মানবিক কারণে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিন

0

বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর ভাই শামীম ইস্কান্দারের করা আবেদনটি নামঞ্জুর করা হয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন: আইন অনুযায়ী দন্ডপ্রাপ্ত খালেদা জিয়াকে বিদেশে যেতে অনুমতি দেয়ার সুযোগ নেই। আইনমন্ত্রীর সাফ এই জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন: এ মতামত অনুযায়ী খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদন মঞ্জুর করতে পারছি না। বেগম খালেদা জিয়া রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁর অবস্থার ক্রমাবনতির প্রেক্ষাপটে চিকিৎসকগণ বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণের পরামর্শ প্রদান করেন। সে মোতাবেক পরিবারের পক্ষ থেকে চিকিৎসার জন্য তাঁর বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দানের আবেদনটি করা হয়। আবেদন নাকচ হওয়ায় তাঁর পরিবার, দলের নেতাকর্মী ও দেশের সকল শ্রেণির সহৃদয় মানুষ মর্মাহত ও বিচলিত। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, সরকারের সিদ্ধান্তে বিএনপি হতাশ ও ক্ষুব্ধ। যে যুক্তিতে এই সিদ্ধান্ত তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। সরকার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে ক্ষমা করে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে। অথচ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্য সরকারের মানবতা-শিষ্টাচার কাজ করে না। প্রবীণ আইনজীবী, বিএনপিনেতা খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন: সরকার খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না দিয়ে অমানবিক কাজ করেছে। আইনের ভুলব্যাখ্যা দিয়ে এটা করা হয়েছে। তাঁর মতে, সরকার ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী শর্ত সাপেক্ষে বা শর্ত ছাড়া দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে সাজা মওকুফ, স্থগিত বা কমাতে পারে। এটা সরকারের এখতিয়ার। সরকার সমর্থক আইনজীবীদের কেউ কেউ যে অভিমত দিয়েছেন, তাতে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিই সমর্থন রয়েছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রর প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন: বির্তক না করে মানবিক দিক বিবেচনা করে দেশের মঙ্গলের জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেয়া উচিৎ।
বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির সুদীর্ঘকালের অবিসংবাদিত নেত্রী। তিনি দেশের তিন তিন বারের প্রধানমন্ত্রী। সর্বোপরি ৭৫ বছরের বেশি বয়সী একজন মানুষ। তাঁর বিদেশে চিকিৎসার পক্ষে মানবিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে এর কোনো একটি বিষয় যথেষ্ট। চিকিৎসার জন্য কারো বিদেশে যাওয়ায় আমাদের দেশে বারন নেই। দেশে চিকিৎসা সুবিধার অপ্রতুলতাই এর কারণ। সামর্থ্যবান অনেকেই চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাসহ বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। অতীতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম প্রমুখ বিদেশে চিকিৎসার জন্য গেছেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তো গত বছরই সিঙ্গাপুর গিয়ে হার্টের অপারেশন করে এসেছেন। অন্যান্য দলের নেতাদেরও অনেকে বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছেন। এই যেখানে বাস্তবতা সেখানে খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারবেন না, এটা ধারণাও করা যায় না। পর্যবেক্ষকদের অনেকে মনে করেন, সরকার এ ব্যাপারে তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটি নিয়েছে আইনের কভারে। আইনমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত আসার আগেই মন্ত্রীদের কেউ কেউ এমন কটাক্ষপূর্ণ ও নির্দয় মন্তব্য করেছেন, যা অপ্রত্যাশিতই শুধু নয়, গৃহীত সিদ্ধান্তের পূর্বাভাস বলেও মনে করা যায়। জীবনের জন্য, চিকিৎসার জন্য এতটুকু মানবিক সহানুভূতি কি বেগম খালেদা জিয়া পেতে পারেন না? আইনই কি সব? যদি তাই মনে করা হয়, তাহলেও বলতে হবে, আইনেও যে সুযোগ আছে, তাতে খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ পেতে পারেন। এক্ষেত্রে সরকারের সদিচ্ছাটাই আসল কথা। মনে রাখতে হবে, আইন মানুষের জন্য আইনের জন্য মানুষ নয়। একথা কারো অবিদিত নেই, সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষ জামিনে খালেদা জিয়া গত কিছুকাল ধরে কারাগারের বাইরে তার বাসায় বসবাস করছেন। সরকার মানবিক কারণেই তার জন্য এই ব্যবস্থা নির্ধারণ করেছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এই মানবিক বিবেচনা আর একটু সম্প্রসারণ করলেই খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা সম্ভবপর হতে পারে।
তাঁর সুচিকিৎসা পাওয়া এবং সুস্থ হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হলে উপায় অবশ্যই খুঁজে পাওয়া যাবে। ফৌজদারী কার্যবিধির যে ধারার মাধ্যমে, খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্ত রাখা হয়েছে, সেই ধারা বলেই তিনি বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ পেতে পারেন। আইনবিদদের অনেকের মতে, তার দন্ড মওকুফের পদক্ষেপও নেয়া যেতে পারে। এ জন্য প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে। সংবিধানের ৪৯ নম্বর অনুচ্ছেদে আছে: ‘কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোনো দন্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং কোন দন্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।’ বলা বাহুল্য, এ অনুচ্ছেদের সদ্বব্যবহার যেমন হয়েছে, অপব্যবহারও হয়েছে। অপব্যবহার স্বভাবতই সমালোচিত হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনা এই অপব্যবহারের নিয়ামক হিসাবে কাজ করেছে। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত একজন আসামীকে প্রেসিডেন্ট ক্ষমা করায় কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বিদেশে চলে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্টের পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ২০ জন আসামীকে ক্ষমা করে দেন। যুবদল নেতা গামা হত্যার আসামী ছিলেন তারা। তাদের অধিকাংশই ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। এর আগের প্রেসিডেন্টও রাজনৈতিক কারণে অনেক আসামী খালাস দিয়েছেন দন্ড মওকুফ করে। রাজনৈতিক কারণে যদি দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের মুক্ত করে দেয়া যায়, তবে মানবিক কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দন্ড মওকুফ করে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া যাবে না কেন? আমরা আশা করবো, সরকার বিষয়টি গভীরভাবে আমলে নিয়ে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, যাতে মুক্ত হয়ে তিনি দ্রুত বিদেশে চিকিৎসা সুবিধা নিতে পারেন।