স্কুল শিক্ষার্থীদের টিকাদান শুরুতেই অব্যবস্থাপনা

0

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ॥ অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েই দেশে শুরু হয়েছে স্কুল শিক্ষার্থীদের গণটিকাদান কার্যক্রম। গতকাল প্রথম দিনই রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষার্থীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে টিকা নিতে হয়েছে। টিকা নিতে এসে চরম ভোগান্তিতে পড়ে এসব শিশু। কেউ কেউ আড়াই থেকে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত দীর্ঘ লাইনে টিকার জন্য অপেক্ষা করছিল। একজনের সঙ্গে অন্যজন গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল টিকা নিতে আসা স্কুল শিশুরা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধিও ছিল চরম উপেক্ষিত। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ১ থেকে ৩ নম্বর বুথে টিকা দেয়ার কোনো সিরিঞ্জও ছিল না। পরে একজন নার্স অন্য বুথ থেকে অল্প কিছু সিরিঞ্জ ধার করে নিয়ে এসে কার্যক্রম কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে চালাচ্ছিলেন। তখনো কক্ষের বাইরে টিকার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েছিল শিশুরা। একটি কেন্দ্রে ২৫টি বুথে টিকা দেয়ার কথা থাকলেও গতকাল দেয়া হয়েছে মাত্র ১০টি বুথে। এসময়ে টিকাদানকারী কয়েকজন নার্স জানান, স্কুল কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার জন্য এরকম খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রথম দিন ২ হাজার শিক্ষার্থীর টিকা দেয়ার কথা থাকলেও তারচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী চলে এসেছে। এজন্য এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে সোমবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে এ কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ফাইজারের টিকা দেয়া হয় প্রথম দিন। সকালে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
কেন্দ্রটিতে করোনার প্রথম টিকা নিয়েছে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী তাহসান হোসেন ও মাহজাবিন তমা। তারা দুজনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাদের ফাইজারের টিকা দেয়া হয়। টিকা নেয়া শেষে নির্ধারিত বিশ্রামকক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছিল তাহসান। সে বলে, টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে একটু দ্বিধা লাগছিল। পরে দ্বিধা কেটে যায়। আমি অনেক ভাগ্যবান। করোনার ভয়টা আমার মধ্যে আর থাকবে না। আমার বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আমিই প্রথম টিকা নিলাম। আমি সহপাঠী শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানাচ্ছি, তারাও যাতে এ টিকা নেয়। তাহসানের বাবা মোহাম্মদ মোফাজ্জেল হোসেন আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক। তিনি বলেন, এই টিকা কর্মসূচি সফল করতে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সহায়তা দরকার। শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করোনার টিকা নিলে তারা নিরাপদ থাকবে। একই সময় টিকা নেয় আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহজাবিন তমা। তার বাসা শাজাহানপুরে। তমা গণমাধ্যমকে বলেন, প্রথমে একটু ভয় ভয় লাগছিল। টিকা নিতে পেরে আনন্দিত।
সরজমিন বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে স্কুলের ৫ম তলায় ৫০৩ নম্বর কক্ষে দেখা যায়, ৩টি বুথে নার্সরা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। ওই সময়ে টিকা দেয়ার কোনো সিরিঞ্জ ছিল না তাদের হাতে। তখনো বাইরে শত শত শিক্ষার্থী দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েছিল টিকার অপেক্ষায়। ২ নম্বর বুথে তখন পর্যন্ত ১৮০ জন টিকা গ্রহণ করে। এসব বুথের নার্সরা জানান, চরম অব্যবস্থাপনা। খুব খারাপ অবস্থা। এটা স্কুল কর্তৃপক্ষের জন্য হয়েছে। প্রথমদিন এতো শিক্ষার্থীদের আনা উচিত হয়নি। টিকা দেয়ার সিরিঞ্জ শেষ। পরে দেখা যায়, একজন নার্স অন্য কোনো বুথ থেকে হাতে করে অল্প কিছু সিরিঞ্জ এনে টিকাদান কার্যক্রম কোন রকম জোড়াতালি দিয়ে চালাচ্ছিলেন। কেন্দ্রটিতে সোয়া ৩টার দিকে কথা হয় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাহাদের সঙ্গে। সে জানায়, দীর্ঘ ২ ঘণ্টার বেশি সময় লাইনে অপেক্ষা করে টিকা নিয়েছে। ভোগান্তি হয়েছে। একই কথা বলেছে টিকাগ্রহণকারী অষ্টম শ্রেণির ছাত্র শামীম ইয়াসারও।
এ বিষয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অক্ষ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম মানবজমিনকে বলেন, প্রথম দিন ২ হাজার শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার কথা ছিল। এজন্য ১০টি বুথ বসানো হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা একজন আরেকজন বন্ধুকে বলে বেশি করে নিয়ে আসে। এতে সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। প্রথম দিন সাড়ে ১১টায় টিকা কার্যক্রম শুরু হয়। আজ থেকে ১২টি বুথে টিকা দেয়ার কথা জানান তিনি। একদিন ছেলে এবং পরের দিন মেয়ে শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া হবে তার কেন্দ্রে। ড. শাহান আরা বেগম আরও জানান, ২৫টি বুথ নয়, তার স্কুল কেন্দ্রে ১২টি বুথে টিকা দেয়া হবে। অন্যকেন্দ্রেও ১০টি বুথে টিকা দেয়া হবে বলে তিনি জানতে পেরেছেন।
১২ বছরের কম বয়সীদের এখনই টিকা নয়: গতকাল রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষার্থীদের টিকা কর্মসূচি উদ্বোধনকালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, এখনই ১২ বছরের কম বয়সীদের টিকা দেয়া হবে না। ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের করোনাভাইরাসের টিকা পাচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, পর্যায়ক্রমে সারা দেশে এ কার্যক্রম শুরু করা হবে। আপাতত রাজধানীর আটটি স্কুলকে টিকাদান কার্যক্রমের জন্য ক্লাস্টার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ আট কেন্দ্রে প্রতিদিন ৫ হাজার করে ৪০ হাজার শিশুকে টিকা দেয়া হবে। সেই হিসাবে একটি কেন্দ্রে দৈনিক ৫ হাজার শিশুকে দেয়া হবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে কোনো সংকট নেই। তাদের ফাইজারের টিকা দেয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এ টিকার ৯৬ লাখ ডোজ আমরা হাতে পেয়েছি। এর মধ্যে ১৪ লাখ ডোজ দেয়া হয়েছে। হাতে থাকা ৮২ লাখ ডোজ শিক্ষার্থীদের দেয়া হবে। আরও বেশকিছু টিকা পাইপলাইনে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, তারা আগামীতে ফাইজার ও মডার্নার টিকা দেবে। সেগুলো দিয়ে পর্যায়ক্রমে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের শিশুদেরও টিকা দেয়া হবে। সারা দেশের সব শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার জন্য তিন কোটি ডোজ টিকা প্রয়োজন হবে। এসময় সাংবাদিকদের করা এক প্রশ্নের জবাবে জাহিদ মালেক বলেন, ফাইজারের টিকা সংরক্ষণের জটিলতা কেটেছে। আগের তুলনায় দ্বিগুণ আল্ট্রা লো ফ্রিজার (অতি সংবেদনশীল) আছে। তাই, গ্রামেও দিতে পারবো বলে আমরা বিশ্বাস করি। তাই, সবার টিকার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তবে, ১২ বছরের কম বয়সীদের এখনই টিকা নয় বলেও জানান মন্ত্রী। টিকা প্রয়োগের পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে বলে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা প্রতিদিন যে ৫ থেকে ৬ লাখ টিকা দেই, সেটিকে ১০ লাখে উন্নীত করার কাজ চলমান আছে। অল্প দিনেই তা শুরু হয়ে যাবে। জাহিদ মালেক বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় ২১ কোটি টিকা ক্রয় করেছি। এই টিকা কিনতে হাজার হাজার কোটি টাকা লেগেছে। আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমেও টিকা পেয়ে যাচ্ছি। সেখানেও প্রায় ৭ কোটি টিকার প্রতিশ্রুতি আছে। কাজেই টিকার অভাব হবে না। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, তোমরা টিকা পেয়ে যাবে, পড়াশোনায় মনোযোগী হও। স্কুলে আসো, কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মাস্ক পরতে হবে। সংক্রমণ কিন্তু টিকা রোধ করতে পারে না।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ছাড়াও স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. লোকমান হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুব হোসেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার প্রমুখ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে রাজধানীর আটটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করা হয়েছে। আজ শুধু আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে টিকা দেয়া হচ্ছে। আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে টিকা দেয়া হবে হার্ডকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, সাউথ পয়েন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, চিটাগাং গ্রামার স্কুল, আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, কাকলী স্কুল, মিরপুর কমার্স কলেজ, স্কলাস্টিকা (মিরপুর) ও সাউথ ব্রিজ স্কুলে। প্রাথমিকভাবে নির্ধারিত আটটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরও টিকা দেয়া হবে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে ২২টি জেলায় স্কুলশিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। শিগগিরই এসব জেলায় টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব জেলায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া হবে।
গত রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ও ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির সদস্য সচিব শামসুল হক এক অনলাইন বুলেটিনে বলেন, শিক্ষার্থীদের দেয়া হবে ফাইজারের টিকা। এই টিকা শীততাপনিয়ন্ত্রিত বুথে দিতে হয়। প্রতি স্কুলে ২৫টি করে বুথ থাকবে। এসব বুথে দিনে ৪ থেকে ৫ হাজার শিশুকে টিকা দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। শামসুল হক বলেন, নিবন্ধন ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী টিকা নিতে পারবে না। টিকা নেয়ার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের নামের তালিকা ও জন্মনিবন্ধন নম্বর আইসিটি বিভাগে পাঠাবে। আইসিটি বিভাগ সেটি যাচাই করে সুরক্ষা অ্যাপে দেবে। সুরক্ষা অ্যাপের মাধ্যমে স্কুল কর্তৃপক্ষ বা শিক্ষার্থীর অভিভাবকেরা টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন। টিকা নেয়ার সময় শিক্ষার্থীদের টিকা কার্ড ও জন্মনিবন্ধন সনদের ফটোকপি সঙ্গে আনতে হবে। স্কুলে টিকা কার্যক্রম চলাকালে সেখানে চিকিৎসক থাকবেন। যেসব স্কুল ও কলেজে টিকা দেয়া হবে, সেখানে অভিভাবকদের ভিড় না করার অনুরোধ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, এর আগে গত ১৪ই অক্টোবর মানিকগঞ্জে পরীক্ষামূলকভাবে ১২০ শিক্ষার্থীকে ফাইজারের টিকা দেয়া হয়। টিকা নেয়া শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হয়নি। পরবর্তী সময়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে সারা দেশের শিক্ষার্থীদের (১২ থেকে ১৭ বছর) টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।