সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ১১ বছরের সাজা

0

ণোকসমাজ ডেস্ক॥ প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ফারমার্স ব্যাংকের চার কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ১১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আইনজীবীরা বলছেন, আর্থিক কেলেঙ্কারিতে এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো প্রধান বিচারপতি সাজাপ্রাপ্ত হলেন। মানিলন্ডারিং আইনে সাত বছর কারাদণ্ড ও ৪৫ লাখ টাকা জরিমানা এবং অর্থ আত্মসাতের মামলায় চার বছর ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গতকাল ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম এই রায় ঘোষণা করেন। তবে রায়ে দুটি ধারায় সিনহাকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হলেও এই দণ্ড একসঙ্গে কার্যকর হবে। অর্থাৎ তাকে জেল খাটতে হবে ৭ বছর। এ ছাড়া এস কে সিনহার ৭৮ লাখ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। বিচারক শেখ নাজমুল আলম রায়ে বলেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড পাওয়া আসামিরা হলেন তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতি, ফারমার্স ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ক্রেডিটপ্রধান গাজী সালাহউদ্দিন, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীম, সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ভাইস প্রেসিডেন্ট লুৎফুল হক, গুলশান শাখার ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সফিউদ্দিন আসকারী, এস কে সিনহার কথিত পিএস রণজিৎ চন্দ্র সাহা ও রণজিতের স্ত্রী সান্ত্রী রায়। দুই ঋণগ্রহীতা খালাস: প্রায় চার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দণ্ডিত হলেও খালাস পেয়েছেন মূল দুই ঋণগ্রহীতা। তারা হলেন টাঙ্গাইলের মো. শাহজাহান এবং নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা। এ দু’জনের নামেই মূলত চার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন হয় ফারমার্স ব্যাংক থেকে। রায়ে এ দু’জনের খালাস পাওয়ার বিষয়ে দুদক কৌঁসুলি মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, এখানে তাদের ভিক্টিমাইজ করা হয়েছিল। এই মামলায় তারা কোর্টে এসে স্বীকার করেছেন, আমরা কিছুই জানতাম না। আমাদের শুধু ব্যাংকে গিয়ে কতগুলো কাগজে সই করতে হয়েছে। এই অ্যাকাউন্টে কীভাবে টাকা এলো এবং সেই অ্যাকাউন্ট থেকে কীভাবে সাবেক প্রধান বিচারপতির অ্যাকাউন্টে টাকা গেল, পে-অর্ডারের টাকা কোথায় গেল, সে বিষয়ে তারা কিছুই জানতো না। ১৮২ পৃষ্ঠার রায়: রায়ে অর্থ পাচারের দায়ে সিনহাকে ৭ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে ৪৫ লাখ টাকা। সেই সঙ্গে অর্থ আত্মসাতের দায়ে ৪ বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সাজা চলবে একসঙ্গে। ফলে সিনহাকে কারাগারে থাকতে হবে ৭ বছর। ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক এমডি এ কে এম শামীমকে চার বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল হক চিশতী (বাবুল চিশতী), রণজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায়কে তিন বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. লুৎফুল হক, সাবেক এসইভিপি গাজী সালাহউদ্দিন ও ফারমার্স ব্যাংকের ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সাফিউদ্দিন আসকারীকে তিন বছর কারাদণ্ড ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় টাঙ্গাইলের বাসিন্দা মো. শাহজাহান ও একই এলাকার বাসিন্দা নিরঞ্জন চন্দ্র সাহাকে খালাস দেয়া হয়েছে।
রায় ঘোষণার পর দুদকের আইনজীবী মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। অপরাধী যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, যদি অপরাধ প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে সাজা ভোগ করতে হবে। এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। তবে আসামি চিশতী ও লুৎফুলের আইনজীবী শাহিনুর রহমান অসন্তুষ্ট। তিনি বলেন, চিশতী ও লুৎফুলের যে সাজা দেয়া হয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই। এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবো।
এর আগে বেলা ১১টার দিকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক শেখ নাজমুল আলমের আদালতে আলোচিত মামলাটির রায় পড়া শুরু হয়। রায় উপলক্ষে আদালত চত্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি বাড়ানো হয়। তার আগে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মামলার অন্যতম আসামি ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেডের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতিকে (বাবুল চিশতি) কাশিমপুর কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে আনা হয়। আদালতে উপস্থিত হন জামিনে থাকা ছয় আসামি। সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, সাফিউদ্দিন আসকারী, রণজিৎ চন্দ্র সাহা ও তার স্ত্রী সান্ত্রী রায় পলাতক রয়েছেন। নথি থেকে জানা যায়, গত ১৪ই সেপ্টেম্বর এই মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও আসামি পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনানি শেষ হয়। পরে রায় ঘোষণার জন্য ৫ই অক্টোবর তারিখ ধার্য করা হয়। কিন্তু বিচারক শেখ নাজমুল আলম ছুটিতে থাকায় সেদিন মামলার রায় ঘোষণা করা হয়নি। ৫ই অক্টোবর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক মোহাম্মদ আলী হোসাইন রায় ঘোষণার জন্য ২১শে অক্টোবর ধার্য করেন। সেদিন রায় ঘোষণার জন্য ৯ই নভেম্বর তারিখ ধার্য করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম। সে অনুযায়ী গতকাল রায় ঘোষিত হয়। এই মামলায় দুদকের পক্ষ থেকে ২১ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়। গত ২৪শে আগস্ট মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। ২০১৯ সালের ৯ই ডিসেম্বর এস কে সিনহাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় দুদক। গত বছরের ১৩ই আগস্ট এস কে সিনহাসহ ১১ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
সূত্র জানায়, সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের আলীনগর ইউনিয়নের তিলকপুর গ্রামে। তার জন্ম ১৯৫১ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি। ১৯৭৪ সালে সিলেট বারে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর ১৯৭৮ সালে হাইকোর্টে এবং ১৯৯০ সালে আপিল বিভাগে তালিকাভুক্ত হন এস কে সিনহা। হাইকোর্টে তিনি বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান ১৯৯৯ সালের ২৪শে অক্টোবর। আপিল বিভাগে আসেন ২০০৯ সালের ১৬ই জুলাই। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আপিল বিভাগের যে বেঞ্চ বাতিল করেছিল, এস কে সিনহা ছিলেন তার অন্যতম সদস্য। এ ছাড়া ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় দেয়া বেঞ্চেও সদস্য ছিলেন তিনি। আপিল বিভাগে আসার ছয় বছর পর ২০১৫ সালের ১৭ই জানুয়ারি দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন এস কে সিনহা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে ২২ জন বিচারক প্রধান বিচারপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাই প্রথম প্রধান বিচারপতি যার দায়িত্বের অবসান হয় পদত্যাগের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম সাবেক প্রধান বিচারপতি, দুর্নীতির দায়ে যার ১১ বছরের সাজার রায় হলো। ২০১৫ সালের ১৭ই জানুয়ারি দেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন এস কে সিনহা। বয়স অনুযায়ী ২০১৮ সালের ৩১শে জানুয়ারি তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নজিরবিহীন এক পরিস্থিতির মধ্যে তার কার্যকাল শেষ হয় মেয়াদের ৮১ দিন আগেই। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের তোপের মুখে বিদেশে যান ২০১৭ সালের ১১ই নভেম্বর এবং সেখানে যাওয়ার পর পদত্যাগপত্র পাঠান। ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ পাওয়ার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আসা বিচারপতি সিনহা যুক্তরাষ্ট্রে বসেই ২০১৮ সালে একটি বই প্রকাশ করেন। তাতে তিনি দাবি করেন, তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে।