাখ পর্যটকের আগমন ঘটে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায়। এই শহরে রয়েছে চমৎকার হোটেল, বিপণিবিতান, বুটিক, সারিবাঁধা মল, খাবারের পসরা। এত সৌন্দর্যের আড়ালে এই শহরটি নিজকে হারাচ্ছে একটু একটু করে। প্রতি বছর ২০ সেন্টিমিটার করে ডুবে যাচ্ছে লাগোস। সুনামি হলেই ভেসে যেতে পারে ব্যস্ততম ও ব্যয়বহুল ইলেকট্রনিক পণ্যের আঁতুড়ঘর টেকসিটি টোকিও। অপরূপ তেহরান এমন একটি জায়গায় অবস্থিত যাকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও ত্রুটিপূর্ণ সীমা হিসেবে ধরা হয়। যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে অঘটন। ঝুঁকিতে সাংহাইও। উষ্ণতা ও পানির চাপে শহরটি প্রতি বছর একটু একটু ডুবছে। বরফ গলতে শুরু করলেই বিপদঘণ্টা বাজবে লন্ডনের। প্রতি বছর দেড় কোটি পর্যটক লন্ডনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসে। গত কয়েক যুগে যুক্তরাজ্যের দক্ষিণে চাপা থাকা স্কটল্যান্ড এখন জেগে উঠেছে। ফলে ডুবে যাচ্ছে ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলসহ লন্ডন। পত্রিকায় আরো প্রকাশ, উষ্ণতা বৃদ্ধির সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে এর মধ্যে প্রকাশ্যে আসা হুমকিগুলোকেই সামনে এনেছে আইপিসিসি। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সম্ভাব্য এমন আরো অনেক হুমকি আছে, যা মানুষের জানার বাইরে। ঘটনার ভয়াবহতা সম্পর্কে আইপিসিসি যে সীমারেখা টেনেছে, তাতে মানুষের পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রস্তুতি ব্যাহত হতে পারে। আমাদের অজান্তেই জলবায়ু পরিবর্তনের ঘূর্ণিপাকে হারিয়ে যেতে পারে পৃথিবীটা। দক্ষিণ মেরুতে যে গগনচুম্বী বরফের মহা আচ্ছাদন রয়েছে তা চৌদ্দ শ’ মাইল দৈর্ঘ্য ও কয় মাইল পুরু এর ইয়ত্তা নেই। অস্বাভাবিক উষ্ণতার দরুন যোজনব্যাপী তুষারের পর্বতসমূহ গলতে শুরু করবে। ধস নামবে বরফের চাঁইয়ে, হিমালয়ের মতো উচ্চ তরঙ্গরাশি চারদিক ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে। অনেক বিজ্ঞানীর মতে, ‘আমাদের পৃথিবীতে দ্বিতীয় মহাপ্লাবন অতি আসন্ন। পৃথিবীর অন্তত একাংশ যে ধ্বংস হবে তাতে সন্দেহ নেই।’ বিগত দশকের সুনামি, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস এমনকি বাংলাদেশে পদ্মার অস্বাভাবিক ভাঙনও প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবেরই আলামত বলে অনেকে মনে করেন।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক