মৃত্যু বিশ্লেষণে কতদিন লাগে আইইডিসিআরের?

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ২০ জুন ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাঈদা নাসরীন বাবলি। পরদিন তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। ওই অবস্থাতেই ৭ জুলাই মারা যান তিনি। ১৩ জুলাই প্রথম আলোর সম্পাদনা সহকারী আবুল কালাম আজাদ (বিপ্লব) ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ঢাকা শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে রোগী ভর্তি আছে ৫০ জনেরও বেশি। এর মধ্যে ছয়টি শিশু আইসিইউতে। হাসপাতালটি জানায়, ৩ আগস্ট পর্যন্ত এখানে চার শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এদের একজন সাভারের। বাকিরা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। রাজধানীর হলি ফ্যামিলি হাসপাতালেও ২২ জুলাই রাতে একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী মারা যান বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
চলতি মাসের ছয়দিনেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ৪৫৭ জন। ২৪ ঘণ্টায় (৫-৬ আগস্ট) শনাক্ত হয়েছে ২১৪ জন। এদের ২১১ জনই ঢাকার। জুলাইতে এ বছরের সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। শুক্রবার (৬ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্য থেকে এসব জানা যায়। স্বাস্থ্য অধিদফতর আরও জানায়, দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে এখন এক হাজার ১০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি আছেন। এরমধ্যে ঢাকায় আছেন ৯৭২ জন। ডেঙ্গু পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছে অধিদফতর। জ্বর হলে এখন করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গুর পরীক্ষা করারও পরার্মশ দিয়েছে অধিদফতর।
এদিকে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু সন্দেহে ১০ জনের মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনার জন্য রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানটি এখনও পর্যালোচনা শেষ করতে পারেনি। একটি মৃত্যুও ডেঙ্গুতে হয়েছে বলে নিশ্চিত করেনি আইইডিসিআর। এ ধরনের মৃত্যু নিয়ে তাদের পর্যালোচনার এখতিয়ার ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের কর্মকর্তারা বলছেন, ডেঙ্গুতে যেসব মৃত্যু হবে তাদের ফাইল পাঠাতে বলে আইইডিসিআর। তারা ব্ল্যাড স্যাম্পলও চায়। কিন্তু এক সপ্তাহ আগে কোনও রোগী ভর্তি হলে বোঝা যায় না রোগী মারা যাবে নাকি সুস্থ হবে। যার কারণে রক্তের স্লাইড সংরক্ষণ করা হয় না। ২৪ ঘণ্টা পর সেগুলো নষ্ট করা হয়। ৪৮ বা ৭২ ঘণ্টা রাখতে হলে প্রচুর নমুনা জমে যাবে। তা সত্ত্বেও আমরা পাঠানোর ব্যবস্থা নেবো। ঢাকা শিশু হাসপাতালের রোগতত্ত্ববিদ ডা. কিংকর ঘোষ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যুর তথ্য রিপোর্ট করা হচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমে। আইইডিসিআরেও মৃত্যুর তথ্য পাঠানো হচ্ছে।
কেন রিভিউ কমিটি?
২০১৯ সালে দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ছিল উদ্বেগজনক। সেসময় হাসপাতালগুলো থেকে ডেঙ্গু রোগীদের মৃত্যু পর্যালোচনার জন্য আইইডিসিআর একটি ডেথ রিভিউ কমিটি করে। তখন ওই কমিটি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন দেশের জনস্বাস্থ্যবিদসহ হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষ। কর্তব্যরত চিকিৎসকের দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেটকেই চূড়ান্ত বলে মনে করেন বলে জনস্বাস্থ্যবিদরা জানিয়েছিলেন বাংলা ট্রিবিউনকে। তাদের ভাষ্য, মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ের জন্য রিভিউ কমিটির প্রয়োজন নেই। বরং তাদের বিশ্লেষণে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। কর্তব্যরত চিকিৎসক যদি অন্য মৃত্যুর কারণ ঘোষণা করতে পারেন, তবে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও বলতে পারবেন। সেসময় এ বিষয়ে জানতে চাইলে খোদ আইইডিসিআর-এর সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জোর দিয়েই বলছি, এই রিভিউ কমিটির প্রয়োজন নেই। রিভিউ তখনই প্রয়োজন, যখন রোগীর মৃত্যুর সঙ্গে ক্ষতিপূরণ, আইনগত বা বীমা সংক্রান্ত বিষয় থাকে।’ আইইডিসিআরের নিশ্চিতকরণের দরকার নেই জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক জনস্বাস্থ্যবিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আপনারা তাদের কনফারমেশন চাচ্ছেন কেন? ক্লিনিশিয়ান বা হাসপাতাল যখন বলবে, রোগী ডেঙ্গুতে মারা গেছেন এবং তার ডেঙ্গু কনফার্ম ছিল সেখানে আইইডিসিআরের বলার প্রয়োজন নেই।’ তিনি আরও বলেন, “২০১৯ সালে রোগীদের মৃত্যু ‘ডিসক্লোজ’ করতে চায়নি বলেই এই রিভিউ কমিটি বানিয়েছিল আইইডিসিআর।” ‘যদি কোনও রোগীর এনএস-১ (ডেঙ্গু পরীক্ষা) করে আইজিএম (ডেঙ্গু শনাক্তে আরেক পরীক্ষা) পজিটিভ পাওয়া যায় এবং তার চিকিৎসা ডেঙ্গু রোগী হিসেবেই হয়- এরপর তিনি যদি মারা যান তখন তার মৃত্যুর কেন পর্যালোচনা করা হবে?’ প্রশ্ন রাখেন ওই জনস্বাস্থ্যবিদ।
এদিকে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে কিনা সেটা পর্যালোচনা করতে কত সময় লাগবে জানতে চাইলে আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সময় লাগবে। কারণ যে ডেথ রিভিউ কমিটি হয়েছিল তারা এখন কেউ আসছেন না। করোনার কারণে কমিটির সদস্যরা কেউ সময় দিতে পারছেন না।’ হাসপাতাল যখন ডেঙ্গুতেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানাচ্ছে, তখন কেন রিভিউ কমিটি করা হলো জানতে চাইলে অধ্যাপক শিরীন বলেন, ‘রোগী কেন মারা গেল বা তার আরও কোনও কন্ডিশন ছিল কিনা এসব দেখা হবে। এটা আমাদের অভ্যন্তরীণ রিভিউ।’ কোভিডের সময় কাজের চাপ মাত্রাতিরিক্ত জানিয়ে তিনি জানান, কোভিডের রোগী, ভ্যাকসিন ও ডেঙ্গু রোগী- এসবের সামাল দেওয়ার তুলনায় জনবল অনেক কম।‘মৃত্যুর বিচার বিশ্লেষণ করা আইইডিসিআরের একটি নিজস্ব দায়িত্ব। সেটা নিয়ে কারও বলার কিছু নেই।’ যোগ করেন অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন। তাহলে বিশ্লেষণ করতে কত সময় নেবে আইইডিসিআর? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ভার্চুয়াল মিটিংয়ে এটা সম্ভব নয়। অনেক কাগজপত্র থাকে। সবার সঙ্গে একসঙ্গে বসে এগুলো করতে হবে।’