আরো একতলা নিচে

0
ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
এ কথা প্রথম মনে হয়েছিল ভুটান গিয়ে। বারবার মনে হয়েছে, ভুটান দেশটি কয়তলা? পাহাড়ের গায়ে থরে থরে সাজানো ঘরবাড়ি। দালান-কোঠা কি না, বলতে পারি না। ভুটানের ভবন গড়ে ওঠা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। দু’দিক বা তিন দিকই বন্ধ, শুধু এক দিক খোলা। সেখানে ভবন। কোথায়ও কোথায়ও পর্বতের গায়ে সারির পর সারি ভবন। রঙিন ঝলমলে। মনে হয় যেন ১০-১৫ তলা। সে রকম দৃশ্য সমতল ভূমির বাংলাদেশেও আছে, তা আমার কল্পনায়ও ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল বৃহত্তর সিলেটের রেমা-কালেঙ্গায় এসে উঠেছিলাম ১৮ ফেব্রুয়ারি। সেটি প্রথম অভিজ্ঞতা। যেখানে থাকার জায়গা ঠিক করে এসেছি। সে জায়গাটি বন বিভাগের ডাকবাংলোর কাছাকাছি। ডাকবাংলোটি টিলার উপরে। ফলে এখান থেকে এদিক-ওদিক যেতে পৃথিবীর গভীরে নামার কোনো অনুভূতি হয় না। কিন্তু এর পাশ দিয়েই প্রায় সোজা নিচে নেমে গেছে ইট বিছানো পথ। পাঁচ থেকে ১০ বছর আগে কোনো একসময় ইটগুলো বিছানো হয়েছিল। তারপর টুকটাক যানবাহনের ধাক্কায় ইট উঠে গেছে। অপর দিকে, এঁটেল মাটির এলাকায় বর্ষায় কেউ কেউ উঠানে নিয়ে রেখেছে দু-চারখানা ইট। ফলে রাস্তার ‘দাঁত বের করা’ চেহারা। এর মধ্যে খাবি খেতে খেতে মাঝে মধ্যে চলে বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল। হঠাৎ-হঠাৎ চলে দু-একটা সিএনজি।
এ রকম খাড়া পথ পৃথিবীর অনন্ত গহ্ববের দিকে নেমে গেছে। কত দূর নেমেছিলাম, মনে নেই। তারপর দেখলাম, একটি পরিপাটি মাটির উঠান। দু’পাশে মাটির ঘর। এঁটেল মাটি। দেয়াল এবং উঠান সুন্দর করে নিকানো। বাংলাদেশের একেবারেই নিচতলা। মনে হলো, এর চেয়ে নিচে বোধ হয় যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আমরা লাসু মিয়ার ‘নিসর্গ তারাফ’ ইকো কটেজে উঠলাম। দেয়াল চমৎকারভাবে রঙ করা। বাইরেও তাই। লাসু মিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, এত ইট কিভাবে এখানে আনলেন? এর একটা ইটও নেই। সবটাই মাটি। বাংলাদেশের একেবারে নিচতলা। আধুনিক সব সুযোগ সুবিধা-সংবলিত থাকার জায়গা। লাসু মিয়া, তার স্ত্রী ও পরিবার মিলে কটেজটি চালান। উপরের তলায় কিছু দোকানপাট আছে। লাসু মিয়া মুহূর্তে মুহূর্তে দোকানে ছুটে যান। লাফিয়ে লাফিযে চলেন। আমরা হাঁপাতে থাকি, উপর তলায় উঠতে হয় না। যখন যা প্রয়োজন লাসু মিয়াই এনে দেন। আমাদের হাঁটা-চলা নিচতলা ঘিরেই। কিন্তু আশ্চর্য অনুভূতি মনে হতে থাকে পৃথিবীর একেবারে নিচতলায় বসবাস করছি। দু’দিন পর আমরা নিচতলা ছাড়লাম। এবার যাত্রা শ্রীমঙ্গলের দিকে। শ্রীমঙ্গলে কোথায় যাবো, পরিকল্পনা করে বের হইনি। এখানে আহাদ নামে এক তরুণ সাংবাদিক ধরে নিলাম। কোথায় যেতে হবে, কী কী দেখতে হবে, সে আয়োজন আহাদই করবে। ধারণা ভুল ছিল না। আহাদ জানে কোথায় যেতে হবে, কী দেখতে হবে, কোথায় থাকতে হবে। কিন্তু গোল বাধল থাকার জায়গা নিয়ে। ১৯, ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি বন্ধ ছিল। হাজার হাজার মানুষ বিনোদনের আশায় ছুটে এসেছিল শ্রীমঙ্গলে। শহরে এসে কোথায়ও সিট পাওয়া যাচ্ছে না। একটা রুমও খালি নেই। উঠি কোথায়? আহাদ দুর্বল নেটওয়ার্কে ফোনটোন করে লাউয়াছড়ার গভীর বনের ভেতরে এক খাসিয়া পরিবারের সাথে থাকার ব্যবস্থা করে ফেলল। ওকে ‘সাবাসি’ দিতেই হয়। এর মধ্যে ১০-১৫ জন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতা আমাদের জন্য শহরজুড়ে রেস্ট হাউজ ও রিসোর্টগুলোতে রুম খুঁজতে লেগে গেলেন। শেষ পর্যন্ত শহরেই এনজিও হিট বাংলাদেশে একটি রুম পেয়েও গেলাম। তারপরও আমরা লাউয়াছড়ার গহিন জঙ্গলে বাংলাদেশের একেবারে নিচতলায় যদি যাওয়া যায়, থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। আহাদ একটি গাড়ি জোগাড় করে আনল; সাথে এলো সাংবাদিক রুবেল। ঢুকলাম লাউয়াছড়ার জাতীয় উদ্যানের ভেতরে। বনের অনেক গভীরে থাকে ২৬টি রাখাইন পরিবার। তাদের একটি মাত্র পরিবারের সাথে থাকার ব্যবস্থা। চার দিক সুনসান। শুধু আমাদের গাড়ির শব্দ। কখনো কখনো কোনো বন্যপ্রাণীর সড়াৎ করে সরে পড়া। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। পাখিরও শব্দ নেই। ঘুমিয়ে গেছে। সেখানে গাড়ি চলার শব্দ বড় বেমানান। খাড়া ঢাল বেয়ে গাড়ি নামছে। নামছেই। এক ঢালের মুখে চালককে বললাম, গাড়ি রাখেন তো ভাই। নামছেন যে, উঠতে পারবেন তো? তিনি বললেন, স্যার পনেরো শ’ ইঞ্জিন সবসময় ওভার হল করা থাকে। পাহাড়ি পথ-ঘাটে চলি, ইঞ্জিন দুর্বল হলে কী হয়। গাড়ি ঢাল বেয়ে নামছে তো নামছেই। কিন্তু এক জায়গায় গিয়ে থামতে হলো। এ পথে গাড়ি নামতে পারবে না, উঠতেও পারবে না। আমার স্ত্রীর পক্ষেও সেই ঢাল বেয়ে নামা বা ওঠা সম্ভব ছিল না। আহাদকে বললাম, গাড়ি ঘোরাও। তারপর বাংলাদেশের উপর তলার দিকে যাত্রা। খানিকটা ভয়ে ভয়েই তো ছিলাম। যদি ইঞ্জিন ফেল করে, তাহলে কী হবে? কিন্তু, না। তেমন কোনো বিপর্যয় হয়নি। এক এক টানে একেকটা ঢাল অবলীলায় উঠে গেল। আমরা এসে হিট বাংলাদেশের এক উন্নতমানের রুমে উঠে গেলাম।
পরদিন ফের রওনা হলাম বাংলাদেশের গভীরতম নিচতলার দিকে। যথারীতি থামলাম। খুব খাড়া ঢালের পাশে। আমার সঙ্গীদের বয়স সবারই চল্লিশের কোঠায়। আমিই কেবল ঊনসত্তরে পা দিয়েছি। ঢালটা দেখে একেবারে যে শঙ্কিত হইনি, তা নয়। আল্লাহর নাম নিয়ে ছোট ছোট পদক্ষেপে ঠিকই নেমে গেলাম। নেমেই একটা ঝিরি। তাতে পানির প্রবাহ আছে। কোথা থেকে এ পানি আসছে, কোথায় যে যাচ্ছে, তা জানি না। উপজাতীয় জনপদের মানুষ এই পানি কি পান করে? তাও জানি না। তবে এই পানি টলটলে স্বচ্ছ। ঝিরির উপর কয়েকটি মরা গাছের টুকরো। পথ পার হওয়ার ব্যবস্থা। এরপর আলাদা জগৎ। খাসিয়াদের এলাকা। তাদের প্রধান জীবিকা পান চাষ। সুপারিগাছের ভেতরে এরা পান গাছ লাগায়। একসাথে দুটোরই ব্যবস্থা। এদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজ। ছেলেরা বিয়ে করে মেয়েদের বাড়িতে চলে আসে। দূরে কোথায়ও জুম চাষ করে। আর সারা দিন গাছে গাছে থাকে। পান গাছের যত্ন নেয়। এখানে পান চাষ সমতল ভূমির মতো নয়। মাচাং-এর ব্যবস্থা নেই। অন্য গাছেও হয়তো পানগাছ লাগায়। সেটি ভালো করে খেয়াল করিনি। যাই হোক, ঢাল থেকে নেমে আহাদকে জিজ্ঞেস করলাম, কত দূর? আহাদ বলল, ১০ মিনিটের পথ। ধরে নিলাম ৩০ মিনিট লাগবে। তখনো নামছি। শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌঁছানো গেল। টিলার উপরে মাটির ঘর বেশ বড়। মাচার উপর রান্নাঘর। খাসিয়া পরিবার। তবে মুসলমান। কিন্তু এক ঘরই মুসলমান। দু’তিনজন নারী ছিলেন। তারা সালাম জানালেন। রাতে এলে বা থাকতে চাইলে কোন রুমে থাকতে দেবেন তাও দেখালেন। পরিপাটি করে সাজানো ঘর, মাটির। বাইরে হাই-কমোড টয়লেট দেখালেন। খুব থাকতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু আমার স্ত্রীকে নেয়া সম্ভব ছিল না। চা খেলাম। গল্পগুজব করে ফিরে এলাম। সেখানেও দেখলাম ছোট্ট একটা দোকানঘর। বাড়ি? নোয়াখালী।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]