কোয়ারেন্টিনের নামে বাঙালিদের সঙ্গে যা করছে সৌদি আরব

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সহায় সম্বল বিকিয়ে সৌদি পাড়ি জমান আব্দুস সালাম। যেতে খরচ হয় লক্ষাধিক টাকা। তারওপর যুক্ত হয়েছে সৌদি সরকারের বেঁধে দেওয়া কোয়ারেন্টিন শর্তের জন্য অতিরিক্ত খরচ। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে থ্রি স্টার মানের হোটেলে ৭ দিনের কোয়ারেন্টিনের জন্য পরিশোধ করেন ৭৮ হাজার টাকা। অথচ তাদের রাখা হয়েছে একটি ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্টে। সেখানে খাবারের মান নিম্ন এবং চাইলে পানিও পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ প্রবাসীদের। এপার্টমেন্টের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে- সাতদিনের জন্য তাদের ১ হাজার রিয়াল পরিশোধ করা হয়েছে, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় সাড়ে ২২ হাজার। যাদের হোটেলে রাখা হয়েছে তাদের হোটেলের মানের তুলনায় অতিরিক্ত ২০ হাজার টাকা করে আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
সৌদি আরবে কাজের উদ্দেশ্যে গিয়ে এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন কয়েকশ বাংলাদেশি। তাদের অভিযোগ অসাধু বিমান কর্মকর্তা ও একটি দুর্নীতিবাজ চক্রের কারণে করোনাকালীন সৌদি প্রবাসী শ্রমিকদের বিমানভাড়ার সঙ্গে কোয়ারেন্টিন খরচ আদায় করা হচ্ছে বহুগুণ। এতো এতো অভিযোগের পরও তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। সৌদিতে অবস্থানরত ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, করোনাকালীন বিদেশি শ্রমিকদের ভ্রমণ বিষয়ক নতুন আইনে সৌদি আরবে আসার পর ন্যূনতম সাতদিন বিমান সংস্থার মনোনীত এজেন্সির তত্ত্বাবধায়নে কোয়ারেন্টিনে থাকার নির্দেশনা রয়েছে। এ সময় থাকা-খাওয়া বাবদ প্রত্যেক প্রবাসী শ্রমিকের কাছ থেকে টিকিট কেনার সময় আদায় করা হয়েছে অতিরিক্ত প্রায় ৭৭ হাজার টাকা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এত টাকা বিমান বাংলাদেশকে দেওয়ার পরও সৌদি আরবে এসে কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় কোনও সুযোগ-সুবিধাই তারা পাননি। শুধু তাই নয়, তাদেরকে যে সব হোটেলে রাখার কথা ছিল সে সব হোটেলে না রেখে নিম্নমানের হোটেলে রাখার অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা। এমনকি এ প্যাকেজের আওতায় খাবার সরবরাহের কথা থাকলেও তা দেওয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তারা।
পরিদর্শনে যান দূতাবাসকর্মীরা
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভুক্তভোগীদের এমন অভিযোগ জানার পর সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. জাবেদ পাটোয়ারি দূতাবাসের কয়েকটি দলকে পরিদর্শনে পাঠান। পরিদর্শন দলের প্রতিনিধিরা গিয়ে দেখেন বাংলাদেশি কর্মীদের যেসব হোটেলে রাখার কথা ছিল তার পরিবর্তে অন্য দেশের নাগরিকদের সেখানে রাখা হয়েছে। দূতাবাসের কর্মকর্তারা গিয়ে জানতে পারেন কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন একজন ভারতীয় নাগরিক। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, বাঙালিদের কিছুটা দূরে একটি কথিত মানের ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্টে রাখা হয়েছে। সেখানেও দূতাবাসের প্রতিনিধিরা যান। গিয়ে দেখেন সেখানে থাকার খরচ তাদের পরিশোধকৃত অর্থের চার ভাগের এক ভাগ। সেসব কথিত সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টের মালিকরাও জানান, তাদেরকে সাতদিনের জন্য ২২ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, গত ২০ মে সৌদি সরকারের জারিকৃত নির্দেশনার পর ২৯ মে দাম্মামে ও ৩০ মে রিয়াদে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স আলাদা আলাদা দুটি ফ্লাইট পরিচালনা করেছে। গত ২৯ মে বিমান বাংলাদেশের ফ্লাইটটি দাম্মামে ১৩৫ জন যাত্রী নিয়ে অবতরণ করে। তারমধ্যে ১৩ জন সৌদি সরকারের অ্যাপে ইমিউন হওয়ায় (টিকা নেওয়া) প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের প্রয়োজন হয়নি। বাকি ১২২ জনকে তিনটি হোটেলে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়।
