দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণের করুণদশা

0

আকরামুজ্জামান ॥ করোনা ভাইরাসের কারণে বছর ধরে কর্মহীন হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। ভেঙে পড়েছে বহু পরিবারের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড। এরমধ্যে নিত্যপণ্যের লাগামহীন বৃদ্ধিতে নি¤œআয়ের মানুষের পরিবারের এখন নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। রমজান শুরুর মাস খানেক আগেই বেড়ে গেছে প্রতিটি জিনিসের দাম। গত দুই মাস ধরে ভোজ্যতেলের বাজার ঊর্ধ্বমুখী। লাগামহীন চালের বাজার। পেঁয়াজ, আদা, ডিম, আটা ও মুরগির দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এতেই করুণদশা নিম্ন ও মধ্যবিত্তের। পরিস্থিতির জন্যে ভোক্তারা সরকারের বাজার তদারকির দুর্বলতাকেই দায়ী করছে।
ুদ্র বিনিয়োগ প্রকল্পে কর্তব্যরত এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের খুবই করুণদশা। ব্যাংকসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নেয়া এ মানুষগুলো যত দিন যাচ্ছে তত ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। সংসারের খাবার খরচ যোগাতে গিয়ে তারা আর অন্য কিছু করতে পারছেন না। আবার অনেকে একাধিক সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে তা খরচ করে ফেলছেন বাজার করে। দেশে প্রতি বছর পবিত্র রমজান মাস এলেই নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। এটা নতুন নয়। তবে এবার যেটুকু ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে তা হলো, রমজান শুরুর মাসখানেক আগেই বেড়ে গেছে প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের দুশ্চিন্তা বেড়েই চলছে। চাল কিনলে তেল কিনতে পারছেন না তারা। আবার তেল কিনলে ডাল কিনতে পারছেন না। সরকারি বেসরকারি পরিসংখ্যান বলছে, করোনাকালে দেশের বেশির ভাগ মানুষের আয় কমেছে। ফলে দেশে দারিদ্র্যের হার আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। রমজানের আগেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর ব্যবসায়ীদের কূটকৌশলের কাছে সরকার যেন আত্মসমর্পণ করেছে। যেমন, সরকার নিজেই পুনঃনির্ধারণের নামে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিভিন্ন সংস্থার হিসেব মতে, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ২১ লাখ টন। শুধু রমজানেই চাহিদা থাকে প্রায় চার লাখ টন। একইভাবে বছরে চিনির চাহিদা ১৮ লাখ টন। রমজানে তিন লাখ টন। সারা বছর মসুর ডালের চাহিদা পাঁচ লাখ টন, যার মধ্যে রমজানে থাকে ৮০ হাজার টন। আর বছরজুড়ে ৮০ হাজার টন ছোলার চাহিদার ৯০ শতাংশই লাগে রমজানে। সেই সাথে সারা বছর দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ থেকে ২৭ লাখ টন। এর মধ্যে রমজানে এর চাহিদা থাকে প্রায় পাঁচ লাখ টন। এই চাহিদার বিপরীতে রমজানে টিসিবি আড়াই কোটি লিটার ভোজ্যতেল, ১৭ হাজার টন ডাল, ৬০০ টন ছোলা, ১৩ হাজার টন চিনি, ১৭ হাজার টন পেঁয়াজ ও অন্যান্য আরও কিছু পণ্য বিক্রি করবে বলে জেলা কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে। তবে টিসিবির এই পণ্য চাহিদার তুলনায় খুবই কম। ফলে বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়বে না বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন। যশোর বড়বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে কয়েক ধাপে বেড়েছে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম, লিটারে ১৫ থেকে ২০ টাকা। বোতলের তেলও লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চিনির দাম কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা বেড়েছে। আটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ময়দার দাম অনেক দিন ধরেই চড়া। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম বলেন, জানুয়ারিতে অনেকের বাসা ভাড়া বেড়েছে। দুই শয়নকরে বাসার ভাড়া বেড়েছে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা। বেড়েছে গ্যাসের দাম। এভাবে দাম বৃদ্ধির চাপ পুরো এখন নি¤œআয়ের মানুষের ঘাড়ে চেপে বসেছে। যারা মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করছেন তাদেরও সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, অনেকেই ব্যাংক লোন নিয়ে তাদের সংসারের অনেক ঘাটতি পূরণ করেছেন। সেসব ঋণের ঘানি টানতে গিয়ে তারা এখন আর সংসার চালাতে পারছেন না। কথা হয় শাহিনুর আলম নামে এক দোকান কর্মচারীর সাথে। তিনি একটি বেসরকারি ভোগ্যপণ্য বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। স্ত্রী, দুই সন্তান নিয়ে থাকেন যশোর শহরতীর উপশহর এফব্লকে। দুই শয়ন কক্ষের বাসা ভাড়া দিতে হয় তাকে ৬ হাজার টাকা। তিনি বলেন, ১২ হাজার টাকার বেতনে চাকরি করেও সংসার চালাতে পারছি না। একদিকে ঘর ভাড়া, ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে গিয়ে আর বাজার করার চিন্তা মাথায় আসছেনা। এখন চিন্তা করছি ৩ হাজার টাকার একটি মাসিক সঞ্চয় স্কিম ভেঙে ফেলার। নইলে সামনে রমজান মাসটা পার করা সম্ভব হবে না। এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর যশোরের বাজার কর্মকর্তা মো. সুজাত হোসেন খান বলেন, রমজানের আগে যাতে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন দাম বাড়তে না পারে সেজন্য প্রতি মাসে অন্তত ৬ টি করে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার পরিকল্পনা নিয়েছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা চেয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি লিখিত আবেদন করা হয়েছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, করোনা ও রমজানকে টার্গেট নিয়ে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী পরিকল্পিতভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ালে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।