রাজধানীর মর্যাদা রক্ষা করতে হবে

0

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বেশ জোরের সাথেই বলা হচ্ছে। মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি ও সামাজিক সূচকে অগ্রগতির পরিসংখ্যান নিয়ে সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন। কিন্তু মানুষের আয়বৈষম্য, টেকসই উন্নয়ন, পরিবেশগত সুরক্ষা এবং দেশের প্রধান প্রধান নগরীগুলোর বাসযোগ্যতা বৈশ্বিক মানদন্ডে তলানিতে অবস্থানের বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে হয়না। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও করোনা অতিমারীর প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে আমাদের প্রবাসি শ্রমিক, গার্মেন্ট রফতানি এবং কৃষকদের বাম্পার ফলনের উপর ভর করে আমাদের অর্থনীতি সন্তোষজনক অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছে বটে। তবে আগামী দশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া এবং ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত অর্থনীতি তথা বিশ্বের ২০টি প্রধান অর্থনীতির মধ্যে প্রবেশের যে প্রত্যাশা করা হচ্ছে তা সফল করতে হলে অবশ্যই টেকসই উন্নয়ন ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মূল লক্ষ্য হতে হবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের বাধাসমূহ দূর করা। কোনো দেশের রাজধানী শহর ও প্রধান বন্দর নগরী যদি স্বাচ্ছন্দে চলাচল ও বসবাসের অযোগ্য হয়, সেখানে কাক্সিক্ষত বিদেশি বিনিয়োগ আশা করা যায় না। প্রশাসনিক রাজধানী ঢাকা নগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামকে যানজটমুক্ত, পানিবদ্ধতামুক্ত, প্রাকৃতিক পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ করে তুলতে না পারলে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাক্সিক্ষত অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্সে আবারো বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় প্রথম ৫টির মধ্যে স্থান পেয়েছে আমাদের রাজধানী ঢাকা। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো লন্ডনভিত্তিক গণমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্টের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট(ইআইইউ) বিশ্বের ১৪০ শহরের বাসযোগ্যতার মানদন্ড নিরূপণ করেছে। সেখানে ঢাকা ১৩৭তম অবস্থান লাভ করেছে। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামোর মতো সূচকগুলোকে সামনে রেখে পরিচালিত পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের রাজধানী গত এক দশক ধরে বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর তালিকায় প্রথম দিকে অবস্থান করছে। যুদ্ধবিদ্ধস্ত সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক, নাইজেরিয়ার লেগোস এবং পাপুয়া নিউগিনির পোর্ট মোরসবির পরই বাংলাদেশের রাজধানীর নাম। অন্যদিকে বাসযোগ্যতার দিক থেকে প্রথম ৫টি শহরের মধ্যে রয়েছে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড, জাপানের ওসাকা, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড, নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন এবং জাপানের রাজধানী টোকিও। আমরা দেশকে বিশ্বের ২০টি শীর্ষ অর্থনীতির দেশে উত্তরণের স্বপ্ন দেখাচ্ছি, অথচ দেশের রাজধানী শহরকে বিশ্বের সর্বনিম্ন অবস্থান থেকে তুলে আনতে পারছি না। এই ব্যর্থতা নিয়ে আমরা কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে পারব না। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও সামাজিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জে সফল হতে হলে রাজধানী শহরের বাসযোগ্যতা এবং বাণিজ্য ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অর্থনীতিতে এগিয়ে থাকার রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। একই সাথে গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্সের পাশাপাশি ইনকিলাবের আরেকটি প্রতিবেদনে রাজধানীর প্রবেশদ্বারে ময়লার স্তূপ ও দুর্গন্ধ-ভাগাড়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের স্বাচ্ছন্দ জীবনযাপন, নিরাপত্তা, পরিবেশগত সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়নের মানদন্ডকে অগ্রাহ্য করে যেনতেনভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানকে উন্নয়নের রোল মডেল বলে বিবেচনা করা শুভঙ্করের ফাঁকি। শহরের চারপাশের নদীগুলো দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে, শহরের মধ্য দিয়ে এক সময়ের প্রবহমান খালগুলোও দখল ও ভরাট হয়ে গেছে, শহরের পার্ক, সবুজ চত্বর, চারপাশের জলাভূমিও প্রভাবশালী মহলের দ্বারা ভরাট ও দখল হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা এবং সরকারি বিভিন্ন কমিটির সুপারিশ ও পরিকল্পনা অনুসারে বেদখল মুক্ত করে শহরের পরিবেশ উন্নয়ন ও যানজট-পানিবদ্ধতার মত সমস্যাগুলো দূর করার উদ্যোগগুলো সফল হয়নি। দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন বলে স্বীকৃত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রাজধানীর প্রবেশ দ্বারের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে, দৃষ্টিনন্দন ফ্লাইওভার বা হাজার হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের স্বপ্ন দেখিয়ে এই দুর্গন্ধ ও কদাকার দৃশ্য ঢৈকে রাখা যাবে না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশগত বিষয়ে এমন বিশৃঙ্খলা ও খামখেয়ালিপনা দিয়ে নগরীকে বাসযোগ্য রাখা অসম্ভব। প্রায় সারাবছরই শহরে উন্নয়ন ও সংস্কারের নামে রাস্তা খোঁড়াখুড়ি ও জনদুর্ভোগ যেন নগরবাসীর ভাগ্যলিপি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় এখন বেশকিছু উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে, এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শহরের যানজটসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তনের প্রত্যাশা করা হচ্ছে। তবে উন্নয়নের নামে কোটি মানুষের দুর্ভোগ বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে না। হাজার হাজার কোটি টাকায় বছরের পর বছর ধরে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে, তার পাশেই ময়লার অপরিকল্পিত ডাম্পিংয়ে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠবে, এমন অবস্থা কারো কাম্য নয়। উন্নয়নের হাজার হাজার কোটি টাকার বাজেটের বিপরীত দিকে জড়িয়ে থাকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি ও মুনাফাবাজি। রাজধানী শহর এবং দেশকে বাসযোগ্য রাখতে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও অব্যবস্থাপনার চক্র থেকে অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে।