উইমেন ইন ডিজিটালকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চান আছিয়া নীলা

    0

    লোকসমাজ ডেস্ক॥২০১৩ সালের কথা। সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রচেষ্টার বিষয়টি সবার মুখে মুখে। তখন আছিয়া নীলা ভাবছিলেন দেশের নারীদের ক্ষেত্রে কীভাবে এর বাস্তবায়ন হবে? দেশের জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ নারী। গ্রামীণ পর্যায়ে তখনো ডিভাইস বলতে ছিল মোবাইল। সে মোবাইলও থাকত বাবা কিংবা ভাইয়ের কাছে। সঠিক শিক্ষা নেই, ডিভাইস নেই এ রকম অবস্থায় কীভাবে তারা ডিজিটাল হবে? কিন্তু নীলার মুক্তিযোদ্ধা বাবা তাকে অনুপ্রেরণা জোগান। তার বাবার কথা, ‘আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। এখন দেশকে সাজানোর দায়িত্ব তোমাদের।’ নীলা ভাবতে শুরু করেন। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার তাই আবেগের তুলনায় যুক্তি দিয়ে ভাবতেই বেশি পছন্দ করেন তিনি। বাবার কথায় যুক্তি খুঁজে পেয়ে তার অনুপ্রেরণায় প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে নিতে কাজ শুরু করেন, যার ফল আজকের ‘উইমেন ইন ডিজিটাল’ প্লাটফর্ম। এর প্রতিষ্ঠাতা আছিয়া নীলা। উইমেন ইন ডিজিটাল প্লাটফর্ম প্রায় আট বছর ধরে প্রযুক্তি খাতে নারীদের নিয়ে কাজ করছে। এটি মূলত একটি সফটওয়্যার কোম্পানি। সম্প্রতি বণিক বার্তার মুখোমুখি হয়েছিলেন আছিয়া নীলা। উইমেন ইন ডিজিটালের যাত্রা, বর্তমান অবস্থা, কভিডের প্রভাবসহ নানা বিষয়ে বিশদ আলাপ করেছেন।
    নীলা জানান, প্রথম দিকে ঢাকার বাইরের নারীদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে মায়ায় পড়ে যান। তাদের নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেন তখনই। এরপর কেটে গেছে প্রায় আটটি বছর। পাঁচ-ছয়জন নারীকে নিয়ে কাজ শুরু করেন নীলা। চলার পথ মসৃণ ছিল না। শুরু থেকে এখনো যে সমস্যার মুখোমুখি তিনি হচ্ছেন তা হলো অধিকাংশই জানেন না উইমেন ইন ডিজিটাল প্লাটফর্মের কাজ কী। একজন নারী সফটওয়্যার কোম্পানি পরিচালনা করতে পারেন এটা অনেকেই বিশ্বাস করতে চান না। অনেকেই ভাবেন এটা সম্ভবত এনজিও কিংবা বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন, যারা নারীদের নিয়ে কাজ করছে।
    আট বছরের পথচলায় প্রাপ্তির সংখ্যাও কম নয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্লাটফর্মটি এখন বেশ পরিচিত। নীলার কথায় জানা গেল, তারাই প্রথম বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় ‘ন্যাশনাল হ্যাকাথন ফর উইমেন’-এর আয়োজন করেছেন। ‘ডিজিটাল ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ ফর উইমেন’ নামে নারীদের জন্য তাদের আরেকটি প্রতিযোগিতা রয়েছে। এর শুরুটাও তারাই করেছেন। উইমেন ইন ডিজিটাল প্লাটফর্ম দেশের প্রায় ১০ হাজার নারীকে প্রযুক্তিবিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সাত হাজার নারী দেশের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন। কভিডেও তাদের কার্যক্রম বন্ধ ছিল না বলে জানালেন প্লাটফর্মটির প্রতিষ্ঠাতা। তবে প্রভাব পড়েছে তাদের ওপরও। প্রতিষ্ঠানে কভিডের প্রভাব সম্পর্কে আছিয়া নীলা বলেন, ‘আমরা আউটসোর্সিং কোম্পানি। তাই বিদেশের অনেক কাজ করি। গত বছর এপ্রিলে বিশ্বব্যাপী লকডাউন শুরু হলে অনেক প্রজেক্ট স্থগিত হয়ে যায়। কিছু এজেন্সি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তারা কাজ পাঠাতে পারছিল না। অনেক ক্লায়েন্টের কাছ থেকে মেইলের উত্তরও পাচ্ছিলাম না। ফলে মফস্বলে আমাদের পরিচালিত বেশকিছু স্কুল বন্ধ করে দিতে হয়েছে।’ বর্তমানে এ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন নীলা। তিনি বললেন, ‘অনেক আইটি কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখনো সে পর্যায়ে যাইনি। ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। ক্লায়েন্টরা ফিরে আসছেন, আমরা কাজ করছি।’ করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রতিষ্ঠানটি কোনো কর্মীকে চাকরিচ্যুত করেনি।
    কালের পরিক্রমায় নারী এগিয়ে চলেছে। সব ক্ষেত্রে নারীরা এখন সফল। প্রযুক্তিতে নারীর অগ্রগতি এখন কেমন দেখছেন? এমন প্রশ্নে নীলার উত্তর, ‘কাজ শুরুর আগে বাংলাদেশের কোথায় কোথায় নারীদের কী অবস্থা, কী কাজ করছেন তারা, কোন ক্ষেত্রে বেশি কাজ করছেন, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কেন আসছেন না—এসব গবেষণা করেই মাঠে নেমেছিলাম। তখনকার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৬-৭ শতাংশ নারী আইটি সেক্টরে ছিলেন। আর এখন ৯-১০ শতাংশের মতো নারী আইটি সেক্টরে কাজ করছেন।’ এর পেছনে উইমেন ইন ডিজিটাল প্লাটফর্মের প্রত্যক্ষ অবদান রয়েছে। নারীরা যেন প্রযুক্তি খাতে এগিয়ে আসেন সে লক্ষ্যে সচেতনতা তৈরিতে ক্যাম্পেইন, নানা প্রতিযোগিতা ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করছে প্রতিষ্ঠানটি।
    দেশের ভেতরে রংপুর, কুড়িগ্রাম, রামগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও ময়মনসিংয়ে উইমেন ইন ডিজিটাল প্লাটফর্মের টেকনিক্যাল স্কুল রয়েছে। এছাড়া নেপালেও রয়েছে একটি। সেখানে তিন-চার বছর ধরে কাজ করছে প্লাটফর্মটি। নেপালে কীভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করেন? এ প্রশ্নের জবাবে নীলা বলেন, ‘সেখানে একজন কান্ট্রি ম্যানেজার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি স্কুলটি পরিচালনা করেন। আর আমি নিয়মিত যাওয়া-আসা করি। কভিডে অনলাইনে আমাদের নিয়মিত আলাপ-আলোচনা হয়। যদিও করোনার কারণে এখনো স্কুলটা খুলতে পারিনি। নেপালে লকডাউন চলছে। আশা করছি দু-তিন মাসের মধ্যে খুলে যাবে।’
    উইমেন ইন ডিজিটাল বিভিন্ন ধরনের কাজ করে যেমন—স্কিল ডেভেলপমেন্টের পাশাপাশি আউটসোর্সিং, উইমেন ইন সাইবার সিকিউরিটি, উইমেন ইন ডিজিটাল হেলথ ও এগ্রো টেক নিয়েও কাজ করছে তারা। প্রতিটি কাজের জন্য রয়েছে আলাদা টিম। ৮ মার্চ নারী দিবসে ‘উইমেন ইন ই-কমার্স’ নামে আরেকটি প্লাটফর্মের যাত্রা করেছে।
    উইমেন ইন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে আছিয়া নীলা বলেন, আমাদের ওয়েবসাইটের মধ্যেই একটা জায়গায় উইমেন ইন ই-কমার্স ছিল, যেখানে আমরা পণ্য কেনাবেচা করতাম। উইমেন ইন ডিজিটাল আসলে অনেক ধরনের কাজ করে। তাই আমরা প্রতিটি জিনিসকে আরো সুনির্দিষ্ট করার কথা চিন্তা করছি। এ কারণে উইমেন ইন ই-কমার্স আবারো আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে। এটা একটা মার্কেটপ্লেস হচ্ছে। এর কার্যক্রম সম্পর্কে নীলা বলেন, ইভ্যালি, বাগডুম প্রভৃতি দেশে প্রতিষ্ঠিত ই-কমার্স। কিন্তু নারীদের ই-কমার্স প্লাটফর্ম নেই। অধিকাংশ নারী ফেসবুক পেজের মাধ্যমে পণ্য কেনাবেচা করেন। এটা কিন্তু সত্যিকারার্থে বিজনেস নয়। গ্রামীণ নারীদের আমরা একটা ই-কমার্স প্লাটফর্ম দিচ্ছি। ফেসুবক গ্রুপ বা পেজ নয়, সরাসরি অনলাইন মার্কেট। যেখানে তারা ভার্চুয়াল শপ তৈরি করতে পারবেন। এখন পর্যন্ত আমরা ১৫টি শপ পেয়েছি। এর মধ্যে বিবিয়ানা, রেইনে বাংলাদেশের মতো কিছু শপ আমাদের সঙ্গে রয়েছে। আরো অনেক অনুরোধ পাচ্ছি। প্লাটফর্মটি তৈরির আরেকটি লক্ষ্য আন্তর্জাতিক বাজার ধরা বলে জানালেন আছিয়া নীলা। উইমেন ইন ডিজিটাল প্লাটফর্মকে ভবিষ্যতে কোথায় দেখতে চান? আছিয়া নীলা বলেন, উইমেন ইন ডিজিটাল প্লাটফর্মকে পৃথিবীর সব দেশে দেখতে চাই।