ভাতের সঙ্গে শুকনো মুরগি আর পাটশাকের ঝোল
দূতাবাস সূত্রে জানা যায়, দাম্মারের সেই তিনটি হোটেলে শ্রম উইং প্রতিনিধিরা সরেজমিন গিয়েছেন। যাত্রীরা তাদের জানান, কোয়ারেন্টিন বাবদ বাংলাদেশে জনপ্রতি ৬২-৬৩ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন। দূতাবাসের কর্মকর্তারা সরেজমিন ঘুরে এই মানের হোটেলের ৭ দিনের কোয়ারেন্টাইনের ফুল প্যাকেজ খরচ সর্বোচ্চ ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে হওয়ার কথা বলে জানতে পারেন। তবে বাংলাদেশ থেকে যে হোটেলের কথা উল্লেখ করেছিল সে হোটেলেই যাত্রীদের রাখা হয়েছে। সেসব যাত্রীরা খাবার নিয়েও তেমন উচ্চবাচ্য করেননি। তবে অভিযোগ ছিল এই মানের হোটেলের খরচ অনেক কম। খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, গত ৩০ মে বিমান বাংলাদেশের একটি ফ্লাইট রিয়াদে যায়। সেই ফ্লাইটের ১০০ জনকে একটি হোটেলে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে পাঠানোর কথা ছিল। যাত্রীরা রিয়াদে এসে কুইট রুমস অ্যাপার্টমেন্টসে থাকার কথা থাকলেও পরিদর্শনে গিয়ে দূতাবাস প্রতিনিধি সেই হোটেলে কোন বাংলাদেশি যাত্রীকে পাননি। সেখানে অন্য দেশের যাত্রীরা অবস্থান করছিলেন। সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি জানান, তাদের চারটি হোটেলে রাখা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো হোটেল নয়, ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্ট। সৌদি সরকারের অনুমোদিত তালিকায় সেসব অ্যাপার্টমেন্ট নেই। সেখানে খাবারে দেওয়া হয় ভাত, মুরগির তরকারি (যা খুব একটা মুখরোচকও নয়)। এর সঙ্গে থাকে পাটশাকের ঝোল। হোটেলের যাত্রীরা আরও জানান, তারা বিমান থেকে সকালে নামার পর দুপুর পর্যন্ত খাবারও পাননি। দূতাবাসের কর্মকর্তারা সেখানে গেলেও হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের সেখানে প্রবেশ করতে দেয়নি। যাত্রীদের সঙ্গে তখন দূতাবাসের কর্মকর্তারা ফোনে আলাপ করে অভিযোগ শোনেন।
ভিডিওবার্তায় আকুতি
কথিত সব হোটেল ও অ্যাপার্টমেন্ট থেকে যাত্রীরা বাংলা ট্রিবিউনের কাছে ভিডিও বার্তায় জানিয়েছেন, ‘দূতাবাসের কর্মকর্তারা আমাদের খোঁজ নিয়েছেন। ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন। বিমান প্রতিমন্ত্রীর কাছে আবেদন, বিমানের টিকেটের সঙ্গে আমাদের কোয়ারেন্টিন খরচ বাবদ ৭৮ হাজার ৩১৫ টাকা নেওয়া হয়েছে। কাগজপত্রে থ্রি স্টার হোটেলের কথা লেখা থাকলেও আমাদের তা দেওয়া হয়নি। খাবার দেয় তো পানি দেয় না। খাবার যা দেয় তা খাওয়ার মতো নয়। আবার পরিমাণও একজনের জন্য যথেষ্ট নয়। আমরা রাষ্ট্রদূত জাবেদ পাটোয়ারি স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। উনি দূতাবাস থেকে লোক পাঠিয়েছেন। তারা যাওয়ার সময় আমাদের ৫ কার্টন পানি দিয়ে গেছেন। ৭৮ হাজার টাকা নিয়ে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।’ প্রবাসী এসব কর্মীদের সরবরাহকৃত কোয়ারেন্টিনের বুকিংয়ের কাগজ যাচাই বাছাই করে দেখা যায়, তাদের টাকার রশিদে কোন হোটেলে কোয়ারেন্টিন করা হবে সেই সংক্রান্ত তথ্য নেই। শুধু প্যাকেজ হিসেবে টাকা আদায় করা হয়। প্যাকেজে আছে- ৬ রাত থাকা, ৩ বেলা খাবার, এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল পর্যন্ত নেওয়া এবং ২টি পিসিআর কোভিড টেস্টের খরচ। ভুক্তভোগীদের ভাষ্য- কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের জানিয়েছে ১ হাজার রিয়ালে যা যা করা সম্ভব তারা তাই করছেন। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে বিমান প্রতিমন্ত্রী, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রবাসীদের এসব সমস্যার বিষয়ে ঢাকায় প্রতিবেদন পাঠিয়েছে দূতাবাস। জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠনের একজন নেতা জানান, সৌদিআরবে কোয়ারেন্টিন খরচ অনেক বেশি বলে লোক পাঠানো বন্ধ রেখেছি। যে টাকা খরচ হচ্ছে প্রবাসীদের তা দিয়ে সেখানে ৪-৫ স্টার হোটেলে রাখা সম্ভব। কিন্তু এগুলো দেখার কেউ নেই।