সরকারি তদন্তেই ‘হুইপ বাহিনীর’ টিকা বাণিজ্যের গোমর ফাঁস, সিসিটিভির ফুটেজ গায়েব

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সরকারি তদন্তেই চট্টগ্রামের পটিয়ায় হুইপ বাহিনীর টিকা বাণিজ্যের গোমর ফাঁস হয়েছে। তবে গায়েব হয়ে গেছে উপজেলার সরকারি টিকা সংরক্ষণাগারের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ।
তদন্তে উঠে এসেছে, অনুমতি ছাড়া ও যথাযথ নিয়ম না মেনেই প্রদান করা হয় ২৬শ টিকা। টিকা নিরাপত্তার ‘কোল্ড বক্স’ ছাড়াই টিকা স্থানান্তর, রেজিস্ট্রেশন কার্ড জালিয়াতিসহ তদন্তে ধরা পড়েছে গুরুতর অনিয়ম। বারকোড স্ক্যান করেই মিলল শুভংকরের ফাঁকি দেওয়ার ঘটনা। দুইদিনে দেওয়া ২৬শ টিকার উপস্থাপিত রেজিস্ট্রেশন কার্ডের মধ্যে অন্তত ২২শ কার্ডই ভুয়া। অনুমতি ছাড়াই এই টিকাদান প্রক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্য সহকারীর মতোই হুইপ সামশুলের ভাই মহব্বত নিজেই টিকা পুশ করেছেন টিকা প্রত্যাশীদের!
সব মিলে হইপপোষ্য-বাহিনীর দ্বারা ভয়াবহ ‘স্বাস্থ্যঝুঁকি’ তৈরি হয়েছে পটিয়ায়, এমনই তথ্য-উপাত্ত উঠে এসেছে সরকারি তদন্তে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের পরিচালকের নির্দেশে শনিবার তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। দুইদিন তদন্তের সময় দিয়ে গঠিত এই কমিটি তদন্ত কাজ শেষ করেই সোমবার সন্ধ্যায় পরিচালক বরাবরে রিপোর্ট জমা দেয়।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ডা. অজয় দাশ রিপোর্টের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করলেও একপর্যায়ে স্বীকার করেছেন, তদন্তকালে টিকাদান প্রক্রিয়ার অসংগতি ধরা পড়েছে।
তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এমনটি জানান। রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে বের হয়ে আসে, তদন্তে উঠে আসা পটিয়ায় হুইপ বাহিনীর টিকা বাণিজ্যের গুরুতর অনিয়মের চিত্র।
কী আছে সরকারি তদন্তে?
সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো জানায়, যথাযথ অনুমোদন না নিয়ে ও নিয়মবহির্ভূতভাবে পটিয়ার শোভনদন্ডী ইউনিয়নে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপির বাড়ি লাগোয়া একটি অস্থায়ী ক্যাম্পে ওই টিকাগুলো দেওয়া হয়। তদন্তকালে অভিযুক্ত হইপপোষ্য কথিত ছাত্রলীগ নেতা ও ইপিআই কর্মসূচির টেকনোলজিস্ট রবিউল হুসাইন তদন্ত টিমকে মোট ২৬শ টিকার রেজিস্ট্রেশন কার্ড উপস্থাপন করেন। কার্ডগুলো সংশ্লিষ্ট বারকোড পরখ করে ধরা পড়েছে ভিন্নতা। ২৬শ কার্ডের মধ্যে দুই শতাধিক কার্ড পুরনো রেজিস্ট্রেশনকৃত।
দুই হাজারের বেশি কার্ড রেজিস্ট্রেশনের জন্য ইতোপূর্বে আইডিকার্ড নিয়ে আসা মানুষের, তাদের নামে রেজিস্ট্রেশন কার্ড রবিবার সকালেই পূরণ করা হয়। অর্থাৎ এটি স্পষ্ট যে, পুরনো জমে থাকা আইডিকার্ড দিয়েই তদন্ত কমিটির ঘটনাস্থল পরিদর্শনের আগেই এসব রেজিস্ট্রেশন কার্ড পূরণ করা হয়।
রাষ্ট্রীয় অপচয়
রেখে যাওয়া আইডি কার্ড দিয়ে শেষোক্ত রেজিস্ট্রেশন কার্ড পূরণ করা এই প্রায় ২ হাজার মানুষ পরবর্তীতে সত্যিকারে যখন রেজিস্ট্রেশন করতে আসবেন, তখন পরিস্থিতিটা কেমন দাঁড়াবে, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। তখন কি তাদের জ্ঞাতসারে আবার রেজিস্ট্রেশন হলে, তাদের নামে আবার টিকা বরাদ্দ হবে? এ ক্ষেত্রে এক ব্যক্তির নামে সরকারি টিকা দ্বিগুণ বরাদ্দ কি রাষ্ট্রীয় অপচয় হবে না? এমন প্রশ্নও ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের।
শুক্র ও শনিবার দুদিনেই একটি ইউনিয়ন পর্যায়ের ক্যাম্পে এতগুলো টিকা প্রদানের ঘটনা অস্বাভাবিক মনে হয়েছে তদন্ত কমিটির কাছে। এ প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কমিটির প্রধান তা স্বীকারও করেন।
