কয়রায় এ বছরের বাঁধ সংস্কার নিয়েও স্থানীয়দের শঙ্কা

0

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা ॥ খুলনার কয়রা উপজেলায় প্রতি বছর বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় বাড়ি-ঘর, ফসলি জমি ও মাছের ঘের। এ অঞ্চলের মানুষ ত্রাণ চায় না, চায় টেকসই বেড়িবাঁধ। বেড়িবাঁধ নির্মাণ বা সংস্কারের জন্য প্রতি বছর বরাদ্দ আসে বিপুল পরিমাণ টাকা। কিন্ত বরাদ্দের সিংহভাগ টাকা লোপাট হয়ে যায়। উপজেলার ৪৩টি স্থানে জরুরি বাঁধ সংস্কারের সাড়ে ১০ কোটি টাকার কাজে এমনই দুর্নীতি চলছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ‘আপৎকালীন সময়ে জরুরি বাঁধ মেরামত’ প্রকল্পের আওতায় দরপত্র ছাড়াই ডিরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড (ডিপিএম) পদ্ধতিতে উপজেলার ৪৩টি স্থানে কাজ চলমান রয়েছে। এ পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধে মাটির কাজসহ জিও ব্যাগ ডাম্পিং ও প্লেসিং করা হবে। নিয়ম অনুযায়ী দক্ষ এবং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এসব কাজ করিয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)কর্মকর্তারা কাগজে কলমে কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম লিখে রাখলেও বাস্তবে নিজেদের পছন্দের শ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিল্লাল হোসেন নামে একজন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বলেন, ‘টেন্ডারবিহীন কাজগুলো পাউবো’র স্থানীয় কর্মকর্তারা সাবকন্ট্রাক্টের মাধ্যমে করিয়ে নিচ্ছেন। এলাকার শ্রমিকদের সাথে চুক্তিভিত্তিক কাজ শেষে পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে বিল তুলে নেয় তারা। এতে উভয়ই আর্থিকভাবে লাভবান হয়। মাঝখান থেকে সরকারি বরাদ্দ অপব্যবহারের ফল ভোগ করি আমরাই।’ সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার গোবিন্দপুর নামক স্থানে ১৫০ মিটার বাঁধ সংস্কার কাজে আফজাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি এক্সকেভেটরের সাহায্যে মূল বাঁধের ঢালে মাটি কেটে উচ্চতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন। এতে ভাঙনের ঝুঁকি আরও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় স্থানীয় লোকজন কাজ বন্ধ করে দিলেও পাউবো কর্মকর্তারা ফের কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছেন তাকে। আফজাল হোসেন বলেন, ‘কার লাইসেন্সের কাজ তা জানিনা। আমি নগদ তিন লাখ টাকায় কাজটি কিনে নিয়েছি।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯ লাখ ৪১ হাজার টাকা বরাদ্দের এ কাজটি মেসার্স জিয়াউল ট্রেডার্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। উপজেলায় ১৪/১ নম্বর পোল্ডারে জোড়শিং এলাকায় দুই গ্রুপে ৫৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা ব্যয়ে ৬শ মিটার বাঁধ সংস্কারসহ অস্থায়ী ঢাল সংরক্ষণ কাজ চলছে। দুটি কাজই করছেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মোজাফ্ফার হোসেন। তালিকা অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রানা এন্টারপ্রাইজের নাম রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এস,এম শফিকুল ইসলাম ওই কাজ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তিনি বলেন, ‘যতদুর জানি পাউবো’র তত্ত্বাবধানে এ মুহূর্তে যেসব কাজ চলমান রয়েছে তার কোনটিই টেন্ডারে ওঠেনি। অফিস থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে।’ দেখা গেছে, ১৩-১৪/২ নম্বর পোল্ডারের শাকবাড়িয়া ও চৌকুনি নামক স্থানে ৯০ মিটার বাঁধ সংস্কারসহ জিও ব্যাগ ডাম্পিং ও প্লেসিং এবং ৭০০ মিটার মাটির কাজে কে,এম মনিরুজ্জামান নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম রয়েছে। প্রায় ৩৪ লাখ টাকা বরাদ্দের এ কাজ দুটি করেছেন সোলায়মান নামে একজন শ্রমিক সরদার। তিনি পাউবো কর্মকর্তাদের নির্দেশে কাজ করেছেন বলে জানিয়েছেন। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক মনিরুজ্জামান মনি বলেন, ‘আমি কখনই পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ করিনি। আমি মূলত এলজিইডির কাজ করে থাকি। আমার প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার কেন করা হয়েছে এ ব্যাপারে জানতে চাইবো।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, কাজগুলো বাস্তবায়ন করছে পাউবো’র স্থানীয় কর্মকর্তারা। সেক্ষেত্রে দাফতরিক প্রক্রিয়া ঠিক রাখতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। জানা গেছে, পাউবো’র একজন উপসহকারী প্রকৌশলী ও উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ভাগাভাগি করে তাদের পছন্দের লোকজন দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। দেখা গেছে, কাজের নকশা ও প্রাক্বলন ব্যয় অনুযায়ী প্রতিটি কাজে দ্বিগুণ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এতে বরাদ্দের অর্ধেক অর্থ আত্মসাতের সুযোগ আগে থেকেই করে রেখেছেন তারা। আবার বরাদ্দের অর্ধেক দামে কাজ কিনে স্থানীয় শ্রমিক সরদাররা লাভের আশায় নি¤œমানের কাজ করে যাচ্ছেন। ফলে অনেক স্থানে কাজ শেষ হতে না হতেই ধসে পড়তে দেখা গেছে। তাছাড়া ডাম্পিংয়ের জিও ব্যাগগুলো বাঁধের ওপর বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কয়েকটি স্থানে দেখা গেছে, ব্যাগের অর্ধেকেরও কম বালু ভরে বাঁধের ঢালে প্লেসিং করায় তা নদীতে চলে গেছে। জানতে চাইলে পাউবো সেকশান কর্মকর্তা (এসও) মশিউল আবেদীন বলেন, জরুরি ভিত্তিতে এ কাজগুলো করা হয়ে থাকে। পরে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে বিল করা হয়। ঠিকাদারের সম্মতিতে এভাবে কাজ করা হয় বলে দাবি করেন তিনি। নি¤œমানের কাজ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে যতটুকু কাজ করবে তাকে ততটুকু কাজের বিল দেওয়া হবে। পাউবো কয়রা উপজেলার আমাদি কার্যালয়ের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী খলিলুর রহমান বলেন, বাঁধ সংস্কার কাজে ঠিকাদার লেবার দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। আমরা তা তদারকি করছি। পাউবো সাতক্ষীরা-২ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুর রহমান বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই কাজ করা হচ্ছে। যদি কোনো ঠিকাদার অস্বীকার করে সেটা তার ব্যাপার। এখানে পাউবোর কোনো কর্মকর্তার কাজের পার্টনার হওয়ার সুযোগ নেই।’