সমাজের অন্য শিশিরদের পাশেও দাঁড়াতে হবে

0

মরিয়ম চম্পা॥ তাসনুভা আনান শিশির। রূপান্তরিত নারী (ট্রান্সজেন্ডার)। শৈশবের কামাল হোসেন শিশির থেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিজেকে তাসনুভা আনানে রূপান্তরিত করেছেন যিনি। যেটা মানতে চায়নি নিজ পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ কেউই। সাত বছর আগে কলকাতায় গিয়ে অস্ত্রোপচার করেছেন তাসনুভা। হরমোন থেরাপি, মানসিক থেরাপিসহ বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে তিনি এখন তাসনুভা আনান শিশির। প্রথমবারের মতো ট্রান্সজেন্ডার নারী হিসেবে টেলিভিশন খবর উপস্থাপন করে আলোচনায় আসা শিশির জানিয়েছেন তার জীবনে ফেরার গল্প।
হিজড়া তকমাটি গায়ে লাগার পর থেকেই বিচ্ছিন্ন হতে হয় প্রিয় পরিবার থেকে। তাসনুভার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট।
২০১৪ সাল থেকে তিনি ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। ট্রান্সজেন্ডার, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কর্মরত বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি নামক একটি এনজিও’র প্রকল্প কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। কাজ করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেও। ছয় ভাইবোন। বাড়িতে শুধু বাবা-মা থাকেন। চার বোনের বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়িতে এখন তারা। এক ভাই বিয়ে করে আলাদা থাকেন। কিশোর বয়স থেকেই শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো বুঝতে শুরু করেন তাসনুভা। তার চিন্তায় এক সময় স্ট্রোক করেন বাবা। সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরের ইতিহাসে বিরাট একটি মাইলফলক তৈরি করেছেন শিশির। বেসরকারি বৈশাখী টেলিভিশনে প্রথমবার নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে কাজ করেছেন রূপান্তরিত নারী তাসনুভা। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বৈশাখী টেলিভিশনে প্রথম সংবাদ বুলেটিন উপস্থাপন করেন তিনি। এ ছাড়া বিনোদন অঙ্গনেও অবাধ বিচরণ রয়েছে তার। নাচ-গান ও অভিনয়েও বেশ পারদর্শী। দুটি চলচ্চিত্রে কাজ করছেন বলে জানান তিনি। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। তাসনুভা বলেন, একটা কথাই মনে পড়ছে। আমরা সবসময় রং, বর্ণ-গ্ল্যামারের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমি-মুই যেটাই বলেন না কেন হারিয়ে ফেলি। এখন একক শিশির বা একক তাসনুভাকে কেন্দ্র করে পড়ে না থেকে আমাদের উচিত সমাজে অন্য যারা রয়েছেন তাদের পাশে দাঁড়ানো। হয়তো আপনার পাশেও একজন তাসনুভা আছে। তাদের চলার পথটি যেন সহজ করে দেয়া হয়। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, আপাতত মাস্টার্স পরীক্ষাটা শেষ করতে চাই। ব্র্যাক জেপিজি স্কুল অব পাবলিক হেলথ থেকে মাস্টার্স অব পাবলিক হেলথ কোর্স করছি। চতুর্থ কোর্স চলছে। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে সরকার আমাদের বিষয়টি স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু দিন শেষে মানুষগুলো (তৃতীয় লিঙ্গ) এখনো রাস্তায়। আপনাদের বিরক্ত করছি আমরা। আপনারা নাক সিটকাচ্ছেন। কোনো একটি জায়গায় আমাদের সেতুবন্ধনটা হয়নি। এটা না হওয়ার পেছনে অবশ্যই একটি শূন্যতা রয়েছে। সেই শূন্যতাটা কী এটা নিয়ে কাজ করতে চাই। এরপরে হয়তো কাজের আরো সুযোগ আসবে। এ ছাড়া আমার নিজস্ব একটি প্ল্যাটফরম রয়েছে ‘সি দ্য ভয়েস অব সেক্সুয়াল মাইনরিটি’। যেখানে সুবিধাবঞ্চিত বিশেষ করে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে কাজ করছি। মূলত ২০১৫ সালে যখন আমি আমার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন মনে হয়েছে ব্যক্তিগতভাবে যে সব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি আমার আরেকটি ভাইবোনও এরকম সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে হয়তো।
তার মানে তাদের জন্য আমারও কিছু করা উচিত। করোনাকালে এবং এর আগেও কাজ করেছি। কাজের পরিধিটা বাড়াতে চাই। আমাদের কমিউনিটিতে যারা আছেন তাদের অনেকেরই অনেক যোগ্যতা বা গুণ আছে সেটা হয়তো বাইরে বিকশিত হচ্ছে না। এখন হয়তো একজন তাসনুভাকে দেখে মানুষের ভাবনার জায়গায় পরিবর্তন এসেছে।
কাজেই আমি এমন একটি প্লাটফরম তৈরি করতে চাই যেখানে টপ টু বটম আমরাই কাজ করবো। আমাদের কথাগুলো আমরাই বলবো। আমাদের অধিকারগুলো আমরাই নিশ্চিত করার চেষ্টা করবো। এর মধ্য দিয়ে আমি এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে একজন রূপান্তরিত নারী চিকিৎসক, পলিসি ম্যাকিং রিপ্রেজেনটেটিভ, শিক্ষক, প্রকৌশলী থাকবে। মোটকথা হচ্ছে স্ব স্ব যোগ্যতার ভিত্তিতে যার যে জায়গা দরকার সেটা তৈরি করতে চাই। বেসরকারি টেলিভিশনে প্রথমবার নিউজ প্রেজেন্টার হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে শিশির বলেন, গত বছর আমার ফেসবুক পেজ ভেরিফাইড হয়। এবং ২০১৯ সাল থেকে গণমাধ্যমে কাজ করছি। সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছি। তখন মনে হয়েছে হয়তো শিল্পী হিসেবে যে বাঁচার চেষ্টা করেছিলাম সেই যুদ্ধটা একটু সহজ হলো। বৈশাখী টেলিভিশনে খবর পড়াটা ছিল আমার জন্য দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। এই খুশিটা বলে বোঝানো যাবে না। এতদিন হয়তো আমার জার্নিটা কাছের মানুষ জানতেন। এখন সারা পৃথিবীর মানুষ জানে। এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।