সরজমিন রাতের পঙ্গু হাসপাতাল: ৫ ঘণ্টায় আসা রোগীদের শতভাগই বাইক দুর্ঘটনার

0

শুভ্র দেব॥ গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টা। ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে এসে থামে একটি এম্বুলেন্স। ভেতর থেকে ভেসে আসছে কান্নার সুর। চিৎকার করে কাঁদছিলেন ১৬ বছর বয়সী কিশোর আরিফুল ইসলাম জমাদ্দার। স্বজনরা জানান, আরিফ ১৬ই নভেম্বর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। তারপর থেকে তার ডান পা কাজ করছে না। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন ডান পা কেটে ফেলতে হবে। তাই বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে আনা হয়েছে। আরিফের স্বজন কবির হোসেন জানান, এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল আরিফ। ১৬ই নভেম্বর দুপুরের দিকে নোট আনতে মোটরসাইকেলে শিক্ষকের বাসায় যাচ্ছিল। তার ফুপাতো ভাই মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন। পেছনে বসেছিল আরিফ। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনাটি ঘটে। আরিফ ও তার ফুপাতো ভাই বোয়ালখালীর প্রধান সড়ক দিয়ে দ্রুত গতিতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় বাইপাস রাস্তা দিয়ে একটি ব্যাটারিচালিত গাড়ির সঙ্গে তাদের মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগে। মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে আরিফ। আরিফের ডান পায়ে মারাত্মক আঘাত লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে উদ্ধার করে নেয়া হয় যশোরে। সেখানকার একটি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বিমানে করে আনা হয় পঙ্গু হাসপাতালে (জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান)। কয়েক ঘণ্টার চিকিৎসা শেষে তাকে চিকিৎসকরা পাঠান নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানান তার ডান পা কেটে ফেলতে হবে। তারপর আমরা পপুলার হাসপাতাল থেকে শুরু করে ঢাকার নামিদামি একাধিক হাসপাতাল ঘুরেছি। সব হাসপাতালেই একই কথা বলেছেন চিকিৎসকরা। তাই পরিবারের সদস্যরা সিদ্ধান্ত নেন পঙ্গু হাসপাতালেই তার পা কাটাবেন। শুধু আরিফুল ইসলামই নন, দেশের বিভিন্ন স্থানে বেড়ে গেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা কবলিত এসব রোগী বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে এসে ভিড় করেন। হাসপাতালটির চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ড মাস্টার ও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ রোগী মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার। দুর্ঘটনা কবলিত বেশির ভাগ রোগীদের শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকে। যাদের অনেকের শরীরের পা ও হাত কেটে ফেলতে হয়। অনেকে মৃত্যুবরণ করেন। গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে ২টা পর্যন্ত হাসপাতালটিতে আসা রোগীদের শতভাগই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার।
সূত্র মতে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার যে সকল কারণ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বেপরোয়া ড্রাইভিং, গতির নেশা, চালকের অদক্ষতা, ফ্যান্টাসি। পঙ্গু হাসপাতালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় রোগীদের বেশির ভাগের বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। এর বাইরেও বিভিন্ন বয়সী রোগীরা রয়েছেন। সেটি তুলনামূলক কম। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের ব্যান্ডেজ করেন এমন এক কর্মচারী বলেন, বহু বছর ধরে হাসপাতালটিতে কাজ করছি। আগে সব ধরনের যানবাহনের দুর্ঘটনার রোগী সমানভাবে আসতো। কিন্তু ইদানীং সবচেয়ে বেশি রোগী আসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। বিশেষ করে রাতের বেলা ১০টা রোগী আসলে ৭ থেকে ৮টা রোগীই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার। রাত সাড়ে ১২টায় জরুরি বিভাগের সামনে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একটি এম্বুলেন্স আসে। রোগী সোহেল (৩৫) গত বুধবার রাত সাড়ে ৭টার দিকে কিশোরগঞ্জের নিকলিতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পড়েন। তার বড় ভাই শাহিন বলেন, এনজিও অফিসে চাকরি করেন সোহেল। অফিসের জরুরি কাজে ৭টার দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে নিকলি দিয়ে যাচ্ছিলেন। ওই রাস্তার একটি স্থানে ডিশের তার পড়েছিল। অন্ধকারের মধ্যে সোহেল তার দেখতে পায়নি। দ্রুত গতির মোটরসাইকেলটি তারের সঙ্গে লেগে দুর্ঘটনাটি ঘটে। ছিটকে রাস্তায় পড়ে সোহেলের দুটি পা ভেঙে যায়। ময়মনসিংহ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার পর তার অবস্থার অবনতি হয়। পরে চিকিৎসকরা তাকে পঙ্গু হাসপাতালে আনার পরামর্শ দেন। তাই তাকে এখানে নিয়ে এসেছি।
রাত ১টার দিকে পঙ্গু হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষের পাশের একটি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় শরীর ব্যথায় কাঁতরাচ্ছে ১৭ বছর বয়সী মো. মাসুদ। ঘণ্টাখানেক আগে মাসুদের ডান পা কেটে ফেলেছেন চিকিৎসকরা। কিন্তু মাসুদ তখনও বুঝে উঠতে পারেনি তার একটি পা নাই। মাসুদের চাচা নাসির উদ্দিন বলেন, মাসুদ ও তার ছোট ভাই মাসুম দু’জন মিলে মোটরসাইকেলে করে কুমিল্লার চান্দিনা এলাকার একটি বাজারে বালিশ কিনতে গিয়েছিলেন। বালিশ কিনে বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনাটি ঘটে। একটি বড় ট্রাকের সঙ্গে তাদের বহনকারী মোটরসাইকেলের সংঘর্ষ ঘটে। ট্রাকের পেছনের চাকার আঘাতে তারা দুই ভাই আহত হন। ছোট ভাই মাসুম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও মাসুদের অবস্থা গুরুতর। তাদেরকে উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে কুমিল্লা ট্রমা সেন্টারে নেয়া হয়। তারপর আনা হয় পঙ্গু হাসপাতালে। এখানে আনার পর মাসুদের অবস্থার অবনতি হলে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে। অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে নেয়া হয় জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে। সেখানকার চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে বলেন মাসুদের ডান পা কাজ করছে না। তাই দ্রুত সেটি কেটে ফেলতে হবে।
ওইদিন যশোর সদর হাসপাতাল থেকে পঙ্গু হাসপাতালে এসে ভর্তি হন নড়াইলের বাসিন্দা হুমায়ুন কবির (৩৬)। কৃষিজীবী কবির রাতের বেলা বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যে আলোবিহীন একটি নসিমন গাড়ির সঙ্গে তার মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগে। এতে করে মারাত্মকভাবে তিনি আহত হন। যশোর হাসপাতাল ঘুরে তাকে এনে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পঙ্গু হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার নজরুল বলেন, পঙ্গুতে চিকিৎসা নিতে আসা বেশির ভাগ রোগী মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টায় আসা রোগীদের ৮০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার। মূলত খামখেয়ালি, অসচেতনতা ও বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের জন্য এমনটা হচ্ছে। পঙ্গু হাসপাতালের এম্বুলেন্স চালক মো. জসিম বলেন, তিন বছর ধরে এম্বুলেন্স চালাই। এরমধ্যে বেশি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার রোগী বহন করেছি। ইদানীং আরও বেড়েছে। এ ধরনের রোগী বহন করা কষ্টকর। কারণ বেশির ভাগ রোগীর শারীরিক অবস্থা ক্রিটিক্যাল থাকে। রাস্তা দিয়ে আসার সময় সতর্ক থাকতে হয়। ওঠা-নামানোর সময়ও বেশি খেয়াল রাখতে হয়। জুয়েল মিয়া নামের আরেক চালক বলেন, প্রায় ৯ বছর ধরে পঙ্গু হাসপাতালের রোগীদের বহন করি। ট্রিপের অপেক্ষায় রাতের বেলা জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। সারা রাতই রোগী আসে। যাদের অধিকাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার। তিনি বলেন, গাড়ি চালানোর সময় আমরা প্রায়ই দেখি উঠতি বয়সী ছেলেরা দামি দামি মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়া ভাবে ছুটে চলে। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তারাই দুর্ঘটনায় পড়ে। তাই মোটরসাইকেল চালকদের আরও সচেতন হতে হবে।