ছোট মুখে বড় কথা শোভা পায় কি

0
তৈমূর আলম খন্দকার
ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াতে প্রচারিত পুলিশের একটি সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানতে পারলাম, হেফাজতের বহুল আলোচিত নেতা মাওলানা মামুনুল হককে ২০১৩ সালে মোহাম্মদপুর থানায় দায়েরকৃত একটি নাশকতা মামলায় গ্রেফতার করে তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। যখন বিষয়টি নিয়ে লিখছি তখন ২০২১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহ চলছে। মামুনুল হক বা হেফাজতকে সাফাই (DEFEND) গাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে এ আর্টিকেল লেখা নয়। অথবা সোনারগাঁওয়ের রিসোর্টে জান্নাত বা গাজীপুরের জান্নাত মামুনুল হকের স্ত্রী না বান্ধবী এসব বিষয়েও আমার কোনো মাথাব্যথা নেই বা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। পার্লামেন্টে দেয়া সংসদ নেতার ভাষণ মোতাবেক, রিসোর্টের জান্নাত ঝর্ণা পার্লার মেয়ে কি না তাও আমার আর্টিকেল বহির্ভূত বিষয়। রিসোর্টের মহিলা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা এবং একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এটুকুই পত্রিকায় জানতে পেরেছি। তবে রিসোর্টের ঘটনার খলনায়ক মামুনুল হক যে বোকা ও দূরদর্শী নয়, তার রিসোর্ট কর্মকাণ্ডে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। হেফাজতের দাবি মতে, ‘যে দলের ১৯ জন নেতাকর্মীকে পুলিশের গুলিতে হত্যা করা হয়েছে সে দলের নেতা নিভৃতে অবসর সময় কাটাতে রিসোর্টে গেল কোন যুক্তিতে?’ তা-ও আমি তদন্ত করছি না। আত্ম অহঙ্কারে পচা শামুকে মানুষের পা কাটে। মামুনুল হকের অবস্থা হয়েছে তাই। আরো উল্লেখ্য, মুসলিম পারিবারিক অর্ডিন্যাস-১৯৬১ মোতাবেক প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে এবং কাবিননামা ছাড়া বিয়ে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে শরিয়ত বিধিবিধান মোতাবেক মুসলিম বিয়ে সাক্ষীনির্ভর এবং এতে কাগজ-কলমের বাধ্যবাধকতা নেই। মামুনুল হক যে নেতৃত্ব দেয়ার অনুপযুক্ত, তা সে প্রমাণ করে একটি আন্দোলনের বুকে ছুরিকাঘাত করেছে। হেফাজতের মনে রাখা দরকার, ভাবাবেগ আর আন্দোলন এক মাপকাঠিতে মাপা যায় না।
এখন মূল আলোচনায় আসা যাক, ২০১৩ সালের মোহাম্মদপুর থানায় দায়েরকৃত মামলায় পুলিশ মামুনুলকে গ্রেফতার করছে ২০২১ সালে অর্থাৎ আট বছর পর এবং হাস্যকর হলো, (রাজনৈতিক নেতাদের অনুকরণে) জনগণের বাহবা নেয়ার জন্য প্রেস ব্রিফিং করেছে। এ প্রেস ব্রিফিং দেখে মনে পড়ে, ক্যাসিনো (বড় ধরনের জুয়া) ও বিদেশে অর্থপাচার মামলায় সরকারি দল ও তাদের অঙ্গসংগঠনের বড় মাপের নেতারা যখন একের পর এক গ্রেফতার হচ্ছিলেন, তখন বাংলাদেশে আওয়ামী যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ওমর ফারুক পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, ‘এতদিন ক্যাসিনো ধরোনি কেন? এতদিন তোমরা কি আঙ্গুল চুষেছ?’ ওমর ফারুক কথাটি বলার সময় হয়তো খেয়াল করেননি যে, রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নয়, বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কথিত অনির্বাচিত সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে। ফলে রাজনৈতিক নেতার চেয়ে বাহিনীগুলো সরকারের কাছে অনেক বেশি সমাদৃত। এ কারণে শোনা যায়, বাহিনীর সাথে টক্কর খেয়ে ওমর ফারুক পদ হারিয়েছেন। ২০১৩ সালের মামলায়, অর্থাৎ ঘটনার আট বছর পর মামুনুলকে গ্রেফতার করা হলো কেন? তবে এ ক্ষেত্রে যদি বলি, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গত আট বছর কি আঙুল চুষেছে? এ বলাটা হবে ছোট মুখে বড় কথা। ছোট মুখে বড় কথা বলতে চাই না বলেই কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সভাপতি ওমর ফারুককে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করলাম মাত্র। মামলার নথিতে নিশ্চয় মামুনুলকে ‘পলাতক’ বা ‘পুলিশি ভাষায়’ ‘খুঁজে পাওয়া যায়নি’ প্রভৃতি লেখা হয়েছে। রিমান্ড আদেশ দেয়ার সময় ম্যাজিস্ট্রেট তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নিশ্চয় জিজ্ঞাসা করার কথা, আট বছর মামুনুলকে গ্রেফতার না করার কারণ কী? আট বছরের বিলম্বের বিষয়টি নিয়ে আদালত যদি প্রশ্ন করতেন, বিষয়টি নিশ্চয় মিডিয়াতে প্রকাশ পেত। এতে বোঝা যায়, আদালত কোনো প্রশ্ন না করেই সাত দিন রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। যে মামুনুল হক ‘বাংলার বাঘ’ বা যুবকদের ‘হৃদয়ের স্পন্দন’ বলে আখ্যায়িত হতো, সে আজ এক রিসোর্ট ঘটনায় বোকামির কারণে বিড়ালে পরিণত হলো। জনগণের কাছে তার ভাবমর্যাদা কিভাবে ফিরে পাবে, বর্ণিত ঘটনার সাফাই কী দেবে, এটা তার বিষয়। কিন্তু পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের বেতনভুক কর্মচারী বিধায় তাদের কর্মকাণ্ড আলোচনা-পর্যালোচনা ও সমালোচনার দাবি রাখে। মাওলানা রফিকুল হক মাদানীকে গ্রেফতারের পর পুলিশ বলেছে, মাদানীর স্মার্ট মোবাইলে পর্নো ছবি ছিল, প্রশ্ন করতে চাই- কোন স্মার্ট মোবাইলে পর্নো ছবি নেই? সরকারি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে জনগণের কতক সুবিধা হয়েছে, কিন্তু অসুবিধাগুলো সরকার রোধ করতে পারেনি। স্মার্ট ফোনগুলোতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আপত্তিকর নগ্ন ছবি ও অশ্লীল কথাবার্তা চলে আসে। এতে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীরা খারাপের দিকে যাচ্ছে। ‘ধর্ষণ’ মহামারীতে পরিণত হওয়ার এটাও একটি কারণ বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। পুলিশের নীতি আদর্শ থাকা দরকার। একজন আলেমের ইজ্জত নষ্ট করার দায়িত্ব পুলিশের নয়, তাদেরকে শুধু নির্দেশে নয় বরং নীতিতে চলা দরকার; অন্য দিকে পুলিশ শুধু আদেশের বাহক হওয়ার পাশাপাশি সামান্য পরিমাণ হলেও তাদের আদর্শিক চিন্তাচেতনা থাকা দরকার। শিশু বক্তার বিরুদ্ধে পর্নো সংক্রান্ত মামলা দায়ের হয়নি, অথচ এরই মধ্যে একজন আলেম সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য কতটুকু সঠিক হয়েছে তা দেশবাসী নিশ্চয় বিচার-বিশ্লেষণ করছেন। হেফাজতকে বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। তৎকালীন হেফাজত প্রধান প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি মাতা’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন, যা তিনি (প্রধানমন্ত্রী) প্রত্যাখ্যান করেননি। মোদির আগমনের পরিপ্রেক্ষিতে হেফাজতের আন্দোলন সরকার এড়িয়ে যেতে পারত তাই ১৯ জনের প্রাণহানির প্রয়োজন হতো না। সরকার হেফাজতের আন্দোলনকে কৌশলগতভাবে বাধা না দিয়ে বরং সুড়সুড়ি দিয়েছে। এ ঘটনায় সরকারের ভেতরে অভ্যন্তরীণ কোনো সরকার তৎপরতায় লিপ্ত কি না তা-ও পর্যালোচনার সময় এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রকে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে। সরকারের আশকারা না পেলে পুলিশ অতিউৎসাহী হয়ে মানুষ হত্যার জন্য এত তৎপর হতো না। উল্লেখ্য, ১৭ এপ্রিল ২০২১ চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বেতনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়ে ঘটনাস্থলে পাঁচজনকে হত্যা এবং প্রায় ৩০ জনকে আহত করেছে। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেনকে প্রধান করে সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার জন্য তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। সাতদিন পার হলেও জনগণ তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জানতে পারেনি এবং বাংলাদেশের এটাই হলো ‘তদন্ত সংস্কৃতি’। মানে তদন্ত কমিটি হবে; কিন্তু জনগণ তদন্ত প্রতিবেদন জানতে পারে না; অথচ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক।
