স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ নিশ্চিত করতে হবে

0

কঠোর লকডাউনেও দেশে করোনা সংক্রমণ কমেনি। লকডাউনে তিন সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে। ঈদের পরের দিন থেকে আরোপিত কঠোর লকডাউন কিছুটা শিথিল করে গার্মেন্ট কারখানাসহ কিছু রফতানিমখী শিল্প কারখানা চালু রাখা হয়েছিল। কোটি কোটি কর্মহীন-দরিদ্র মানুষের অবস্থা বিবেচনায় আজ থেকে লকডাউন তুলে দিয়ে সবকিছু খুলে দিতে বিধিনিষেধ শিথিল সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে সরকার। যখন লতডাউনের মধ্যেও করোনা সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে, তখন বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে সবকিছু খুলে দেয়ার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। ইতিপূর্বেও ঈদের আগে বিধিনিষেধ শিথিলে পেন্ডেমিক বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় পরামর্শক কমিটির নির্দেশনাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। গত কয়েকদিনে নমুনা পরীক্ষা কমিয়ে আনা হলেও সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর সংখ্যায় তেমন হেরফের হয়নি। এ যাবৎ গড় শনাক্তের হার ১৬-১৭ ভাগ হলেও গত ২ সপ্তাহ ধরে তা তিরিশভাগের কাছকাছি উঠানামা করছে। শনাক্তের শতকরা প্রায় ৯০ ভাগই উচ্চ সংক্রমণশীল ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়েন্টের। ঢাকার হাসপাতালগুলোতে শয্যা, আইসোলেশন, আইসিইউ এবং হাইফ্লো-নাজাল অক্সিজেন ক্যানোলার সংকট দেখা দিয়েছে। এখন গণপরিবহনসহ সব অফিস আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ফলে করোনা অতিমারী নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
একটি বৈশ্বিক মহামারীর লড়াইয়ে বাংলাদেশ নানাভাবে পিছিয়ে পড়ছে। করোনা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার উদ্যোগ কতটা কাজে আসবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো যখন অধিকাংশ নাগরিকের করোনা ভ্যাক্সিন নিশ্চিত করার পরও সবকিছু খুলে দিতে ভয় পাচ্ছে, তখন বাংলাদেশে সংক্রমণের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার মধ্যেই সবকিছু খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। ইতিপূর্বে বিধিনিষেধ শিথিল ও গণপরিবহন চলার ক্ষেত্রে যে সব কৌশল অবলম্বন করা হয়েছিল এখন তা দেখা যাচ্ছে না। অর্ধেক সিট খালি রেখে গণপরিবহন চালু রাখার বদলে অর্ধেক পরিবহন চালু রাখার ব্যবস্থার যৌক্তিকতা ও তা নিয়ন্ত্রণের অনিশ্চয়তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমনিতেই ঢাকায় গণপরিবহণের সংকট রয়েছে। পরিবহণের অভাবে বাসস্ট্যান্ডগুলোতে শত শত কর্মজীবী মানুষকে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এহেন বাস্তবতায় সবকিছু খোলা রেখে অর্ধেক পরিবহন বসিয়ে রেখে যাত্রী ও পরিবহনের উপর বাড়তি চাপ ও গাদাগাদি করে যাতায়াতে গণসংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা বেড়ে গেছে। তাছাড়া রেলগাড়ী ও নৌপরিবহনের ক্ষেত্রে সব পরিবহনকে একই সঙ্গে চলার অনুমতি দেয়া হলেও শুধুমাত্র সড়ক পরিবহনে অর্ধেক পরিবহন চালু রাখার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বরং সব পরিবহন চালু রেখে অর্ধেক যাত্রিবহণের মাধ্যমে শারিরীক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচলে সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা কমিয়ে আনা সম্ভব।
সরকারি-বেসরকারি সব অফিস-আদালত, কলকারখানা, আর্থিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মার্কেট-শপিংমল খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার কোনো গাইড লাইন নেই। অথচ ইউনেস্কোর তরফ থেকে সর্বাগ্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছিল। প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রায় ৫ কোটি শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারে অনিশ্চয়তার দোলাচলে স্বাস্থ্যগত ও মনস্তাত্তি¡ক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের ভবিষ্যতের জন্য এটি অনেক বড় ক্ষতি। অনেক দেশেই অপরিতল্পিত ও সমন্বয়হীনভাবে মাসের পর মাস ধরে লকডাউন দিয়ে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করেও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে তেমন ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়নি। আমাদের দেশেও তা প্রমান হয়েছে। করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রণে স্বল্পতম সময়ে সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করাই হচ্ছে একমাত্র কার্যকর পন্থা। করোনা টিকায় আমরা প্রতিবেশি দেশগুলোর চেয়েও অনেক পিছিয়ে পড়েছি। অথচ শুরুতে করোনা সংক্রমণ রোধ ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ রোল মডেল হয়ে উঠেছিল। ভ্যাক্সিনে বিপর্যয় আমাদেরকে সবদিক থেকে পিছিয়ে দিয়েছে। এহেন বাস্তবতায় সব মানুষের জন্য দ্রুততম সময়ে টিকা প্রদান নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ এবং স্বাস্থ্য নির্দেশনাগুলো কঠোরভাবে মেনে চলাই হচ্ছে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের মূল পন্থা। গণপরিবহণে সড়কে ও গণপরিবহনে দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল, মাস্ক পরিধান এবং সেনিটাইজার ব্যবহারসহ মানুষের চলাচল সীমিত রাখার উদ্যোগ শিথিল করার সুযোগ নেই। অপরিকল্পিত, অসমন্বিত ও নিয়ন্ত্রণহীন বিধিনিষেধ প্রত্যাশিত নয়। যত দ্রুত সম্ভব গণটিকা কার্যক্রম সফল করার পাশাপাশি পেন্ডেমিক নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ কঠোরতা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ থেকে পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই। সরকারি উদ্যোগে অতি দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে হলেও সামাজিক সংক্রমণের ঝুঁকি মোকাবেলায় সংক্রমণের হার ১০ ভাগের নিচে নেমে আসা পর্যন্ত সম্ভাব্য সব উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। টিকার অভাবে ১৪ তারিখ থেকে শুরু হতে যাওয়া গণটিকা কার্যক্রমের অনিশ্চয়তা দূর করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।