বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তায় কোয়াড-আইপিএস’র বিকল্প খুঁজছে বাংলাদেশ

0

মিজানুর রহমান॥ শান্তিপূর্ণভাবে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পর থেকে অধিকৃত বঙ্গোপসাগরের সম্পদ আহরণ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বহুমুখী উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ। বন্ধু ও উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে সহজে এ সংক্রান্ত প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তা সহায়তা পেতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে ঢাকা। পেশাদার কূটনীতিকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়া থেকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রবেশমুখে থাকা বঙ্গোপসাগরের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের কারণে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো একান্তভাবে বাংলাদেশকে পাশে পেতে চাইছে। আর এটিই এখন ঢাকার সবচেয়ে বড় মাথা ব্যথার কারণ। ক’বছর ধরে পর্দার আড়ালে এ নিয়ে রীতিমতো টানাহেঁচড়া চলছে। তবে বাংলাদেশ এখনো তার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে দাবি করে সরকারের বিদেশনীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা বলছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ বিকল্প কিছু নিয়ে ভাবছে। সেটি হতে পারে স্বতন্ত্র ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি। পূর্ব ও পশ্চিমের বন্ধু রাষ্ট্র এবং উন্নয়ন সহযোগীদের প্রণীত এ সংক্রান্ত নীতি, পলিসি ও উদ্যোগের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ওই স্বতন্ত্র নীতি প্রণয়নের কথা ভাবছে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সম্প্রতি বলেন, ইন্দো প্যাসিফিক-এর আলোচনা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ আমরা বঙ্গোপসাগরের একটি অংশ। সুতরাং যে ধাঁচেই হোক, আমাদেরকে সম্পৃক্ত হতে হবে। এই অঞ্চলে বড় কিছু হলে সেখানে আমাদের অংশীদারিত্ব থাকবে। আমাদের বিবেচনায় অর্থনীতি সবার আগে। যত দ্রুত সম্ভব আমরা এ বিষয়ে আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করবো। জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশ ও জোটের সঙ্গে আলোচনায় ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে তাদের চিন্তা সম্পর্কে জানাবোঝার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ বৃটেনের সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, সেখানে নানা বিষয় এসেছে। সমুদ্রপথে সকলের অবাধ চলাচলের অধিকার, শান্তি, জলদস্যুমুক্ত সমুদ্র এবং যার যার অধিকারে থাকা এলাকা থেকে মৎস্য ও সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ নির্বিঘœ করার বিষয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু এটা বিবেচ্য যে মুখোমুখি অবস্থানে থাকা কোনো নিরাপত্তা জোটে বাংলাদেশ সম্পৃক্ত হবে না। পরস্পর বিরোধী অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলো কী আচরণ করছে বাংলাদেশ ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণে রাখছে জানিয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, গত ২০ বছরে চীনের সঙ্গে ইউরোপের ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। ফলে এখন চাইলেই তারা চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সব নীতি পলিসিকে সমর্থন দিতে পারবে না। ইইউ’র সেই অবস্থান বাংলাদেশের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের অনুপ্রেরণা হতে পারে বলে মনে করেন ওই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে থাকা বাংলাদেশের সামনে এমন পরিস্থিতি নতুন নয়। হয়তো আজ সময়ের পরিক্রমায় কোয়াড, আইপিএস এবং ওবোর নামীয় বৈশ্বিক জোটগুলোর আলোচনা সামনে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-জাপান-অস্ট্রেলিয়া চতুর্দেশীয় নিরাপত্তা জোট কোয়াডে বাংলাদেশ যোগ দেয়ার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেই। এ নিয়ে খুব একটা আলোচনাও হয়নি। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই যেন বাংলাদেশ ওই জোটের দিকে না ঝুঁকে তা নিশ্চিত করতে আগেভাগেই ঢাকায় ছুটে আসেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়েই ফেঙ্গি। বাংলাদেশের নেতৃত্বকে তিনি কোয়াডের বিষয়ে আগাম সতর্ক করে যান। কিন্তু সেটি ছিল পর্দার আড়ালে। বিপত্তি ঘটে যখন রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। মে মাসে ঢাকায় কূটনৈতিক রিপোর্টারদের সঙ্গে এক ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে তিনি অনেকটা হুমকির সুরে বলেন, এমন জোটে গেলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রাষ্ট্রদূতের ওই বক্তব্যের পাল্টা প্রতিক্রিয়া আসে নানা জায়গা থেকে। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে বাংলাদেশ। বায়বীয় ইস্যুতে বাকযুদ্ধ থামাতে দেশগুলোর প্রতি অনুরোধের প্রেক্ষিতে বিতর্ক ছাইচাপা পড়ে। কিন্তু এটি এখনো পুরোপুরি থামেনি। সেগুনবাগিচা বলছে, বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক বা ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় জোটের সেন্টার পিস বা কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোটি কোটি ডলারের প্রস্তাবনায় সাজানো ওই জোটে অংশগ্রহণের অনুরোধ এখনো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ এতে আরও সময় নিতে চায়। যদিও প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের আমল থেকে নব প্রতিষ্ঠিত বাইডেন প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি এ নিয়ে ঢাকার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো ওই জোটে সম্পৃক্ততার স্পষ্ট কোনো ঘোষণা দেয়নি। বিশেষ করে মিলিটারি অংশে। তবে ঢাকার দায়িত্বশীল সূত্র দু’দিন আগেও এটা স্পষ্ট করেছে যে, আইপিএস’র সামরিক পার্টে বাংলাদেশের যোগদানের সম্ভাবনা একেবারে নেই বলেই চলে। ওই জোটের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিনা শর্তে যদি সম্পৃক্ততার কোনো সুযোগ থাকে তা অবশ্যই বাংলাদেশ গ্রহণ করবে। সূত্র বলছে- ইন্দো-প্যাসিফিক (আইপিএস) এ বাংলাদেশ যুক্ত হচ্ছে না এমনটা নয়। আবার যুক্ত হচ্ছে তা-ও নয়। অর্থাৎ ইন্দো- প্যাসিফিকের বেসামরিক পার্টে বেশ সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত হতে আগ্রহ দেখিয়ে ওয়াশিংটনের কাছে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে ঢাকা। তবে ওই জোটের যে সম্ভাব্য মিলিটারি কম্পোন্যান্ট বা সিকিউরিটি কম্পোন্যান্ট রয়েছে তা থেকে দূরে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। ওই অংশটি চীনকে কন্টেইন করার জন্য তৈরি করা হয়েছে উল্লেখ করে এক কর্মকর্তা বলেন, সরাসরি চীনকে অ্যান্টাগোনাইজ করার মতো সামর্থ্য বাংলাদেশের এখনো নেই। আইপিএস এবং কোয়াড উভয় উদ্যোগ চীনকে ঠেকানোর জন্য গৃহীত মন্তব্য করে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমাদেরকে মাঝামাঝি থাকতে হবে। এক দেশের বিরুদ্ধে অন্য দেশের কোনো জোটে যোগদান আমাদের জন্য অশান্তির কারণ হবে। কোয়াড বা আইপিএস-এ পুরোপুরি যোগ না দিলে যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা তো তাদের বিরুদ্ধে চীনের সামরিক কোনো জোটে যাচ্ছি না। তাছাড়া ভারতের বিরুদ্ধেও তো আমরা কোনো কিছু ভাবছি না। আমরা আমাদের নিয়ে ভাবছি। এখানে আমাদের দেশের স্বার্থ মুখ্য। তাহলে তারা রুষ্ট হবে কেন?