সরকারের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করে, এমন প্রতিটি বিষয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপির Participation রয়েছে বলে মন্তব্য করে আসছেন প্রতিনিয়ত। তার মতে দেশে যা ঘটন বা অঘটন ঘটছে, তা সম্পূর্ণ বিএনপির কারসাজিতে। হেফাজতের ঘটনায় আলেম ওলামা অকাতরে গ্রেফতারের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ জেলার বিএনপির নেতাকর্মীদেরও গ্রেফতার চলছে। সরকার বিএনপির ঘরে আগুন লাগাতে গিয়ে নিজেই সে আগুনে জ্বলে পুড়ে মরণ যন্ত্রণায় ভুগছে। ওবায়দুল কাদেরের সাথে দীর্ঘদিন জেল খেটেছি। তার অমায়িক ও বন্ধুসুলভ ব্যবহার ও আচরণে আমি মুগ্ধ হলেও তার মতো একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও নেতার পক্ষে প্রতিনিয়ত কেবলমাত্র বিএনপিকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেন মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। অথচ তার নিজ নির্বাচনী এলাকায়, নিজ ঘরে আপনজনদের মধ্যেও যে আগুন জ্বলছে, তার সমাধান তিনি দিতে পারছেন না, এমনকি বিগত চার মাসে নিজ এলাকায় গিয়ে বা বিরোধীর উভয় পক্ষকে ঢাকায় ডেকে এনে কোনো সমাধান দিতে পারছেন না, এমতাবস্থায়, শুধু বিএনপি নিয়ে মাথা ঘামালে অন্যান্য জেলায় সরকারি দল বনাম সরকারি দলের মধ্যে যে ফ্রি স্টাইল ফাইট চলছে, সে আগুন তিনি নেভাবেন কিভাবে?
প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, সংবিধান মোতাবেক জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। কিন্তু রাষ্ট্র এখন পুলিশের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। বড় বড় মাদরাসা অধ্যুষিত এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতো প্রতিটি থানায় (পাকিস্তানি আর্মি ক্যাম্পের মতো) বালুর বস্তা দিয়ে মেশিনগান তাক করার ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। পুলিশ এ মেশিন গান কাদের প্রতি তাক করে আছে? বহিঃশত্রু দ্বারা বাংলাদেশ আক্রান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, তবু কেন এই বালুর বস্তা ও মেশিন গানের তৎপরতা (!)। তবে কি সরকার মনে করছে যে, থানা লুট হতে পারে? তার জন্য এই যুদ্ধংদেহী মনোভাব? তবে কি জনতাই পুলিশের প্রতিপক্ষ (?) সর্ব বিষয়ে সরকার পুলিশ দিয়ে বিদ্রোহী বা বিক্ষোভকারী জনতাকে শায়েস্তা করছে বিধায় নিরাপত্তার প্রশ্নে পুলিশই এখন জনগণের মুখামুখি (!)। আব্রাহাম লিংকনের থিওরি যথা- ‘Democracy is of the People, By the People and for the People’ সরকার যদি মনে করে, তারা গণতান্ত্রিক সরকার তবে জনগণের জানমাল রক্ষার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করা বাঞ্ছনীয়। পুলিশকে সর্ববিষয়ে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানোর কারণে এখন প্রায় সময় দেখা যায় যে, জনগণ বনাম পুলিশ সংঘর্ষ হচ্ছে, হচ্ছে ধাওয়া ও পাল্টাধাওয়া। রাষ্ট্রের পক্ষে পুলিশ জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় পুলিশের নিরাপত্তা নিয়ে সরকারকে তৎপর হতে হচ্ছে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জনগণের পক্ষে বিষয়টি মেনে নেয়া অত্যন্ত দুঃখজনক।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]