সরকারি একটি সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বিভাগের টিকাদান প্রক্রিয়ায় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল সর্বোচ্চ জনবল দিয়ে পরিচালিত হয়। অথচ এখানেও দুই দিনে শোভনদন্ডী ইউনিয়নের সেই ক্যাম্পটির মতো এত বেশি গতিতে টিকা প্রদান সম্ভব হয়নি। ওই ক্যাম্পে দুই দিনে ২৬শ টিকা প্রদানের ঘটনা তাই প্রশ্নবিদ্ধ। তাছাড়া ক্যাম্পটিতে কোনো ইপিআই প্রশিক্ষিত লোকবলও ছিল না।
স্থানীয় সূত্রের ধারণা, প্রশিক্ষণহীন উপজেলার সুইপার-ঝাড়ুদার পর্যায়ের লোকজন দিয়ে এই টিকা প্রদান করা হয়। এই সময়কালের মধ্যেই হুইপ শামসুলের ভাই মহব্বত কর্তৃক টিকাদানের ছবিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এসব মিলে স্পষ্ট যে, কী পরিমাণ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছে পটিয়ার ওই ইউনিয়নের টিকা গ্রহীতাদের।
সরকারি অভিন্ন সূত্র জানায়, সাধারণত সিভিল সার্জন অফিস থেকে উপজেলা পর্যায়ে স্থানান্তর করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইপিআই টিকা সংরক্ষণাগার ফ্রিজেই টিকা সংরক্ষণ করা হয়। সেখান থেকেই কোনো ইউনিয়ন বা ক্যাম্প পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে ভ্যাক্সিন ক্যারিয়ারের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শোভনদন্ডী ইউনিয়নে হুইপের বাড়ি লাগোয়া ওই ক্যাম্পে টিকা স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় অভিযুক্ত রবিউল এ ক্ষেত্রে কোল্ড বক্সে টিকা নিয়ে যাননি। এমন অভিযোগে তদন্ত দলের কর্তারা উপজেলার ওই সংরক্ষণাগারের সিসিটিভির ফুটেজ খোঁজ করতে গিয়ে অবাক বনে যান! তদন্ত কমিটি বৃহস্পতিবারের পরে ওই সিসিটিভির ক্যামেরার কোনো ফুটেজের হদিস পাননি।
সরকারি নির্ভরযোগ্য সূত্রটি আরও জানায়, উপজেলাটির হেলথ কমপ্লেক্সেই পূর্ণ লোকবল নিয়ে গোটা দিনে যেখানে (সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত) মাত্র ৪শ থেকে ৫শ টিকা দৈনিক প্রদান করার সক্ষমতা আছে, সেখানে একটি ইউনিয়নের ওই ক্যাম্পেই প্রশিক্ষিত লোকবল ছাড়া কীভাবে দুই দিনে ২৬শ অর্থাৎ দিনে ১৩শ করে টিকা দেওয়া হলো, তাও প্রশ্নবিদ্ধ।
তবে কি টিকার বদলে অন্যকিছু?
সংগত কারণেই অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে, উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে ওই টিকা নিয়ে যাওয়ার পরে তা কি আদৌ কোনো ফ্রিজ বা কোল্ড বক্সে ঠিকমাত্রায় রক্ষিত ছিল? যদি না থাকে, তবে সেই অরক্ষিত টিকা কীভাবে এলাকার জনগণকে দেওয়া হলো? নাকি সেই টিকা অন্য কারও ভাগাড়ে চলে গেছে? অন্য কোথাও মজুদ বা বিক্রি হয়েছে সেসব? অন্যদিকে টিকার বদলে সাধারণ মানুষকে সাদা পানি বা অন্যকিছু কি দেওয়া হয়েছে? এসব প্রশ্ন উঠেছে এলাকার সচেতন ও সাধারণ মানুষের মনে।
এলাকায় ক্ষোভ-অসন্তোষহুইপ শামসুলের এলাকায় টিকা প্রক্রিয়ার অপবাণিজ্য নিয়ে যখন তুমুল অভিযোগ; তখন এলাকাটিতে করোনায় ত্রাণ নিয়ে অবস্থানরত কেন্দ্রীয় যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মুহাম্মদ বদিউল আলম ‘টিকা নিয়ে নয়-ছয় বরদাস্ত করা হবে না’ বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ সেলিম নবীসহ অনেকেই মনে করেন, দেশের সাধারণ মানুষকে টিকা প্রদানে প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক উদ্যোগ কোনো লুটেরা দুর্নীতিবাজের গ্রাসে যাতে বিতর্কিত না হয়, সেটি দেখভাল করার দায়িত্ব সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের।
হুইপ বাহিনীর এমন টিকা বাণিজ্যে এলাকায় ক্ষোভ-অসন্তোষ বাড়ছেই। পটিয়ায় হুইপ শামসুল ও তার পুত্র শারুন চৌধুরীকে নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন আহমেদকে লাঞ্ছনা ও হুমকির অভিযোগে অতিসম্প্রতি হুইপ বাহিনীর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম শহরের রাজপথেও বিক্ষোভ মিছিল করেন বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানরা।