আটক ৩ জনের আদালতে স্বীকারোক্তি : আইনজীবী অপহরণে বাগদত্তাই অভিযুক্ত!

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সুপ্রিম কোর্টের এক জন আইনজীবী খুলনা থেকে অপহৃত হয়ে যশোরের অভয়নগরে উদ্ধার ঘটনায় তার বাগদত্তা জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। গতকাল ওই ঘটনায় প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান পিবিআই যশোরের পুলিশ সুপার রেশমা শারমিন। মঙ্গলবার অভয়নগর উপজেলার একতারপুর থেকে মুক্তিপণের দাবিতে অপহৃত আইনজীবীকে উদ্ধার ও অপহরণকারী অভিযোগে এক নারীসহ তিনজনকে আটক করে পিবিআই। পারিবারিকভাবে বিয়ে ঠিক হওয়া যুবতীর সাথে ঘুরতে এসে অপহৃত হন ওই আইনজীবী। তার বাগদত্তাসহ উচ্ছৃঙ্খল এক দল মাদকাসক্ত তরুণ তরুণী এ ঘটনা ঘটায়।
প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাবনগর গ্রামের মাদ্রসাশিক্ষক এসএম হারুন অর রশিদের মেয়ে রাবেয়া সুলতানা রিতুর সাথে পারিবারিকভাবে তালা উপজেলার বারুইহাটি গ্রামের এমএ হাকিমের ছেলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবু হেনা মোস্তফা কামাল মিলনের বিয়ে ঠিক হয়। তবে রাবেয়া সুলতানা রিতু শহরের এসে উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করেন ও মাদকাসক্ত তা কেউ জানতেন না। ইতোপূর্বে তিনি দুই যুবককে প্রেমের ফাঁদে ফেলে কৌশলে তাদের কাছ থেকে মোবাইল ফোন সেট ও টাকা হাতিয়েও নিয়েছেন। আইনজীবী আবু হেনা মোস্তফা কামাল মিলনের সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ায় এবার তাকেই টার্গেট করে তার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। গত ২৭ জানুয়ারি অভয়নগর উপজেলার একতারপুরে বান্ধবী সুরাইয়ার ভাড়া বাড়িতে বসে তিনিসহ চক্রের সদস্যরা পরিকল্পনা করেন। রাবেয়া সুলতানা রিতু, সুরাইয়া ও তার স্বামী হাবিব মিলন ওরফে রাজসহ আরও কয়েকজন এ সময় উপস্থিত ছিলেন। সেখানে এদিন মাদকের আসর বসে, যা চক্রের সদস্যরা তাদের কথিত জন্মদিন হিসেবে উদযাপন করেন।
পিবিআই পুলিশ সুপার রেশমা শারমিন বলেন, গত ৬ ফেব্রুয়ারি দুপুর আড়াইটার দিকে আবু হেনা মোস্তফা কামাল মিলন বাড়ি থেকে বের হন বাগদত্তা রাবেয়া সুলতানা রিতুর সাথে দেখা করার জন্য। খুলনার পাওনিয়ার কলেজের সামনে তার সাথে দেখা করার পর তারা দুজনে জাহানাবাদ ক্যান্টনমেন্ট পার্কে ঘুরতে যান। এরপর রাবেয়া সুলতানা রিতু বান্ধবী সুরাইয়ার ফোন পেয়ে নিরিবিলি কথা বলার নামে আবু হেনা মোস্তফা কামাল মিলনকে অভয়নগরের একতারপুরের ওই বাসায় নিয়ে যান। ইজিবাইকে করে তারা সেখানে যান। কিন্তু সেখানে যাওয়ার সাথে সাথেই পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সুরাইয়া ও তার স্বামী হাবিব মিলন ওরফে রাজসহ চক্রের সদস্যরা কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই আইনজীবীর হাত-পা বেঁধে ফেলেন। তাকে হত্যার ভয়ভীতি দেখিয়ে তার কাছে টাকা-পয়সা দাবি করা হয়। সন্ধ্যায় ওই আইনজীবী তার এক বন্ধু হাফিজকে বিপদে আছেন এ কথা বলে বিকাশের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা এনে দেন। রাত ৮টার দিকে হাবিব মিলন ওরফে রাজ এবং রাবেয়া সুলতানা রিতু বাসা থেকে বের হয়ে খুলনার ফুলতলায় যান। সেখানে বিকাশের এক এজেন্টের দোকান থেকে ওই ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করে হাবিব মিলন ওরফে রাজ। ফুলতলা থেকে টাকা উত্তোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে তাদের অবস্থান সম্পর্কে বিভ্রান্তির মধ্যে রাখা। ফুলতলায় যাওয়ার পর রাবেয়া সুলতালা রিতু তার মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ করে রাখেন এবং অজ্ঞাত স্থানে চলে যান। তবে চক্রের সদস্যদের সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোবাইল ফোন কনফারেন্সে তার কথা হতো। পুলিশ সুপার বলেন, একতারপুরের ওই বাসায় হাত-পা বেঁধে আইনজীবী আবু হেনা মোস্তফা কামাল মিলনকে বেধড়ক মারধর করা হয়। মোবাইল ফোনে তার পিতা এম এ হাকিমের কাছে প্রথমে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। বলা হয়, সন্তানকে ফিরে পেতে চাইলে এই টাকা দিতে হবে। এক পর্যায়ে ৩০ লাখ টাকার দাবি থেকে থেকে সরে এসে ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়। এরই মধ্যে চক্রের সদস্যরা কোয়েল পাখি কিনে এনে জবাই করে তার রক্ত আইনজীবীর শরীর থেকে পাঞ্জবি খুলে নিয়ে তাতে মাখিয়ে দেন। ওই রক্তমাখা পাঞ্জবি ডুমুরিয়ার একটি স্থানে ফেলে রাখা হয়। মোবাইল ফোনে চক্রের সদস্যরা স্থানটির কথা আইনজীবীর পিতাকে জানিয়ে দিয়ে বলেন, এটা তার সন্তানকে নির্যাতন করা রক্তমাখা পাঞ্জাবি। এরই মধ্যে তালা থানায় নিখোঁজ জিডি করে সন্তানকে উদ্ধারের জন্য আইনজীবীর পরিবার পিবিআইয়ের সাথে যোগাযোগ করে। ওই জিডির প্রেক্ষিতে গত ৮ ফেব্রুয়ারি তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে আবু হেনা মোস্তফাা কামাল মিলনকে উদ্ধারে অভিযান শুরু করেন পিবিআই কর্মকর্তারা। অপরদিকে প্রতারক চক্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আইনজীবীর পিতা সন্তানকে উদ্ধারের জন্য পিবিআই সদস্যদের সাথে টাকা নিয়ে ডুমুরিয়ার যান। কিন্তু সেখান থেকে রক্তমাখা পাঞ্জাবি উদ্ধার হলেও আইনজীবীকে পাওয়া যায়নি। এরপর আইনজীবীর পিতা যোগাযোগ করলে প্রতারক চক্রের সদস্যরা আবু হেনা মোস্তফা কামাল মিলনকে ফেরত দিতে তাকে প্রথমে খুলনার আড়াইশ’ শয্যার হাসপাতালের সামনে এবং পরে দৌলতপুরের মাছবাজার ঘাটে যেতে বলেন। গত মঙ্গলবার পিবিআই কর্মকর্তারা আইনজীবীর পিতাকে সাথে নিয়ে সেখানে গিয়ে কৌশলে চক্রের সদস্য শাহীন শিকদারকে আটক করেন। এরপর তার স্বীকারোক্তিতে দুপুরে অভয়নগরের একতারপুরের সুরাইয়ার বাসায় অভিযান চালিয়ে আইনজীবী আবু হেনা মোস্তফা কামাল মিলনকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় সেখান থেকে সুরাইয়া এবং চক্রের সদস্য আব্দুস সালামকে আটক করা হয়। উদ্ধার করতে গিয়ে পিবিআই কর্মকর্তারা দেখতে পান, ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে উচ্চ শব্দে মিউজিক বাজিয়ে আইনজীবীকে মারধর করছেন সুরাইয়া এবং আব্দুস সালাম। উচ্চ শব্দে মিউজিক বাজানোর কারণ হলো, আইনজীবীকে মারধর করা হলেও তার চিৎকার যাতে বাইরের কেউ শুনতে না পান। ব্রিফিংয়ে বলা হয়, প্রতারক চক্রের সদস্যরা আইনজীবীকে শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে, তাকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। পুলিশ সুপার জানান, সুরাইয়া-রাজ দম্পতি এক সময় ঢাকায় থাকতেন। তারা সেখানে দুটি মিউজিক ভিডিওতেও অংশ নিয়েছেন। তবে তারা প্রতারক এবং মাদকাসক্ত। তিনি আরও বলেন, পলাতক রাবেয়া সুলতানা রিতু এবং রাজকে আটকের চেষ্টা চলছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই এসআই ¯েœহাশিষ দাস জানান, আটক ৩ প্রতারককে বুধবার যশোরের আদালতে সোপর্দ করা হলে তারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক তাদের জবানবন্দি গ্রহণ শেষে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।